30 July 2016

কুমিল্লার শতবর্ষের ঐতিহ্যবাহী ‪‎মহেশাঙ্গণ‬ রক্ষা করা হউক



কুমিল্লা রিপোর্ট২৪ ডেস্কঃ ‘মহেশাঙ্গণ’ কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্রে সেবামূলক একটি প্রতিষ্ঠান। দানবীর ও সফল ব্যবসায়ী শ্রী মহেশচন্দ্র ভট্টাচার্য্য সম্পূর্ন নিজস্ব দান ও অর্থায়নে বৃহৎ এই মহেশাঙ্গণ কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডের বিপরীতে প্রতিষ্ঠা করেন। বিদ্যাসাগর রাসমোহন চক্রবর্তী মহেশাঙ্গণ প্রতিষ্ঠায় সার্বক্ষনিক সরাসরি তত্ত্বাবধান ও পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখেন। সাধারণ, অসহায় ও দরিদ্রদের কল্যাণে শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে সেবাব্রতের মহৎ উদ্যোগ ‘মহেশাঙ্গণ’ দৃষ্টান্ত হিসেবে এক উজ্জল নিদর্শন। কুমিল্লার মহেশাঙ্গন সমগ্র উপমহাদেশে একটি ব্যতিক্রম ইতিহাস। কুমিল্লার মহামূল্যবান সাংস্কৃতিক সম্পদ এবং ঐতিহ্য। স্বাধীনতা পূর্ব সময়ে এটাই ছিল পূর্ববঙ্গের শান্তিনিকেতন। যার নাম এখন কুমিল্লা শহরেই বিস্মৃতপ্রায়, সারাদেশের মানুষ জানে না বললেই চলে। মোট ৮ একর জমির ওপর এই প্রতিষ্ঠানটি অবস্থিত। যার আনুমানিক বাজারমূল্য ১০০০ কোটি টাকা।
মহেশ চ্যারিটেবল ট্টাস্টের অধীন পরিচালিত মহেশাঙ্গণের রয়েছে আটটি সহযোগি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠান সমূহ- ঈশ্বর পাঠশালা বিদ্যালয়, নিবেদিতা প্রাথমিক বিদ্যালয়, নিবেদিতা ছাত্রীনিবাস, রামমালা ছাত্রাবাস, রামমালা গ্রন্থাগার, কুমিল্লা সংস্কৃত কলেজ, মেসার্স এম ভট্টাচার্য্য এন্ড কোং, বৈদিক ঔষধালয় এবং মন্দির, ডাকঘর ও ব্যয়ামাগার ইত্যাদি কার্যক্রমের মাধ্যমে বিগত প্রায় ১০০ বছর যাবৎ সেবা প্রদান করে আসছে। উদ্যোগটি এমনভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যে, ট্টাস্টের সম্পদের আয় থেকে এই প্রতিষ্ঠানগুলির ব্যয় নির্বাহ করা হবে। ট্টাস্ট কখনও দান, চাঁদা কিংবা অনুদান গ্রহণ করে না।


১৯৫০ সালে শাকতলা থেকে শিক্ষাবোর্ডের সামনে মহেশাঙ্গনে রামমালা গ্রন্থাগারটি স্থানান্তর করা হয়। রামমালা গ্রন্থাগারে তিনটি বিভাগ।
১) গবেষণা বিভাগ ২) সাধারণ বিভাগ ৩) হস্তলিখিত প্রাচীন পুঁথি বিভাগ। 
গবেষণা বিভাগে ভারতীয়, সংস্কৃতি, বেদ, ধর্মসহ বিভিন্ন সাহিত্যকর্ম সংরক্ষিত আছে। সাধারণ বিভাগে রয়েছে দেশি-বিদেশি পত্র-পত্রিকা ও বিভিন্ন গ্রন্থ। পুঁথি বিভাগে হাতে লেখা প্রাচীন সংস্কৃত ও বাংলা পুঁথি সংরক্ষিত রয়েছে। যার সংখ্যা প্রায় আট হাজার। তারমধ্যে দুই হাজার তালপাতায় লেখা। বাকিগুলো কাঠ, কলাপাতা ও এক ধরনের কাগজে লেখা। পুঁথি বিভাগে ৩ থেকে ৪শ’ বছর আগের সংস্কৃত ভাষার পুঁথিও রয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এসব পুঁথি সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠার সময় থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত ২৭জন ব্যক্তি এ গ্রন্থাগারে পুঁথি দান করেছেন। তাদের নামও রয়েছে গ্রন্থাগারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে এক চুক্তিতে রামমালা পুঁথি বিভাগের আড়াই হাজার পুঁথি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইক্রোফিল্ম করে রাখা আছে। দেশ-বিদেশের বহু গবেষক রামমালা পুঁথি বিভাগে আসেন গবেষণার জন্য। অবশ্য এখন গবেষণার জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হয়।



ভারতীয় উপমহাদেশে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ক্ষেত্রে যাঁরা আলোড়ন তুলেছেন এবং পরিবর্তনের ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন তাঁদের অধিকাংশই মহেশাঙ্গনে পদার্পণ করেছেন, সভা করেছেন তাঁরা হলেন, এ. রসুল, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, নৃপেন বসু, বিপিন পাল, মহাত্মা গান্ধী, চিত্তরঞ্জন দাশ, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সিসি রায়, সুভাষচন্দ্র বসু, অরবিন্দ ঘোষ, কস্তুরীবাই গান্ধী, মৌলভী লিয়াকত হোসেন, রাজা গোপাল আচারিয়া, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, ড.দীনেশচন্দ্র সেন, সরলাদেবী চৌধুরানী, নরেন্দ্রনাথ দেব, ড.নলিনী ভট্টশালী, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র বসু, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম, ক্ষিতিমোহন সেন, কালীমোহন ঘোষ, মহারাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী, আশ্রাফ উদ্দিন চৌধুরী, ত্রিপুরার মহারাজা মাণিক্য বাহাদুর, সরোজিনী নাইডু, হেমপ্রভা মজুমদার, মহেন্দ্রনাথ দাস, ভীম ভবানী, রাম মূর্তি, এ.ভি. থাক্কার, প্রাণগোপাল গোস্বামী, রামদাস বাবাজী, ভোলানাথ গিরি, আলোক বাবা, মা আনন্দময়ী, শ্রীমং পুরুষোত্তমানন্দ অবধূত, শশিভূষণ বিদ্যালঙ্কার, শ্রীমৎ সমাধিপ্রসাদ আরণ্য, শ্রীমৎ মহানামব্রত ব্রহ্মচারী, প্যারীমোহন ভট্টাচার্য্য, ডাবলিউ. এম. ক্লার্ক, বিধূশেখর শাস্ত্রী, ড.নীহাররঞ্জন রায়, ড.ধীরেন্দ্রনাথ সেন, ড.সুধীর সেন, স্বামী প্রাণবানন্দ, সীমান্ত গান্ধী আবদুল গাফফার খান, আইসিএস আলী ব্রাদার্স, মেজর এ.সি. চ্যাটার্জী, আচার্য এ.বি.কৃপালনি, সুচেতা কৃপালনি, মেঘনাদ সাহা, আনন্দশঙ্কর রায়, হুমায়ুন কবির প্রমুখ। এই মহেশাঙ্গনে স্বদেশী যুগের সম্মেলন, নিখিল বঙ্গ আইনজীবী সম্মেলন, অল বেঙ্গল পেট্রোল কনফারেন্স, অল বেঙ্গল পোস্টার কনফারেন্স, অল বেঙ্গল টিচার্স কনফারেন্স, ওলেমা কনফারেন্সসহ সর্ববিধ নিখিল বঙ্গ সম্মেলনের আদর্শ স্থান হিসেবে পরিচিত ছিল। তাছাড়া সেইসময় ভাগবৎ গীতাপাঠ, মিলাদ মাহফিল, ইসলামিক ওয়াজ মাহফিল, মুকুন্দ দাশের যাত্রাগান, রামকমল ভট্টাচার্য্যরে কীর্তন, বৈষ্ণব সম্মেলন এখানে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেইসময় মহেশাঙ্গনের সঙ্গে একাত্মতা স্থাপন করেছিলেন বৃহত্তর কুমিল্লার বিশিষ্ট প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ, তাঁরা হলেন, জাতীয় তথা কংগ্রেস নেতা অখিলচন্দ্র দত্ত, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, এ. রসুল, মথুরামোহন দেব, কৈলাশচন্দ্র দত্ত, রায়বাহাদুর ভূধর দাশগুপ্ত, কামিনীকুমার দত্ত, রায়বাহাদুর অনঙ্গমোহন নাহা, বিশ্বেশ্বর চট্টোপাধ্যায়, প্রতুল দাশ ভৌমিক, গোবিন্দ সাহা, রাখাল রায়, অতীন্দ্রমোহন রায়, যতীন ভদ্র, অক্ষয় পাল, অতীন্দ্রমোহন ভদ্র, অধ্যক্ষ রেজাউর রহমান (কুমিল্লার প্রথম ল কলেজ), মজিবুর রহমান, ডাঃ সুলতান আহম্মদ, আশ্রাফ উদ্দিন চৌধুরী, ভুবন ধর, হাবিবুর রহমান, সুরেশ সিংহ রায়, প্রকাশ সিংহ রায় (ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ভাতৃদ্বয়), বসন্ত মজুমদার, গুরুদয়াল সিংহ, ঊর্মিলা সিংহ প্রমুখ।


বিগত কিছু সময় হতে মহেশ চ্যারিটেবল ট্টাস্ট পরিচালনায় মারাত্মক বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে। এর নেপথ্যে কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহল উদ্যেশ্যমূলক অপপ্রচার, অনৈতিক ও জালিয়াতির মাধ্যমে মিথ্যা আশ্রয় নিয়ে মহেশাঙ্গণের মারাত্মক ক্ষতিসাধন ও সুনাম ক্ষুন্ন করছেন। নিবেদিতা ছাত্রীনিবাস এবং রামমালা ছাত্রাবাসও বন্ধের পায়তারা চলছে। এছাড়াও উদ্দেশ্যপ্রনোদিতভাবে এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেওয়ার ও সম্পদ হরণ করার দূরভিসন্ধি প্রচেষ্টা প্রতিয়মান হচ্ছে।
উল্লেখ্য মহেশ চ্যারিটেবল ট্টাস্ট নিয়ে উদ্ভুত সমস্যা, অনিয়ম, চুরি, আত্মসাৎ কিংবা সম্পদ হরণের জন্য মারাত্মক ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করতে সরকার, কর্তৃপক্ষ, প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্রছাত্রী এবং কুমিল্লাবাসীসহ সকলের সুদৃষ্টি ও যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে মহেশাঙ্গণকে রক্ষা করার জন্য বিশেষ অনুরোধ করছি।
আমরা চাই অমুল্য মহেশাঙ্গণের সময়োপযোগি পরিচালনা, উন্নয়ণ ও সফল স্বার্থকতা। রক্ষিত ও অটুট থাকুক ব্যতিক্রম এই মহতি উদ্যোগ- ‘মহেশাঙ্গণ’।

শেয়ার করুনঃ

Author:

কুমিল্লা অঞ্চলটি একসময় প্রাচীন সমতট অঞ্চলের অধীনে ছিল। পরবর্তীকালে এটি ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে যোগ দেয়। খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে কুমিল্লা জেলা হরিকেল অঞ্চলের রাজাদের অধীনে আসে। অষ্টম শতাব্দীতে লালমাই ময়নামতি দেব বংশ এবং দশম থেকে একাদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চন্দ্র বংশের শাসনাধীনে ছিল। ১৭৬৫ সালে এ অঞ্চলটি ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে আসে। ১৭৯০ সালে জেলাটি ত্রিপুরা জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬০ সালে এর নাম পরিবর্তন করে কুমিল্লা রাখা হয়। ১৯৮৪ সালে কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা পৃথক জেলায় পরিণত হয়।

0 facebook: