22 June 2016

তনুকে গাড়িতে তুলে নেয় সেনাকর্মকর্তার স্ত্রী - তনুর মা


কুমিল্লা রিপোর্ট২৪ ডেস্কঃ কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনু হত্যার ৩ মাসেরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। সাম্প্রতিক বহু হত্যাকাণ্ডের মতো এই আলোচিত হত্যার সাথে জড়িত কারো হদিস এখনো পাওয়া যায়নি। এরই মধ্যে তনুর পরিবারের কাছ থেকে জানা গেছে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য। সম্প্রতি বেশ কিছু প্রকাশিত সংবাদ ও সূত্রের মাধ্যমে পাওয়া তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ে ফোনে কথা হয় তনুর পরিবারের সাথে। কিন্তু কথা বলতে আপত্তি জানান তনুর বাবা ইয়ার হোসেন। তিনি জানান, তনুর বিষয়ে কোনো ধরণের বক্তব্য প্রদান থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তাকে! কিন্তু কারা দিলেন এ নির্দেশ?
তনুর মা আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘‘তনুর ব্যাপারে কথা বলতে আমার খুব কষ্ট হয়। আমি দুর্বল হয়ে পড়ি। তনুর বাবা কথা বলতে পারেন তাই তাকে কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে”।
সেদিন ঠিক কি হয়েছিল? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “১৭ মার্চ ভিক্টোরিয়া কলেজ থিয়েটারের সদস্যদের সঙ্গে শ্রীমঙ্গল যায় তনু। সেখান থেকে ফেরার পর ২০ মার্চ বিকেলে টিউশনির কথা বলে তনুকে সালমা আক্তার নামের এক মেয়ের মাধ্যমে ডেকে নেওয়া হয় সার্জেন্ট জাহিদের বাসায়। কুমিল্লা সেনানিবাসের অলিপুরের ১২ ইঞ্জিনিয়ার্স ব্যাটালিয়নের কোয়ার্টারে সার্জেন্ট জাহিদের মেয়েকে পড়াতো তনু। এরপর সন্ধ্যা হওয়ার পর ফিরছে না দেখে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়। তনুর ভাই সার্জেন্ট জাহিদের বাসায় খোঁজ করতে গেলে, তার (সার্জেন্ট জাহিদ) স্ত্রী হ্যাপী তাড়াহুড়ো করেই দরজা বন্ধ করে দেয়”।
এ ব্যাপারে তনুর ভাই মোঃ আনোয়ার হোসেন রুবেল বলেন, “তনুর ব্যাপারে খোঁজ করতেই সার্জেন্ট জাহিদের স্ত্রী হ্যাপী খুব ভয়ার্ত হয়ে পড়েন এবং ‘সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে ৭টা বাজতেই তনু বেরিয়ে গেছে’ এই কথা বলেই তিনি দরজা বন্ধ করে দেন। এরপর অনেক খোঁজাখুঁজি করে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে অলিপুরে পাহাড় হাউসের জঙ্গলে তনুর লাশ পাওয়া যায়”।
তনুর মা বলেন, “তদন্তে বলা হচ্ছে তনুর শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। সব মিথ্যা কথা। তনুর শরীরে অনেক আঘাত ছিল। নাকে আর মাথার পেছনে থেঁতলানো ছিল। ওর (তনু) চুল কেটে নেওয়া হয়েছে”।
তবে কেন তদন্তে রয়েছে ধোঁয়াশা? এমন কোন ক্ষমতাবানের কলকাঠির মাধ্যমে এ তদন্ত নিয়ে চলছে জঘন্য রাজনীতি? এ বিষয়ে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে কথা হলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, “আমরা অনেক কথা বলতে পারিনা তদন্ত সাপেক্ষে। তবে আমরা অনেকটাই অপরাধীর কাছাকাছি যেতে পেরেছি। আশা করছি খুব দ্রুত এর সুরাহা সম্ভব হবে”। 
তবে এ ব্যাপারে তনুর মা বলছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, “তদন্ত কি হচ্ছে তা আমরা জানিনা। আমাদের হেনস্তা করে কি পাচ্ছেন তারা? তনুর বাবাকে গাড়ি চাপা দিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু যখন আমরা জিডি করতে গেলাম, বলা হল আমরা মিথ্যে বলছি। এটা বলে আর জিডি নেওয়া হয়নি”।
এই ব্যাপারে কথা হয় কুমিল্লার বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের সাথেও। বেরিয়ে আসে আরো অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য। 
জানা গেছে, তনুকে সেদিন সার্জেন্ট জাহিদের বাসা থেকে একটি সেনাবহিনীর গাড়ি এসে তুলে নিয়ে যায়। তাছাড়া শুধু সার্জেন্ট জাহিদ ও তার স্ত্রী নয়, এ হত্যার পেছনে জড়িত রয়েছেন ১১ জন সেনা সদস্য, যারা এ মূহুর্তে ক্যান্টনমেন্টের নির্ধারিত সীমানার বাইরে এমনকি জনসমক্ষেও আসতে পারছেন না। তবে তারা কোথায় আছেন? এমন প্রশ্ন করতে সাংবাদিকরা বলেন, “আমাদের অনেকের মোবাইল রেকর্ড করা হয়েছে। আমরা অনেক কথা বলতে পারছি না”।
তাহলে কি সেনাবাহিনী তনুর পরিবারের পাশাপাশি সাংবাদিকদেরও চাপে রেখেছে? কাকে বাঁচাতে এতো প্রয়াস?
এ বিষয়ে সত্যতা জানতে চাওয়া হয় তনুর মায়ের কাছে। তিনি জানান, ঘটনার দিন প্রাইভেট পড়ানোর পর তনুকে সার্জেন্ট জাহিদের বাসা থেকে একজন সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী গাড়িতে করে নিয়ে গিয়েছিলেন। ঐ সেনা কর্মকতার স্ত্রী তনুকে পরে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার কথা বললে তনু তার মাকে ফোন করে তা জানানোর চেষ্টা করে। কিন্তু এসময় তার হাত থেকে মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়া হয়। আর সেনা কর্মকতার স্ত্রীকে ফোন করে বাসায় ডেকে এনেছিলেন সার্জেন্ট জাহিদের স্ত্রী। পরে তনুকে বাংলাবাজারের দিকে কোন সেনা কর্মকর্তার বাসায় নিয়ে অত্যাচার করে হত্যা করার পর তার লাশ টহল গাড়ি দিয়ে এনে অলিপুরে পাহাড় হাউসের জঙ্গলে এনে ফেলা হয়েছে।
তনুকে গাড়িতে তোলার সময় ধস্তাধস্তি করার বিষয়ে অনেকে দেখেছেন এমন তথ্যের সত্যতার বিষয়ে তনুর মা বলেন, “ক্যান্টনমেন্টে হাজার হাজার কোয়ার্টার আছে। একটা এত বড় মেয়েকে যে ধস্তাধস্তি করা হয়েছে তা অদৃশ্য নাকি? মানুষ কি বোঝে না? অনেকেই কথা বলতে পারেন না হুমকির কারণে”।
তনুর মা বলেন, “আমরা তো কোনো খারাপ কিছু দাবি করছি না। আমি আমার মেয়ের হত্যার বিচার চাইছি। এতে কেন এতো টালবাহানা? তনুর বাবাকেও চুপ করিয়ে দেওয়া হল। কাকে বাঁচানোর জন্য?"
তনুর ভাই রুবেল বলেন, "আমরা সবসময় আতঙ্কে আছি। আমার বোন হত্যার বিচার চাইতে গিয়ে মনে হল প্রধানমন্ত্রীর কাছে তার ক্ষমতা চাইলাম! আমার বাবাকে (ইয়ার হোসেন) হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। মনে হচ্ছে তো আমাদের সবাইকে মেরে ফেলা হবে!”
তনুর পরিবারের সদস্যরা জানান, প্রতিনিয়ত তারা দিন কাটাচ্ছেন হুমকির মুখে। কারো সাথে কথা বলতে পারেন না তারা। ঘরের ডিশ লাইন কেটে দেওয়া হয়েছে। নিয়ে যাওয়া হয়েছে তনুর সব স্মৃতি। 
তনুর মা বলেন, “আমার মেয়েকে ওরা মেরে ফেললো। এখন ঘরে ওর একটা ছবি নেই। সব নিয়ে গেছে। তনুর ডায়েরী নিয়ে গেছে। আমাদের মন থেকে তনুকে ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য যা করতে হয় তা করা হচ্ছে। ঘরে টিভির লাইন কেটে দেওয়া হয়েছে। মোবাইলে আত্মীয়স্বজনরা ফোন করলে তাদেরও হয়রানি করা হচ্ছে। মেয়ের হত্যার বিচার চাওয়া কি আমাদের অপরাধ?”
তনুর মায়ের অভিযোগের ভিত্তিতে এই বিষয়ে সার্জেন্ট জাহিদ ও তার স্ত্রী হ্যাপীর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তা আর সম্ভব হয়নি। তবে বিশ্বস্ত এক সূত্রে জানা গেছে, সার্জেন্ট জাহিদ নাকি নিখোঁজ রয়েছেন ঘটনার দিন (২০ মার্চ) রাত থেকেই। তাকে সেনাবাহিনীর গাড়িতে করেই নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কে বা কারা নিয়ে গেছেন এবং কোথায় নিয়ে গেছেন এ বিষয়ে জানা যায়নি। 
এ বিষয়ে কোনো কথাও বলতে চাননি সেনা কর্মকর্তারা। এর ফলে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে কোন ক্ষমতাবান ব্যক্তি বা ব্যক্তিদেরকে রক্ষার জন্য আড়াল করা হচ্ছে সব কিছু, দেখানো হচ্ছে ক্ষমতার শক্তি! 
এই ব্যাপারে কথা হয় সিআইডির তদন্ত সহায়ক দলের সদস্য বিশেষ পুলিশ সুপার ড. নাজমুল করিম খান এর সাথে। তিনি বলেন, “পৃথিবীতে এমন কোনো অপরাধ নেই যার বিচার হয়নি। নাৎসি বাহিনীরও বিচার হয়েছে। ৪০ বছর পর বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে। ৪৩ বছর পরেও বাংলাদেশে বিচার হচ্ছে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের। সম্প্রতি বেশ কয়েকজন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের দণ্ডও কার্যকর করা হয়েছে। তাই আমরা আশা ছাড়ছি না। আমরা যে অপরাধীর খুব কাছেই চলে গেছি তা অপরাধীরা টের পেয়েছেন। তাই অতিরিক্ত ক্ষমতাবলে তারা এর প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছেন। অতএব তারা যতোই ক্ষমতাবান হোক একদিন অবশ্যই বিচার সম্ভব হবে”।
তবে কি এই হত্যার জন্যেও ৪০-৫০ বছর অপেক্ষা করতে হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে নাজমুল করিম বলেন, "আমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছি। সেনানিবাসে গিয়ে কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এমনকি সেনা কল্যাণের যে অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল ২০ মার্চ, যা আর হয়নি সে বিষয়ে তদন্ত করেছি। কুমিল্লার শিল্পী সারওয়ার, মিউজিশিয়ান খোকন ও বাপ্পীকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে সিআইডি কার্যালয়ে। তাদের ঐ অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার কথা ছিল। জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, তারাও সেখানে যান নি। আশা করছি সবকিছু দ্রুত তদন্ত করে আমরা অপরাধীদের ধরতে পারবো"। 
অপরাধী হিসেবে তনুর মা সার্জেন্ট জাহিদ ও সিপাহী জাহিদের নাম বারবার নিয়েছেন। তবে তারাই কি মূল অপরাধী? এমন প্রশ্নের জবাবে কোনো কথা বলতে চাননি ড. নাজমুল করিম খান। এতে সন্দেহের দানা আরো প্রখর হয়ে উঠে। 
এ বিষয়ে তনুর ভাই ও মায়ের সাথে কথা বললে তারা বলেন, "সার্জেন্ট জাহিদ, তার স্ত্রী হ্যাপী এবং সিপাহী জাহিদসহ তার পরিবার সবকিছু জানে। এরাই আমার মেয়েকে হত্যা করেছে। নইলে কেন ঘটনার দিন সার্জেন্ট জাহিদের স্ত্রীর কাছে তনুর খোঁজ জানতে চাইলে তিনি ওভাবে চমকে উঠেন এবং মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেন?"
সাংবাদিকসহ জনসমক্ষে কোনো কথা বলতে নিষেধাজ্ঞার পরেও অনেক চেষ্টার পর কিছু কথা বলার সুযোগ পাওয়া যায় তনুর বাবা ইয়ার হোসেন এর সাথে। 
তনুর বাবা ইয়ার হোসেন বলেন, "আমরা মেয়ে হারিয়েছি। তনু ছিল আমাদের প্রাণ। মা-বাবা বেঁচে থাকা অবস্থায় যাদের সন্তান মারা যায় তাদের মনের অবস্থা কেমন হয় তা বুঝিয়ে বলা সম্ভব না। জীবিত মা-বাবার কাঁধে সন্তানের লাশের ভার কেউ বোঝে না। যার হারায় কেবল সেই বুঝতে পারে। আমি এখন চাইলেও কারো সাথে কথা বলতে পারি না। আমার পেছনে সবসময় গোয়েন্দা থাকে। আমার শুধু একটাই দাবি এই সরকারের কাছে, আমার মেয়ে হত্যার বিচার করা হোক"।
তিনি বলেন, "আমরা সরকারের বা কোনো বাহিনীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিইনি। তনু আমাদের সবচেয়ে হাসিখুশি মেয়ে ছিল। দেশবাসী এবং বর্তমান সরকারের কাছে আমরা চাই তনুকে হত্যা করে আমাদের সুখের ঘরটা আজ যারা গোরস্থান বানিয়েছে তাদের যথাযথ বিচার করা হোক। এমনভাবে যেন আর কোনো মা-বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ নিতে না হয়"।
সুত্রঃ bangla.jagoroniya.com

শেয়ার করুনঃ

Author:

কুমিল্লা অঞ্চলটি একসময় প্রাচীন সমতট অঞ্চলের অধীনে ছিল। পরবর্তীকালে এটি ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে যোগ দেয়। খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে কুমিল্লা জেলা হরিকেল অঞ্চলের রাজাদের অধীনে আসে। অষ্টম শতাব্দীতে লালমাই ময়নামতি দেব বংশ এবং দশম থেকে একাদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চন্দ্র বংশের শাসনাধীনে ছিল। ১৭৬৫ সালে এ অঞ্চলটি ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে আসে। ১৭৯০ সালে জেলাটি ত্রিপুরা জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬০ সালে এর নাম পরিবর্তন করে কুমিল্লা রাখা হয়। ১৯৮৪ সালে কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা পৃথক জেলায় পরিণত হয়।

0 facebook: