30 June 2016

ছাত্রীদের স্বপ্নের শিক্ষাঙ্গন কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজ


বিশেষ প্রতিবেদনঃ কুমিল্লা শহরে নারী শিক্ষা প্রসারে অভাবনীয় সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে চলেছে কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজ। অর্ধশত বছর ধরে শিক্ষা বিস্তারে এগিয়ে চলা কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজ এখন মেয়েদের স্বপ্নের শিক্ষাঙ্গন।

প্রতিবছরই বিপুল সংখ্যক ছাত্র ভর্তি হচ্ছে কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজে। রাজনীতিমুক্ত পরিবেশে কলেজের লেখাপড়ার মান নিয়ে ছাত্রী ও তাদের অভিভাবকদের কোন অভিযোগ নেই। সময়ের পরিক্রমায় আজ হাজারো ছাত্রীর স্বপ্নের শিক্ষাঙ্গনে রূপ নিয়েছে কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজ। বর্তমান অধ্যক্ষ প্রফেসর এ এসএম আবদুল ওহাবের দিক নির্দেশনায় কলেজের অতীতের সুনাম, সাফল্য ধরে রাখার লক্ষ্যে শ্রম দিচ্ছেন শিক্ষকরা। ছাত্রীরা যাতে কোচিং নির্ভর না হয়ে কাশমুখি হয় এজন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এদিকে উচ্চ মাধ্যমিকে মনোবিজ্ঞান, গার্হস্থ্য বিজ্ঞান, ভূগোল ও পরিসংখ্যানসহ চারটি নতুন বিষয় যুক্ত হয়েছে। যা কুমিল্লার অন্য কোন সরকারি কলেজে এ ৪টি বিষয় নেই। প্রফেসর এএসএম আবদুল ওহাব এ কলেজে যোগদানের পর যুগোপযোগী ওই ৪টি বিষয় উচ্চ মাধ্যমিকে চালু করেন। মনোবিজ্ঞান ও গার্হস্থ বিজ্ঞানে উচ্চমাধ্যমিক পড়াশোনা করলে পরবর্তী সময়ে এসব বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে চিকিৎসায় মনোবিজ্ঞানী ও পুষ্টিবিদ হয়ে দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। যার ফলে সচেতন অভিভাবক মহল ও মেধাবী ছাত্রীরা কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজে ভর্তি হওয়ার ব্যাপারে অধিকতর উৎসাহী।
এছাড়াও বর্তমানে কলেজে বাংলা, ইংরেজি, অর্থনীতি, ইসলামের ইতিহাস, দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজকর্ম, রসায়নবিদ্যা, পদার্থবিজ্ঞান, উদ্ভিদবিজ্ঞান, প্রাণীবিজ্ঞান, গণিতসহ ১২টি বিষয়ে অনার্স এবং সমাজকর্ম, বাংলা, দর্শন, রসায়ন, উদ্ভিদবিজ্ঞান, প্রাণীবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, গণিতসহ ৮টি বিষয়ে মাস্টার্স, বাংলা, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে প্রিলিমিনারি, পাসকোর্সসহ বিএ, বিএসএস, বিএসসি ও উচ্চ মাধ্যমিক শাখা চালু রয়েছে। ১৯৭২ সাল থেকেই এ কলেজে চালু ছিল বাংলা ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স কোর্স।
উইমেন্স কলেজ নামে পরিচিত এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি কুমিল্লা শহরের ঐতিহাসিক রাণীরদিঘি থেকে মাত্র দুইশ গজ দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে মনোহরপুর এলাকায় মনোরম পরিবেশে ৫ একবর জমির ওপর ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রায় সাড়ে সাত হাজার ছাত্রী কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজে লেখাপড়া করছে। চট্টগ্রাম বিভাগে মেয়েদের কলেজের মধ্যে ছাত্রী সংখ্যা ও বিষয়ের দিক থেকে কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজ একটি অন্যতম শিক্ষাঙ্গন। কলেজ অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষসহ শিক্ষক রয়েছেন ৬০জন। আবার অতিরিক্ত শিক্ষক রয়েছেন ১৬জন। ১৬তম বিসিএসে মেধা তালিকায় প্রথম ননী গোপাল সাহার মতো গণিতের শিক্ষকও রয়েছেন কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজে। মেধা ও যোগ্যতায় কলেজের অন্য শিক্ষকরাও কম নয়। অফিস ও অন্যান্য বিভাগে ৪০ জনের বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই কলেজটি দেশব্যাপি ব্যাপক সুনাম অর্জন করে আসছে। ১৯৯১ সালে জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ অনুষ্ঠানে সারাদেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি সনদ অর্জন করে কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজ। ঐতিহ্যবাহী এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কুমিল্লার ইতিহাস ঐতিহ্যকে যেমন লালন করছে তেমনি বিখ্যাত ব্যক্তিদেরও স্মরণে রাখছে। যা কলেজ হোষ্টেলের কক্ষগুলোর সামনে গেলেই দেখা যাবে।
কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজে হযরত আয়েশা ছিদ্দিকা (রা.) ও নওয়াব হোচ্ছাম হায়াদার নামে দুটি হোস্টেল (ছাত্রীনিবাস) রয়েছে। কুমিল্লার ইতিহাস ঐতিহ্যকে ধারণ করে হোস্টেলের বিভিন্ন কক্ষের নামকরণের মধ্যে রয়েছে সমতট, কমলাঙ্ক, রোহিতগিরি, কোটবাড়ি, মুন্সেফবাড়ি, নবাববাড়ি, আদালতপাড়া। আবার কুমিল্লার নদ-নদী ও খালের নামে রাখা হয়েছে গোমতি, সোনাইছড়ি, রোহিতা, কোদালিয়া, কাকড়ি, ডাকাতিয়া। বিখ্যাত ব্যক্তিদের মধ্যে উপমহাদেশের প্রখ্যাত গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ এবং শূন্যের আবিষ্কারক আর্য ভট্টের লিখিত গ্রন্থের নামানুসারে আর্যভাটিয়া, পদার্থ ও রসায়নে দুইবার নোবেল বিজয়ী নারী মেরিকোরির সম্মানে মেরিকোরি, বিশ্বের প্রথম মহিলা নভোচারি রাশিয়ার ভালেস্তিনা তেরেশ কোভার নামানুসারে তেরেশকোভা এবং নারী জাগরণের অগ্রদূত কুমিল্লার মহয়িসী নারী নবাব ফয়েজুন্নেসার রচিত গ্রন্থ রূপজালালের নামেও হোস্টেলে কক্ষ রয়েছে। তাছাড়া তথ্য প্রযুক্তিতে মেয়েরা যাতে আরও বেশি উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠে এজন্য একটি কক্ষের নাম দেয়া হয়েছে ডব্লিউডব্লিউডব্লিউডটকম। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি জাগিয়ে রাখতে কলেজের একটি বর্ধিত ভবনের সাতটি কক্ষের নাম দেয়া হয়েছে তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা, জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।


SSC, HSC and Other Exam Result Archive


এদিকে হযরত আয়েশা ছিদ্দিকা (রা.) ও নওয়াব হোচ্ছাম হায়দার হোস্টেল দু’টিতে প্রায় তিনশ ছাত্রীর আবাসন ব্যবস্থার বিপরীতে গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে প্রায় ৮শ ছাত্রীকে। প্রতি বছরই দূর-দূরান্তের ছাত্রী সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু আসন অপ্রতুলতার কারণে অনেকের হোস্টেলে স্থান হচ্ছে না। ছাত্রীদের আবাসন সমস্যার বিষয়টি সমাধান করা জরুরি হয়ে পড়েছে। ছাত্রীরা জানায়, ‘কলেজ থেকে প্রায় তিনশ গজ উত্তরে রানীরদিঘির পূর্বপাড়ে ফুলার নামে যে হোস্টেলটি রয়েছে এটি একসময় সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষের বাসভবন ও ছাত্রীনিবাস ছিল। বর্তমানে এটি পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। ফুলার হোস্টেলটি সংস্কার করে কলেজের অধীনে এখানে ছাত্রীদের থাকার ব্যবস্থা করা হলে আবাসন সংকট অনেকটা কমে আসবে।
ইতিমধ্যে কলেজের পরিত্যক্ত ভবনটি ভেঙ্গে বর্তমান একাডেমিক ভবনের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন ভবনের নির্মাণ কাজ চলছে। তবে ধীরগতিতে চলছে কাজ। কলেজ কর্তৃপক্ষ মনে করেছেন কাজের গতি বাড়লে দ্রুত আলোর মুখ দেখবে কলেজ অডিটরিয়াম, একাডেমিক ভবন ও শ্রেণিকক্ষ।

কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর এএসএম আবদুল ওহাব বলেন, ‘অর্ধশত বছর আগে মিটমিট করে জ্বলে থাকা জ্ঞানের প্রদীপ শিখা নিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজের। কালের পরিক্রমায় আজকের সময়ে এ কলেজ শিখাচিরন্তন রূপ নিয়ে আলোর ব্যপ্তি ছড়িয়েছে কুমিল্লা অঞ্চলে। তাই নি:সন্দেহে বলা যায় মেধা ও প্রতিভা বিকাশের এই কলেজ নিরাপদ ও রাজনৈতিক গোলযোগমুক্ত মনোরম পরিবেশে ছাত্রীদের পড়ালেখার অন্যতম প্রতিষ্ঠান। বিগত বছরগুলোতে কুমিল্লার ছাত্রীরা রাজধানীর বিভিন্ন নামিদামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার পর তাদের একটা অংশ পুনরায় ছাড়পত্র নিয়ে এসে আমাদের কলেজে ভর্তি হচ্ছে। শিক্ষক, শিক্ষার্থী সবাই কলেজের শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে আন্তরিক। শিক্ষার্থীরাও শিক্ষকদের প্রতি বেশ বিনয়ী। পড়ালেখার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে ছাত্রীরা কলেজের সম্মান বয়ে আনছে। এক প্রশ্নের জবাবে কলেজ অধ্যক্ষ বলেন, ‘হোস্টেলের আসন কম থাকায় ছাত্রীদের আবাসিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। যা আমরা উপলব্ধি করছি। নতুন হোস্টেল এবং শহরের বাইরের এলাকার ছাত্রীদের যাতায়াত সুবিধার্থে কলেজের নিজস্ব পরিবহন খুবই প্রয়োজন। আশাকরি সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিষয়গুলো খুব আন্তরিকতার সাথে সমাধান করবে। 

শেয়ার করুনঃ

Author:

কুমিল্লা অঞ্চলটি একসময় প্রাচীন সমতট অঞ্চলের অধীনে ছিল। পরবর্তীকালে এটি ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে যোগ দেয়। খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে কুমিল্লা জেলা হরিকেল অঞ্চলের রাজাদের অধীনে আসে। অষ্টম শতাব্দীতে লালমাই ময়নামতি দেব বংশ এবং দশম থেকে একাদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চন্দ্র বংশের শাসনাধীনে ছিল। ১৭৬৫ সালে এ অঞ্চলটি ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে আসে। ১৭৯০ সালে জেলাটি ত্রিপুরা জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬০ সালে এর নাম পরিবর্তন করে কুমিল্লা রাখা হয়। ১৯৮৪ সালে কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা পৃথক জেলায় পরিণত হয়।

0 facebook: