গাজীউল হক: চট্টগ্রাম বিভাগকে ভেঙে কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চল নিয়ে পৃথক বিভাগ করা যায় কি না, এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গত ২৬ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে নির্দেশনা দেন। প্রধানমন্ত্রীর ওই মনোভাবের কথা জানার পর কুমিল্লাজুড়ে আনন্দ মিছিল হয়। দীর্ঘদিনের দাবির কথা প্রধানমন্ত্রীর মুখে ফুটে ওঠায় সমতট অঞ্চলের (প্রাচীনকালে কুমিল্লা ও নোয়াখালী অঞ্চলকে সমতট নামে ডাকা হতো) বাসিন্দারা মহা খুশি। শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির পাদপীঠ ও ইতিহাস-ঐতিহ্যের জেলা শহর কুমিল্লা। এটি ব্রিটিশ-ভারতের প্রাচীনতম শহর। আগে এর নাম ছিল ত্রিপুরা জেলা। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে কুমিল্লা টাউন হল মাঠে জনসভা হয়। ১৯৬০ সালে প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের ফলে কুমিল্লা পৃথক জেলার মর্যাদা পায়। গোমতী নদীর তীরে এ শহরের অবস্থান। একে বলা হয় পথিকৃৎ কুমিল্লা। ১৯৮৬ সালে কুমিল্লা বিভাগ বাস্তবায়ন আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তৎকালীন কুমিল্লা পৌরসভার চেয়ারম্যান ও বর্তমানে কুমিল্লা সদর আসনের সাংসদ আ ক ম বাহাউদ্দিন। ১৯৮৯ সালে বৃহত্তর কুমিল্লার কুমিল্লা, চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং বৃহত্তর নোয়াখালীর নোয়াখালী, ফেনী ও লক্ষ্মীপুরসহ ছয়টি জেলা নিয়ে কুমিল্লা বিভাগ প্রতিষ্ঠার দাবি শুরু হয়। কুমিল্লা গণফোরাম নামের একটি সামাজিক সংগঠনের ব্যানারে ওই দাবি নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়। পরে সংগঠনের নাম হয় কুমিল্লা গণদাবি পরিষদ।
বর্তমানে বৃহত্তর কুমিল্লা ও বৃহত্তর নোয়াখালীর ছয়টি জেলায় প্রায় দুই কোটি জনসংখ্যা রয়েছে। ওই ছয় জেলার আয়তন প্রায় ১৩ হাজার বর্গকিলোমিটার। যা ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত সিলেট, বরিশাল ও রংপুর বিভাগের চেয়ে জনসংখ্যা ও আয়তনের প্রায় দ্বিগুণ। কুমিল্লায় সরকারের প্রায় সব ধরনের প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে কুমিল্লায় বিভাগ হলে ঢাকা ও চট্টগ্রামের ওপর জনগণের চাপ কমবে। ঢাকা শহরে বাড়তি লোকের চাপ হবে না। সেখানে যানজটও কমে আসবে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের মধ্যবর্তী স্থানে কুমিল্লার অবস্থান। একটি পরিপূর্ণ আবাসিক জেলা হিসেবে কুমিল্লার সুনাম রয়েছে। রাজধানী ও বন্দরনগরের ওপর চাপ কমাতে এ শহর বেশ ভূমিকা রাখবে। বৃহত্তর কুমিল্লা ও নোয়াখালীর ছয় জেলার মধ্যবর্তী স্থানেও কুমিল্লার অবস্থান। ভৌগোলিক ও উন্নত যোগাযোগব্যবস্থার কারণে কুমিল্লা খুবই সমৃদ্ধ জনপদ। এ ছয় জেলার মানুষের সঙ্গে সড়ক, রেল ও নদীপথে যোগাযোগ অত্যন্ত মসৃণ। দাপ্তরিক বেশির ভাগ কাজেই ছয় জেলার মানুষ কুমিল্লায় জড়ো হন। এখানে দিনে এসে দিনে কাজ করে বাড়ি ফিরে যাওয়া সম্ভব। ছয় জেলার মানুষের আঞ্চলিক ভাষাও কাছাকাছি।
গত ১২ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে ময়মনসিংহকে বিভাগ ঘোষণার সিদ্ধান্ত হয়। সর্বশেষ গত বুধবার মহান জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুমিল্লা, ময়মনসিংহ ও ফরিদপুর নিয়ে তিনটি নতুন বিভাগ করার পক্ষে তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন করেন। বৃহত্তর এই তিনটি জেলার মধ্যে কুমিল্লা সবকিছুতেই অগ্রসরমাণ। কুমিল্লায় সিটি করপোরেশন ও শিক্ষা বোর্ডসহ সরকারের অনেকগুলো দপ্তরের বিভাগীয় কার্যালয় এখানে বিদ্যমান রয়েছে। কুমিল্লায় সরকার আইটি ভিলেজ করার উদ্যোগ নিয়েছে। এখানে রয়েছে মনোলোভা নৈসর্গিক লালমাই ও ময়নামতি পাহাড়। ভারতীয় সীমান্তবর্তী কুমিল্লার রাজেশপুরে রয়েছে ইকোপার্ক। শহরের মধ্যে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী ধর্মসাগর। কুমিল্লাজুড়ে রয়েছে প্রাচীন সভ্যতার নানা নিদর্শন।
একদা ব্যাংক ও ট্যাংকের শহর হিসেবে কুমিল্লার খ্যাতি ছিল। কুমিল্লার খাদি, তাঁতশিল্প, কুটিরশিল্প, বিজয়পুরের মৃৎশিল্প, মাতৃভান্ডারের রসমালাই ও ময়নামতির শীতলপাটি পৃথিবীজুড়ে খ্যাতি অর্জন করেছে। কুমিল্লা ইপিজেড, কুমিল্লার বিবিরবাজার স্থলবন্দর, কৃষিক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নয়ন, দিদার সমবায় সমিতি, দাউদকান্দির প্লাবনভূমিতে মৎস্য চাষ এখানকার অর্থনৈতিক উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখে আসছে।
কুমিল্লায় রয়েছে অষ্টম শতকে নির্মিত কোটবাড়ীর শালবন বৌদ্ধবিহারসহ প্রায় অর্ধশতাধিক প্রত্নসম্পদ। রয়েছে ময়নামতি জাদুঘর। এখানকার কোটবাড়ীতে রয়েছে ড. আখতার হামিদ খানের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পল্লি উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড), ব্রিটিশ আমলের কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাস, কুমিল্লা বিমানবন্দর, সুদীর্ঘ রেললাইন। এ শহরের আলো-বাতাসে নিঃশ্বাস নিয়েছেন নারী জাগরণের অগ্রদূত নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী, উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ শচীন দেববর্মন, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, ভাষাসৈনিক শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও বাংলাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা করার অন্যতম সহযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম। এখানে এসেছেন অহিংসার বাণী নিয়ে মহাত্মা গান্ধী। এসেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রয়েছে শতবর্ষের ঐতিহ্যে লালিত দেশের একমাত্র সার্ভে প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সার্ভে ইনস্টিটিউট।
আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, বর্তমান সরকার সামাজিক সম্প্রীতির এক অনুকরণীয় জনপদ এই কুমিল্লায় বিভাগ বাস্তবায়ন করবে। এর মধ্য দিয়ে কুমিল্লাবাসীর সর্বশেষ স্বপ্ন পূরণ হবে।
গাজীউল হক: প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক, কুমিল্লা।
gajiulhoqsohag@gmail.com
0 facebook: