04 April 2017

কুমিল্লা জুড়ে চিরভাস্বর নজরুল


'আমার অন্তর্যামী জানেন,
তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত,
কি অসীম বেদনা!
কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি
'আমার অন্তর্যামী জানেন,
তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত,
কি অসীম বেদনা!
কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি
তা দিয়ে তোমায় কোনদিন দগ্ধ করতে চাইনি।
তুমি এই আগুনের পরশ মানিক না দিলে আমি
অগ্নিবীণা বাজাতে পারতাম না,
আমি ‘ধুমকেতু’র বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না।”
প্রিয়তমা স্ত্রী নার্গিস আশার খানমের উদ্দেশে লেখা নজরুলের এ কবিতা কুমিল্লায় নজরুলের গভীর প্রেম, ভালবাসা, বিচ্ছেদ ও সাহিত্য কর্মের অবাধ বিচরণের স্মৃতি বহন করে। মানবতা, সাম্য ও বিদ্রোহের যুগস্রষ্টা কবি নজরুলের সঙ্গে কুমিল্লার মাটি ও জনপদের রয়েছে চিরস্থায়ী বন্ধন।

বাংলা সাহিত্যে ধুমকেতুর মত উদ্ভাসিত বিস্ময়কর কবি নজরুলের ইংরেজ বিরোধী সংগ্রাম, সংগীত-সাহিত্য চর্চা, প্রেম, বিবাহ ও বিচ্ছেদসহ অসংখ্য স্মৃতি জড়িয়ে আছে উপমহাদেশের প্রাচীন নগরী কুমিল্লার সঙ্গে। মূলত সব্যসাচী নজরুলের বিশাল সাহিত্যের পরিধি বিকশিত হওয়ার পেছনে কুমিল্লা রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

কুমিল্লার জনগণ কবি নজরুলের স্মৃতিকে স্বযত্নে লালন করছেন পরম ভালবাসায়। অন্যায়, অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন, শোষণ বঞ্চনা এক সাম্রাজ্যবাদীদের ভয়াল থাবার বিরুদ্ধে কবি নজরুলের লেখনী শক্তি চিরকালেই ছিল আপোষহীন। কুমিল্লা জুড়ে চিরভাস্বর বিদ্রোহের সারথী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ওরফে দুখু মিয়ার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় নিয়ে এ প্রতিবেদন।
 
বিদ্রোহী নজরুলের আগমন
বিদ্রোহের চেতনায় শাণিত অগ্নিপুরুষ নজরুল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১৯১৭ সালে নজরুল যুদ্ধে গিয়েছিলেন। তিনি ব্যাটালিয়ন কোয়ার্টার মাস্টার ছিলেন। তখন কুমিল্লার বাসিন্দা ক্যাপ্টেন আলী আকবর খাঁর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ১৯১৯ সালে যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। সে সময় আলী আকবর খানের সঙ্গে নজরুলের হূদ্যতা গড়ে ওঠে। আলী আকবর নজরুলের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাকে কুমিল্লায় তার গ্রামের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানান।

১৯২১ সালের ৩ এপ্রিল নজরুল কলকাতা থেকে চট্টগ্রাম মেইলে করে আলী আকবর খাঁ
র সঙ্গে রাতে কুমিল্লায় আসেন। ফলে কুমিল্লার সঙ্গে সূচিত হয় নজরুলের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের। ওই রাতে নজরুল কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড়ে তার সহপাঠী বন্ধু ইন্দ্র কুমার সেনের ছেলে বীরেন্দ্র কুমার সেনের বাড়িতে ওঠেন। এখানে বীরেন্দ্রের মা বিজয়া সুন্দরী দেবীকে নজরুল মা বলে সম্বোধন করতেন। নজরুল মোট ৫ বার কুমিল্লায় এসেছিলেন। কুমিল্লায় অতিবাহিত করেছিলেন কবি তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলো।





নজরুলের প্রেমিক হয়ে উঠা
কুমিল্লায় এসে নজরুল পরিপূর্ণ প্রেমিক হয়ে উঠেন। কুমিল্লার নারীর মমত্ববোধ ও ভালবাসায় সিক্ত হয়েছিল নজরুল। নজরুলের দাম্পত্য জীবনের বন্ধনও ঘটেছিল কুমিল্লাতে। দুই মহীয়সী নারীর পাণি গ্রহণ করে কুমিল্লার সঙ্গে তার ঘটেছিল চিরায়ত নারীর সংযোগ। নজরুলের যৌবনের কিছু উজ্জ্বল সময় সময় কেটেছে কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার দৌলতপুরে। বিদ্রোহী কবি দৌলতপুরে এসে হয়ে গেলেন প্রেমের কবি। এক পল্লী বালিকা কবির জীবনের গতিপথ বদলে দিল। সেই গভীর প্রেমে আপ্লুত কবি নিজেই বলেছেন।

‘এক অচেনা পল্লী বালিকার কাছে এত বিব্রত আর অসাবধান হয়ে পড়েছি, যা কোনো নারীর কাছে হইনি।’
এ বালিকাটি আর কেউ নয়, সে হচ্ছে মুরাদনগরের বাঙ্গরা ইউনিয়নের দৌলতপুর গ্রামের মুন্সী বাড়ির আবদুল খালেক মুন্সীর মেয়ে সৈয়দা খাতুন। আদর করে প্রেমিক নজরুল তাকে ডাকতেন নার্গিস।

নার্গিসের সঙ্গে প্রেম-বিয়ে-বিচ্ছেদ
নজরুলের জীবনের প্রথম প্রেয়সী ছিলেন দৌলতপুরের নার্গিস। তার হাতেই নজরুলের প্রেমের হাতেখড়ি। কুমিল্লায় এসে কান্দিরপাড় এলাকায় বীরেন্দ্র কুমার সেনের বাড়িতে দু’দিন বেড়ানোর পর ৬ এপ্রিল আলী আকবর খাঁ নজরুলকে নিয়ে মুরাদনগরের বাঙ্গরা ইউনিয়নের দৌলতপুরে নিজ বাড়িতে যান।  বর্তমানে যেখানে আলী আকবর মেমোরিয়াল ট্রাস্টের বিল্ডিংটি অবস্থিত। এখানে আরেকটি ঘর ছিল, এ ঘরেই নজরুলকে থাকতে দেয়া হয়। এ ঘরটি ৪৫ হাত দৈর্ঘ্য ও ১৫ হাত প্রস্থ ছিল। বাঁশের তৈরি আটচালা ঘরটির একেবারে পূর্ব পাশে নজরুল থাকতেন। এই বাড়িতে থাকার সুবাদে আলী আকবর খাঁর ভাগ্নি পাশের বাড়ির সৈয়দা নার্গিস আশার খানমের সঙ্গে নজরুলের পরিচয় হয় এবং দু’জনে গভীর প্রেমে মগ্ন হন।


দৌলতপুরের এই বাড়িতে দু’টি বড় আম গাছ নজরুলের স্মৃতির সঙ্গে জড়িত। নজরুল একটি আমগাছের তলায় দুপুরে শীতল পার্টিতে বসে কবিতা ও গান রচনা করতেন। এই আমগাছের পাশেই ছিল কামরাঙ্গা, কামিনী, কাঁঠাল গাছের সারি। এখানে কবি নজরুল খাঁ বাড়ির ও গ্রামের ছেলে মেয়েদেরকে নাচ, গান, বাদ্য শেখাতেন।  

পুকুরের দক্ষিণপাড়ে অবস্থিত আম গাছটির নিচে বসে নজরুল বাঁশি বাজাতেন। যদিও সে গাছটি আর নেই। কয়েক বছর আগে গাছটি মারা গেছে। গাছের গোড়াটি পাকা করে রাখা হয়েছে। আম গাছের সামনে রয়েছে একটি শান বাঁধানো ঘাট। এই আমগাছের পাশ্বর্বতী পুকুরেই নজরুল ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাতার কাটতেন। একবার পুকুরে নামলে উঠবার নামও করতেন না। নজরুল সাবানের পর সাবান মেখে পুকুরের পানি সাদা করে ছোট মনিদের নিয়ে লাই খেলতেন , ডুব দিয়ে তাদের কলের গান শোনাতেন। পুকুরের পশ্চিমপাড়ে একটি আম গাছ আছে। এ আম গাছের তলায় এসে কবির মা (কবি আলী আকবর খাঁ’র নিঃসন্তান বোন ইফতেখারুন্নেছাকে মা ডাকতেন) খাবার নিয়ে এসে ডাকতেন ‘আয় নুরু, খেতে আয়!’ তখন কবি ভদ্র ছেলের মত গোসল সেরে বাড়িতে এসে ভাত খেতেন। কবি শখ করে জাল কিংবা পালা দিয়ে পুকুরে মাছ ধরতেন। কবি আমতলায় রাত দুপুরে মনভুলালো উদাস সুরে বাঁশি বাজাতেন। পাপড়ি খোলা কবিতাটি এই গাছতলায় বসেই রচনা করেন।

কবির থাকাকালে খাঁ বাড়িতে ১২টি কামরাঙ্গার গাছ ছিল, এখন আছে ২টি। কবির শয়নকক্ষের সংলগ্ন ছিল একটি প্রাচীন কামরাঙ্গা গাছ, যা তার অনেক কবিতা গানে, হাসি-কান্না, মান অভিমান এবং মিলন বিরহের নীরব স্বাক্ষী। তিনি মাঝে-মধ্যে বিশেষ করে দুপুরে এই গাছটির শীতল ছায়ায় বসে আপন মনে গান গাইতেন, গান রচনা করতেন। একটি কামরাঙ্গা গাছে একটি ফলক লাগানো রয়েছে। কবি এ গাছকে নিয়েই লিখেছেন-  ‘কামরাঙ্গা রঙ্গ লোকের পীড়ন থাকে, ঐ সুখের স্মরণ চিবুক তোমার বুকের, তোমার মান জামরুলের রস ফেটে পড়ে, হায় কে দেবে দাম।’

কবি এবং আলী আকবর খাঁ যখন বিকেল বেলায় একসঙ্গে গাছের ছায়ায় বসে শীতলপাটি বিছিয়ে কবিতা ও গান রচনা করতেন, রূপসী নার্গিস তখন নানা কাজের ছলে ছুটে আসতেন এই গাছের নীচে। কবি ও কবি প্রিয়ার চোখের ভাষায় ভাবময় করে তুলতেন তাদের হৃদয় লোকের কামরাঙ্গা গাছটিকে। বুকের স্বপ্নগুলো এখানে লেখা এবং উত্তরকালের নার্গিস নজরুলের অনেক অবিনাশী কবিতা শুনে এই গাছটি কাব্য সুষমা পেয়েছেন।

খাঁ বাড়ির পাশেই মুন্সী বাড়ি। নার্গিস এ বাড়ির আবদুল খালেক মুন্সীর মেয়ে। বাল্যকালে নার্গিসের বাবা-মা মারা গেছেন। নার্গিস অধিকাংশ সময় মামার বাড়িতে থাকতেন।


সেখানে নজরুলের কবিতায় আটি গাঙ্গের কথা এসেছে। এটি দৌলতপুরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে। বুড়ি নদী একটি, তবে কবি নজরুলের সেই আটি এখন খালে পরিণত হয়েছে। আটি নদীতে তিনি সাঁতার কেটেছেন। গোমতীতে নিয়মিত সাঁতার কাটার কোন সংবাদ পাওয়া না গেলেও গোমতীকে তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন। তাই তো তার কবিতায় এসেছে -

‘আজো মধুর বাঁশরী বাজে, গোমতীর তীরে পাতার কুটিরে, আজো সে পথ চাহে সাঁঝে।’
দৌলতপুর থাকাকালে নজরুল যেসব গান আর কবিতা লিখেছেন, এসব গান ও কবিতার বিষয়জুড়ে ছিল শুধুই নার্গিস। ১৮ জুন ১৯২১ (বাংলা ১৩২৮ সালের ৩ আষাঢ়)  নজরুল-নার্গিসের বিবাহ সম্পন্ন হয়। যেই ঘরে কবি নজরুল নার্গিসের মধু বাসর সম্পন্ন হয় সেটি ১৯৬২ সাল পর্যন্ত আটচালা ছিল। বর্তমানে চারদিকে বেড়ার আর টিনের ছাউনিতে রুপান্তরিত হলেও আয়তনে ভিটির কোনো পরিবর্তন হয়নি। নজরুল ও নার্গিসের বাসর ব্যবহƒত খাট, পালঙ্ক, বিছানা, ২টি বালিশ, কম্বল ও কাঠের সিন্ধুকটি এখনও সংরক্ষিত রয়েছে।
বাসর রাতে কবি নার্গিসকে একটি কবিতা উপহার দেন। তিনি লিখেছিলেন-
“ ব্যর্থ মোদের গৌধূলী-লগন এই সেই জনমে নহে,
বাসর শয়নে হারায়ে তোমায় পেয়েছি চির বিরহের ।
কত সে লোকের কত নদী
পারায়ে চলেছি মোর নিরবধি ।
মোদের মাঝারে শত জনমে শত সে জলধি বহে,
বারে-বারে ডুবি, বারে-বারে উঠি জন্ম মৃত্যু দহে।”
কিন্তু বিয়ের রাতেই বাসরঘর থেকে নজরুল বের হয়ে যান নার্গিসকে একা ফেলে এবং ওই রাতেই নজরুল অঝোর বৃষ্টি উপেক্ষা করে ১১ মাইল পথ পায়ে হেটে মুরাদনগরের দৌলতপুর ত্যাগ করে কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড় নজরুল এভিনিউ রোডের বাড়িতে আসেন। এরপর তিনি কখনো দৌলতপুরে ফিরে যাননি। দৌলতপুর ত্যাগ করার সময় নজরুল লিখে গেছেন, ‘আমি চিরতরে দূরে চলে যাবো তবু আমারে দেবনা ভুলিতে”। সত্যিই নজরুল আর কখনো দৌলতপুরে না ফিরলেও নজরুলের স্মৃতি এখনো আকড়ে ধরে আছে দৌলতপুরবাসী। নজরুলকে ভুলতে পারেনি এ জনপদের মানুষ। দৌলতপুরে কবি নজরুলের ৪টি স্মৃতি ফলক রয়েছে।


কান্দিরপাড় এসে নজরুল তার মামা শ্বশুর আলী আকবর খাঁনকে লেখা চিঠিতে বাবা শশুর সম্বোধন করে লেখেন,
‘আপনাদের এই অসুর জামাই পশুর মতন ব্যবহার করে এসে’ যা কিছু কসুর করেছে তা সকলে ক্ষমা করবেন। এইটুকু মনে রাখবেন, আমার অন্তর-দেবতা নেহায়েৎ অসহ্য না হয়ে পড়লে আমি কখনো কাউকে ব্যাথা দিই না। আমি সাধ করে পথের ভিখারি সেজেছি বলে লোকের পদাঘাত সইবার মতন ক্ষুদ্র আত্মা অমানুষ হয়ে যাইনি। আপনজনের কাছ থেকে পাওয়া অপ্রত্যাশিত এতহীন ঘৃণা অবহেলা আমার বুক ভেঙ্গে দিয়েছে”।

নজরুলের অতি সংবেদনশীল মনের পরিচয় চিঠিতে পাওয়া গেলেও কেন তার মন ভেঙে যায় এটি উল্লেখ করা হয়নি পত্রের কোথাও। অনুমান করা হয় হয়তো খান পরিবারের কোনো কোনো সদস্যের আচরণে তার মনের এ অবস্থা। তবে কথিত রয়েছে যে,  বিয়ের আসরে কাবিনের শর্ত নিয়ে তর্কাতর্কি হয়েছিল। তা ছাড়া কন্যা পক্ষ এমনও দাবি করেছিল যে, বিয়ের পর নজরুল বউ নিয়ে কোথাও যেতে পারবেনা বরং নজরুলকেই শ্বশুর বাড়িতে থাকতে হবে। হয়তো তা নিয়েই হয়তো নজরুল মনে আঘাত পেয়েছিলেন। কান্দিরপাড়ে কিছুদিন অবস্থান করে নজরুল প্রেম-বিরহ ও বিচ্ছেদের অগ্নিজ্বালা নিয়ে ৮ জুলাই বিকেল বেলায় কুমিল্লা ত্যাগ করে কলকাতা চলে যান।

বিচ্ছেদের পরও নার্গিসকে ভুলতে পারেনি নজরুল
বাসর রাতে নার্গিসকে ফেলে চলে আসার পর তার সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটে নজরুলের। কিন্তু বিচ্ছেদেও নজরুল তার প্রথম স্ত্রীতে বিস্মৃত হননি। প্রথম প্রেম প্রতিনিয়ত তার হৃদয়ে দোলা দিয়েছে। তার প্রমাণ বহন করে, দীর্ঘ ১৬ বছর পর ১৯৩৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি নজরুলের লেখা দীর্ঘ চিঠিখানা। তার প্রিয়তমা সাবেক স্ত্রী সৈয়দা খাতুন ওরফে নার্গিস আশার খানমকে নজরুল চিঠিটিতে লিখেছিলেন -
“আমার অন্তর্যামী জানেন, তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কি গভীর ক্ষত, কি অসীম বেদনা!
কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি-তা দিয়ে তোমায় কোনদিন দগ্ধ করতে চাইনি।"

তুমি এই আগুনের পরশ মানিক না দিলে আমি “অগ্নিবীণা” বাজাতে পারতামনা-আমি ‘ধুমকেতু’র বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না।”
চক্রবাক কাব্যের অনেক কবিতাও এ রমনীকে উদ্দেশ্য করে লেখা।
কান্দিরপাড়ে থাকাকালীন সময়ে নজরুল তার প্রেম নিবেদনের জন্য বহুল আলোচিত কবিতা বিজয়িনী লেখেন-
 ‘‘ হে মোর রানী!
তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে আমার বিজয় কেতন লুটায় তোমার চরণতলে এসে, আমার সমরজয়ী অমর তরবারি ক্লান্তি আনে দিনে দিনে হয়ে ওঠে ভারি”।
এই কবিতায় কবির প্রেম ও পরিণয়ের ঘোষণা ও সমর্পিত ভাব ছিল।
কান্দিরপাড়ের রমণী প্রমীলার সঙ্গে প্রেম ও বিয়ে
দৌলতপুরের নার্গিসের সঙ্গে বিচ্ছেদের বিরহ কাটিয়ে প্রেমিক নজরুল প্রেমে মজেন কুমিল্লা কান্দিরপাড়ের মেয়ে আশালতা সেনগুপ্তা প্রমীলার। ১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল (বাংলা ১৩৩১ সালের ১২ বৈশাখ) শুক্রবার বাদ জুম্মা কলকাতার ৬ নং হাজী লেনে নজরুলের সঙ্গে আশালতা সেনগুপ্তা প্রমীলার বিয়ে হয়।


প্রমীলাকে নিয়েই কেটেছিল নজরুলের দাম্পত্য জীবন। নজরুলের বিয়ে তৎকালীন কুমিল্লার হিন্দু সমাজ মেনে নিতে পারেনি।

সেনগুপ্ত পরিবার এবং মাতৃসদৃশ্য শ্রীযুক্তা বিরজাসুন্দরী দেবি পর্যন্ত অখুশী হন। তবে তাতে কি, নজরুল তার বাকি জীবনটা প্রমীলার হাত ধরেই পার করেছেন।  
সাহিত্য ও সংগীত চর্চায় পূর্ণতা
নজরুলের সাহিত্য বিস্ফোরণে কুমিল্লা মাটি ও মানুষের অনুপ্রেরণা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। নজরুলের কুমিল্লায় আগমনই তার সাহিত্য চর্চা বিকাশের পথ অনেকটা উন্মুক্ত করে দেয়। ১৯২১ সালের ৩ এপ্রিল নজরুল কলকাতা থেকে চট্টগ্রাম মেইলে করে আলী আকবর খাঁ’র সঙ্গে রাতে কুমিল্লা আসার সময় ট্রেনে বসে তিনি রচনা করেছিলেন ’নীলপরী’ কবিতাটি। নজরুল দৌলতপুরে ৭৩ দিন অবস্থানকালে লিখেছেন ১৬০টি গান ও ১২০টি কবিতা। এগুলো নজরুলকে প্রেমিক কবি হিসেবে পাঠক দরবারে সুপরিচিত করেছে।
কুমিল্লায় নজরুলের রচিত রচনাগুলির মধ্যে রয়েছে- পরশ পূজা, মনের মানুষ, প্রিয়ার রূপ, শায়ক বেধা পাখী, প্রলয়োল্লাস, মরণ-বরণ, বন্দীর বন্দনা, পাগলাপথিক, বিজয়গান, পূজারিনী, বিজয়িনী, নিশিত প্রতিম, চিরচেনা, মনের  মানুষ, স্তব্ধ বাদল, কবিতা- গোমতী, জাগরণী, খুকী ও কাঠবিড়ালী ইত্যাদি।

কুমিল্লায় গোমতী নদীর আনন্দময় স্মৃতিকে মধুরতম করতে নজরুল লেখেন-
“উদাস দুপুর কখন গেছে এখন বিকেল যায়, ঘুম জড়াল গোমতী নদীর ঘুমুর পরা পায়। (চৈতী হাওয়া ছায়ানট) প্রমীলাকে নিয়ে গোমতীর নদীর স্মৃতি-“ প্রথম উঠিল কাঁদি অপরূপ ব্যাথা, গন্ধ নাভি পদ্মমূলে। (পূজারীনি দোলনচাপাঁ)।


নজরুলের নামে রাস্তার নামকরণ

কুমিল্লায় এসে প্রতিবারই নজরুল ছিলেন কান্দিরপাড়ে ইন্দ্র কুমার সেন গুপ্তের বাড়িতে অর্থাৎ প্রমীলাদের বাড়িতে। কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড় থেকে ধর্মপুর অ্যাপ্রোচ রেলস্টেশন সড়কটি নজরুলের নামে নামকরণ করে রাখা হয় নজরুল এভিনিউ। ১৯৬২ সালে মরহুম আব্দুল কুদ্দুস সড়কটিকে নজরুল এভিনিউ করার প্রস্তাব দিলে তৎকালীন জেলা প্রশাসক কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ তাতে সম্মতি দেন এবং সড়কটির নামকরণ করা হয়।

নজরুল স্মৃতি কেন্দ্র
নগরীর পার্কের পাশে রাণীরকুঠি সংলগ্নস্থানে নজরুল স্মৃতি কেন্দ্র নির্মিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নজরুল স্মৃতি কেন্দ্রের উদ্বোধন করেন। গণপূর্ত বিভাগ কর্তৃক নির্মিত নজরুল স্মৃতি বিজড়িত ৬ তলা ফাউন্ডেশনের তিনতলা বিশিষ্ট স্মৃতি কেন্দ্র ভবনের কাজে ব্যয় হয়েছে সাড়ে ৭ কোটি টাকা। জানা গেছে, ৩ তলা ভবন নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা এবং আসবাবপত্র ও জমি অধিগ্রহণে ব্যয় হয়েছে ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা। ৩ তলার ভবনটিতে ক্লাস রুম, ১৩২ আসনের সেমিনার হল, নজরুল আর্কাইভ, গেস্ট রুম ও পাঠাগার রয়েছে।
জাতীয় পর্যায়ে নজরুল জন্মবাষির্কী পালন
দীর্ঘ ২৩ বছর পর গত বছর কুমিল্লার নজরুল প্রেমীদের দাবি অবশেষে পূরণ হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুমিল্লায় তিনদিন অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন। এর আগে ১৯৯২ সালে প্রথম কুমিল্লায় জাতীয়ভাবে নজরুল ইসলামের জন্মবাষির্কী একবার পালন করা হয়েছিল।
নজরুলের প্রেম-বিবাহ-বিরহ, সাহিত্য ও সংগ্রামের চেতনার স্বর্ণযুগটি কুমিল্লায় পার করেছেন দ্রোহের এই কবি। কুমিল্লার প্রাকৃতিক পরিবেশ ও মানুষের ভালোবাসায় নজরুল জীবনে পেয়েছেন পরিপূর্ণতা। আজও কুমিল্লার মাটি নজরুলের অসংখ্য স্মৃতি আঁকড়ে ধরে আছে স্বযতনে।

- ইমতিয়াজ আহমেদ জিতু

সুত্রঃ বিডিনিউজ২৪

শেয়ার করুনঃ

Author:

কুমিল্লা অঞ্চলটি একসময় প্রাচীন সমতট অঞ্চলের অধীনে ছিল। পরবর্তীকালে এটি ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে যোগ দেয়। খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে কুমিল্লা জেলা হরিকেল অঞ্চলের রাজাদের অধীনে আসে। অষ্টম শতাব্দীতে লালমাই ময়নামতি দেব বংশ এবং দশম থেকে একাদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চন্দ্র বংশের শাসনাধীনে ছিল। ১৭৬৫ সালে এ অঞ্চলটি ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে আসে। ১৭৯০ সালে জেলাটি ত্রিপুরা জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬০ সালে এর নাম পরিবর্তন করে কুমিল্লা রাখা হয়। ১৯৮৪ সালে কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা পৃথক জেলায় পরিণত হয়।

0 facebook: