তিনি
একজন স্বভাব আঁকিয়ে ছাত্রনেতা ছিলেন। ১৯৭০ সালের ৬
জুন বাংলাদেশ প্রকৌশল
বিশ্ববিদ্যালয়ের শেরে বাংলা হলের ৪০১ নং (উত্তর) কক্ষে রাত এগারটার পর
পুরো পতাকার ডিজাইন সম্পন্ন করেন। এ পতাকাই
পরবর্তীতে ১৯৭১ এর ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় উত্তোলিত হয় ।
শিবনারায়ণ
দাসর পিতা সতীশচন্দ্র দাশ। তিনি
কুমিল্লাতে আয়ূর্বেদ চিকিৎসা করতেন। ১৯৭১ সালে
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাক হানাদাররা তাকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। শিবনারায়ন দাশের স্ত্রীর নাম গীতশ্রী চৌধুরী এবং এক সন্তান অর্ণব
আদিত্য দাশ।
শিবনারায়ণ
দাস প্রথম ভাষা সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের হাত ধরে রাজনীতিতে আসেন। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন অংশগ্রহণ করে কারাবরণ করেন ।
পতাকা
ডিজাইনের প্রেক্ষাপট :
১৯৭০ সালের ৭ জুন তৎকালীন পূর্ব
পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত ছাত্রদের এক সামরিক
কুচকাওয়াজে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অংশ গ্রহণের কথা ছিল। এই লক্ষ্যে ছাত্রদের নিয়ে একটি জয়বাংলা বাহিনী গঠন করা হয়। ছাত্র নেতারা এই বাহিনীর একটি পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত
নেয়।
এই
লক্ষ্যে ১৯৭০ সালের ৬ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের (তৎকালীন
ইকবাল হল) ১১৬ নং কক্ষে ছাত্রলীগ নেতা আ স ম আবদুর রব, শাহজাহান
সিরাজ, কাজী
আরেফ আহমদ, মার্শাল
মনিরুল ইসলাম পতাকার পরিকল্পনা নিয়ে বৈঠকে বসেন। এ
বৈঠকে আরো উপস্থিত ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা স্বপন কুমার চৌধুরী,
জগন্নাথ
কলেজের ছাত্রলীগ নেতা নজরুল ইসলাম, কুমিল্লা জেলা ছাত্রলীগের
সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতা শিবনারায়ন দাশ, প্রকৌশল
বিশ্ববিদ্যালয়
ছাত্রলীগ সাধারণ সাধারণ সম্পাদক হাসানুল হক ইনু ও ছাত্রনেতা ইউসুফ সালাউদ্দিন।
সভায়
কাজী আরেফের প্রাথমিক প্রস্তাবনার উপর ভিত্তি করে সবার আলোচনার শেষে সবুজ
জমিনের উপর লাল সূর্যের মাঝে হলুদ রঙের বাংলার মানচিত্র খচিত পতাকা তৈরির
সিদ্ধান্ত হয়। এরপর প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শেরে
বাংলা হলের ৪০১
নং কক্ষে রাত এগারটার পর শিবনারায়ন দাস পুরো পতাকা ডিজাইন সম্পন্ন করেন।
সেই
রাতেই নিউমার্কেট এলাকার বলাকা বিল্ডিংয়ের ৩ তলার ছাত্রলীগ অফিসের পাশে নিউ পাক
ফ্যাশন টেইলার্সের টেইলার্স মাস্টার খালেক মোহাম্মদী পতাকার নকশা বুঝে
কাজ শুরু করেন। তারা ভোরের মধ্যেই কয়েকটি পতাকা তৈরি
করে দেন।
পতাকা
উত্তোলন :
৭ জুন ১৯৭০ এ অনুষ্ঠিত কুচকাওয়াজের নেতৃত্ব
প্রদান করেন আ স ম আবদুর রব। অল্প পেছনে
পতাকা হাতে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন হাসানুল হক ইনু। রব
সেই পতাকা বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দেন এবং শেখ মুজিবুর রহমান সেই পতাকা ছাত্র-জনতার
সামনে তুলে ধরেন। এরপর ইনু পতাকাটি তার
কক্ষে নিয়ে যান এবং সহপাঠি শরীফ নুরুল আম্বিয়া শেরে বাংলা হলের ৪০৪ কক্ষের
খবিরুজ্জামানকে পতাকাটি বাক্সে লুকিয়ে রাখতে বলেন। এরপর
একাত্তরের
শুরুতে নগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ জাহিদ হোসেন পতাকাটি নিয়ে যান
তার মালিবাগের বাসায।
১৯৭১
এর ২ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত হবার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
বটতলায় এক বিশাল সমাবেশ হয়। এ সমাবেশে আ
স ম আবদুর রব যখন
বক্তৃতা করছিলেন, তখন নগর ছাত্রলীগ নেতা শেখ জাহিদ হোসেন একটি বাঁশের মাথায় পতাকা
বেঁধে রোকেয়া হলের দিক থেকে মঞ্চস্থলে মিছিল নিয়ে এগিয়ে আসেন। রব তখন সেই পতাকা তুলে ধরেন।
১৯৭১
সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে
পাকিস্তানের জাতীয় পতাকার পরিবর্তে শিবনারায়ন দাশের নকশা করা বাংলাদেশের
পতাকা উত্তোলন করা হয়।
১৯৭২
সালে শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার শিবনারায়ন দাশের ডিজাইন কৃত পতাকার মাঝে
মানচিত্রটি বাদ দিয়ে পতাকার মাপ, রঙ, ও তার ব্যাখ্যা সম্বলিত একটি
প্রতিবেদন দিতে বলে পটূয়া কামরুল হাসানকে। কামরুল হাসান
দ্বারা পরিমার্জিত
রূপটিই বর্তমানে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা।
ইতিহাস
কথা বলে : সে এক অদ্ভুত সময়ের গল্প।বাতাসে
তখন ঘনীভূত
শ্লোগানের বুদবুদ,পিচপথে মিছিলের ক্যারাভান।ক্লাস
ফাঁকি দেওয়া ছাত্রের
চোখে আঁকিবুকি কেটে যায় এক দুর্বিনীত রোমান্টিসিজম – স্বাধিকার।সেই প্রমত্ত সময়-স্রোতে সওয়ার একজন দুরন্ত তরুন এক ঘুটঘুটে রাতে
বসে এঁকে ফেললেন
মহাকালের শ্রেষ্ঠতম ফ্রেসকো।পশ্চাদপটে
তার তুমুল সবুজের আঁচল,বুকে রক্তবৃত্ত।তার মাঝে
জ্বলে আছে এক খাবলা গনগনে সোনালী আগুন।রঙের এমন
অগ্নিগর্ভ
সংমিশ্রণ,সাথে
অহংকার আর প্রতিজ্ঞার সর্বগ্রাসী আবহ – পৃথিবীতে কোনদিন
কল্পনা করেনি কেউ।ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সেই চিত্রকর্মের
কারিগরের নাম শিবনারায়ন
দাশ,আমাদের
ভুলে যাওয়া কালপুরুষ।
৭০ এর
৬ জুন,ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের ( বর্তমান জহুরুল হক হল ) ১১৮ নম্বর
রুমে জড়ো হয়েছেন আ স ম আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ, মার্শাল মনি,
কাজী
আরেফ আহমদ,শিবনারায়ন
দাশ,স্বপন
কুমার চৌধুরী,হাসানুল
হক ইনু,ইউসুফ
সালাউদ্দিন…আরো অনেকে।পরদিন রেসকোর্স ময়দানে আসবেন বঙ্গবন্ধু।মহাকালের
মহানায়ককে
গার্ড অব অনার দেয়া হবে – এই নিয়ে প্রস্তুতি পরিকল্পনা জয়বাংলা বাহিনীর।উপস্থিত সভ্যগন ঠিক করলেন একটি পতাকা ওড়ানো হবে।সেই পতাকায় মাখানো থাকবে সংগ্রামের প্রত্যয়,স্বাধীনতার
জন্য বুভুক্ষা।আলোচনা শুরু হল।শেষ
পর্যন্ত
পতাকার মূল পরিকল্পনা খসড়া করা হলো – সবুজ জমিনের উপরে একটা টকটকে রক্তাভ বৃত্ত,এর মাঝে
বাংলাদেশের মানচিত্র।জানা গেল আঁকাআঁকিতে দারুন হাত কুমিল্লা
ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শিবনারায়ন দাশের।সেই রাতেই
বুয়েটের শেরে
বাংলা হলের ৪০১ নম্বর রুমে বসে রং-তুলির ছোপে-আঁচড়ে শিবনারায়ন দাশ এঁকে ফেললেন
পতাকার চূড়ান্ত ডিজাইন।ভোরের মধ্যেই নিউমার্কেটের নিউ পাক
ফ্যাশন
টেইলার্সের মাস্টার মালেক মোহাম্মদী সুঁই-সুতোয় বুনে দিলেন লাল-সবুজ-সোনালী
বাংলাদেশের পতাকা – উদ্ধত অহংকারের বিমূর্ত প্রতিকৃতি।
পরদিন
রেসকোর্সে উড়লো এই পতাকা।বঙ্গবন্ধুর
হাতে পতাকা তুলে দিলেন আ স ম আব্দুর রব।এর আগে পতাকা
নিয়ে ঢাকা শহর প্রদক্ষিণ করে জয় বাংলা বাহিনী।১৯৭১
এর ১ মার্চ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলার সমাবেশে ( জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত হবার
পর ) আবারো উড়েছিল এই পতাকাটিই।
মিছিলের
পুরনো মুখ শিবনারায়ন দাস,রাজপথের সহযোদ্ধাদের প্রিয় শিবু দা।জেল
খেটেছেন
৬২ শিক্ষা আন্দোলনে,আসামী হয়েছেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় ( ৩৫ জনের মধ্যে ১৭
তম ),কুমিল্লা
ভিক্টোরিয়া কলেজে আইয়ুব খানের ছবি পায়ে দলে মাথায় নিয়েছেন হুলিয়া।শিবনারায়ন দাশকে খুজতে গিয়েই কুমিল্লায় হানা দেয় পাকিস্তান
সেনাবাহিনী,৭১
এর ২৫ মার্চ।না পেয়ে ধরে নিয়ে যায় তার আয়ুর্বেদিক
চিকিৎসক
বাবা সতীশচন্দ্র দাশকে,হত্যা করা নৃশংসভাবে,সে রাতেই।মাইকিং
করে শিবনারায়নের
মাথার দাম ঘোষণা করা হয় দশ হাজার টাকা।
স্মৃতিচারণে
শিবনারায়ন বলেন,
যারা
স্বাধীনতার সংগঠক ছিলেন, যারা স্বাধীনতার প্রত্যাশায় উজ্জীবিত ছিলেন, যারা সংগঠন
তৈরি করেছেন, যারা
গোপনে কাজ করেছেন নিজের জীবনকে বাজি রেখে, মূলত সেই সংগঠক, সংগঠন ও সেই
নেতারাই পতাকা তৈরির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, সে সময়ে আমার ওপর দায়িত্ব অর্পিত
হয়েছিল পতাকা তৈরি করার। আমি
পরিকল্পনা মাফিক সে দায়িত্ব পালন করেছি। আমার হাতেই
পতাকা তৈরির কাজ শুরু ও শেষ হয়
মুক্তিযোদ্ধা
তালিকায় নাম নেই শিবনারায়ন দাশের,এ নিয়ে আক্ষেপও নেই তার
জাতির
কাছে আমার চাওয়ার কিছুই নেই। জাতি তার
নিজের প্রয়োজনে অনেক কিছু করে….মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়ও আমার নাম নেই। এ
নিয়েও আমার কোন আক্ষেপ নেই।
[কুমিল্লার ডাক]
0 facebook: