সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীঃ কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারী কলেজের সন্মান বিভাগের ছাত্রী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনু। ময়নামতি সেনানিবাস এলাকার অভ্যন্তরে বসবাস করা ইয়ার হোসেন নামের সামান্য বেতনে চাকুরী করা এক সাধারন কর্মচারীর কন্যা। ছোট থেকেই সে বেড়ে উঠেছিল সেনানিবাসের অভ্যন্তরের এক বাসায়। আর এবাসা থেকেই তার কলেজসহ বিভিন্ন সংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ।
প্রতিদিনের মত এবছরের গত ২০ মার্চ বিকেলে বাসা থেকে বের হয়েছিল পাশ্ববর্তী এলাকায় প্রাইভেট পড়াতে। দীর্ঘ সময়েও না ফেরায় প্রথমে তার সাথে থাকা মোবাইলে যোগাযোগের ব্যর্থ চেষ্টা অতঃপর বাসার অদূরে একটি ঝোপের ভিতর থেকে ওই রাত সাড়ে ১০ টায় উদ্ধার হয় তনু’র রক্তাক্ত লাশ।
তারপর কুমিল্লা ছাড়িয়ে সারা দেশব্যাপী এই হত্যাকান্ডের বিচার সহ অপরাধীদের গ্রেফতারের দাবীতে আন্দোলন, বিক্ষোভ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট, মহাসড়ক অবরোধ আরো কতোকি।
পরিবারের পাশাপাশি সাধারন মানুষ থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবি, মন্ত্রী কেউই বাদ যায়নি তনু হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেফতার করে বিচারের কাঠ গড়ায় দাড় করানোর দাবী থেকে।
অনেকে সময়ও বেঁধে দিয়েছিলেন হত্যাকান্ডে জড়িতদের গ্রেফতারে। কিন্তু প্রায় ৩ মাস সময় হতে চললো তনু নামের একজন কলেজ ছাত্রী ও নাট্যকর্মী যে নিহত হলো বা তার লাশ সেনানিবাসের অভ্যন্তরে কালো পানির ট্যাংক সংলগ্ন এলাকার একটি ঝোঁপের ভিতর থেকে উদ্ধার হলো তার একটির স্বীকৃতি পেলেও অরেকটির স্বীকৃতি এখনো পায়নি তনু’র পরিবার তথা দেশবাসী। না পাওয়া স্বীকৃতিটি হলো, সোহাগী জাহান তনু’র মৃত্যুর কারণ!
রাষ্ট্র বা সমাজের মানুষ আমরা। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে, কারণে অকারণে আমাদের কোন না কোন দায়িত্বশীল কারো কাছে যেতে হয়। ভবিষ্যতেও যেতে হবে। তেমনিভাবে একটি হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটলে সেখানে প্রথমতঃ পুলিশের ভূমিকা, দ্বিতীয়তঃ চিকিৎসক এরপর সেই পুলিশই আবার বিষয়টির বিচার বিশ্লেষন করে হত্যাকান্ডের প্রকৃত কারণ উদঘাটন করেন।
কিন্তু কি এক অজ্ঞাত কারনে শুরু থেকেই মনে হয় তনু’র হত্যাকান্ডটি নিয়ে একটা অতি সতর্কতা দেখানোর প্রক্রিয়া না একে অন্যের উপর দোষ চাপাতে ব্যস্ত হওয়ার চেষ্টায় কিনা কোন ধারাবাহিকতা ছাড়াই লক্ষ্যহীনভাবে চলছে এর তদন্ত কাজ।
একথাটি এজন্য বলা, সোহাগী জাহান তনু’র মৃত্যু হয়েছে। ২১ মার্চ খুব সকালে যখন এই হত্যাকান্ডের সংবাদটি দিতে ঘুম থেকে জেগে তুলে এক নিকটাআত্মীয়, তখন বিভিন্নভাবে ঘটনার আদ্যপান্ত জানতে চেষ্টা করি বিভিন্ন মাধ্যম থেকে।
কিন্তু ময়নামতি সেনানিবাসের অভ্যন্তরে হওয়ায় এসময় কাউকেই মুখ খুলতে দেখিনি। তবে সৌভাগ্য আমার বলতে হবে, দুপুর ১টা তনু’র বড় ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ হয় মোবাইল ফোনে। পরিচয় দিয়ে কথা বলতে শুরু করলে তিনি বলেন, রাতেই খবর পেয়েছেন, ভোরে ঢাকা থেকে ফিরে সিএমএইচ’এ গিয়ে লাশ দেখেছেন।
এসময় তিনি আরো বলেন, তিনি তার বাবা ইয়ার হোসেনের কাছে শুনেছেন, নিহত তনু’র নাকের পাশে থেতলানো, রক্ত, মাথার পিছনে আঘাতের চিহ্ন সহ চুল ছিল এলোমেলো, গায়ের জামার কিছু অংশও ছেড়া ছিল। একটা মানুষের স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর সাধারনত প্রথমেই পুলিশের কাজ সূরতহাল রিপোর্ট।
যেখানে নিহতের ভাই সংবাদকর্মীদের কাছে বাবার রেফারেন্স দিয়ে নিহত তনু’র মুখে, মাথার পিছনে আঘাতের চিহ্ন থাকার কথা বলেছে, সেখানে পুলিশ কি দায়িত্ব পালন করলো! তারপর ময়নাতদন্ত শেষে লাশ মুরাদনগরের মীর্জাপুর গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন।
এর কয়েকদিন পর ময়নাতদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ। সেখানে উল্লেখ করা হয় নিহতের মৃত্যুর কারন জানা যায়নি। এদিকে ঘটনার এক সপ্তাহের মধ্যে পুলিশ থেকে জেলা ডিবি পুলিশ ও সর্বশেষ সিআইডি’র কাছে মামলা হস্তান্তর নিহতের পরিবারের পাশাপাশি সাধারন মানুষের মনেও আশার সঞ্চার করেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে ও সিআইডি’র ডিএনএ রিপোর্টে থাকা ধর্ষনের গদবাঁধা কাহিনী লিখে আবারো হত্যার প্রকৃত কারণ জানা সম্ভব না হওয়ার রিপোর্টে পরিবারের পাশাপাশি সারা দেশে যে নিন্দার ঝড় সেটা বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের আলোচনায় ফূঁটে উঠেছে।
পচেঁ-গলে যাওয়ার পরও ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকদের মেডিকেল বোর্ড ধর্ষনের আলামত পেলো আর সেই পচেঁ-গলে যাওয়া লাশ থেকে মৃত্যুর কারণ উদঘাটন করতে পারলোনা বিষয়টি রহস্যজনক মনে হচ্ছে। আমি যদি বলি তনু ধর্ষিত হয়েছিল, তনু অভ্যস্থ ছিল যৌন কার্যে সব কিছুই সঠিক।
কিন্তু আমি বা আমরা যে জিনিসটা গুরুত্ব দিচ্ছি সেটা হচ্ছে সোহাগী জাহান তনু নামের এক কলেজ ছাত্রী ও নাট্যকর্মী কুমিল্লা ময়নামতি সেনানিবাসের অভ্যন্তরে নিহত বা খুন হয়েছে। সে কিভাবে খুন হয়েছে, সেই হত্যাকান্ডে জড়িত কারা এবং কেন সেটা করেছে সেই রহস্য বের করা।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি আজ ঘটনার ৮৫ দিন পড়ে এসেও তদন্ত, ডিএনএ, জিজ্ঞাসাবাদ ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে ব্যস্ত তদন্তকারী দল সিআইডি। আর প্রথম ময়না তদন্ত রিপোর্টেও পর বেশ কিছু দিন চাপে থাকা দ্বিতীয় ময়না তদন্তকারী দল রোববার আবারো প্রথম ময়না তদন্তকারী চিকিৎসকের মত অনেকটা একই রকমের রিপোর্ট দিয়ে তনু’কে জানান দিলো তুমি অভ্যস্থ যৌন কাজে, শুধু মুখ ফূটে বলতে পারলাম না তুমি……….।
ক্ষমা করো তনু, আমরা সত্যিই সাদাঁকে সাঁদা বলতে পারলাম না। আমাদের ক্ষমা করে দিও। তোমার আত্মা শান্তিতে থাকুক।
লেখক : সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
সম্পাদক ও প্রকাশক
দৈনিক কুমিল্লার ডাক
সম্পাদক ও প্রকাশক
দৈনিক কুমিল্লার ডাক
0 facebook: