05 December 2015

কুমিল্লায় মুক্তিযুদ্ধ ও আমার শোনা কিছু বিজয়ের কথা


সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীঃ স্বাধীনতা সংগ্রাম আমাদের জাতীয় জীবনে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। দীর্ঘদিন পরাধীনতা, শাসন, শোষণ, নির্যাতনের শৃংখল মুক্তি পাওয়ার অমিয় বাসনায় ঐক্যের ঝান্ডা শক্তিশালী হতে থাকে। ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৬’র গণ অভ্যূত্থান এবং ৭০’র নির্বাচনে আমাদের স্বাধীকার আদায়ের বীজ উপ্ত হয়েছিল। যার সফল পরিসমাপ্তি ঘটে ৭১ এ বিজয় অর্জণের মাধ্যমে। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তয়ী সংগ্রামের ফসল স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানের সৈন্য বাহিনী বাংলাদেশের মানুষের উপর অতর্কিত হামলা চালাবার সময় আওয়ামীলীগ সকল স্তরের মানুষকে সংগঠিত করে জাতির কান্তিকালে দিক নির্দেশনা দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যায়। তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান মাতৃভূমিকে হানাদার মুক্ত করার জন্য মরণ পণ যুদ্ধে ঝাপিয়ে পরার জন্য দেশবাসীকে উদাত্ত আহবান জানান। স্বাধীনতার মন্ত্র মুগ্ধে সকল প্রাণ এক হয়েছিল। 

বঙ্গবন্ধুর সেদিনের মুক্তির ডাকে ৭১ এ দেশের অন্যান্য জেলার ন্যায় কুমিল্লার মানুষ সংগঠিত হয়ে সংগ্রামে ঝাপিয়ে পরে। তারপর চলে রক্তয়ী সংগ্রাম। ডিসেম্বরের ৮ তারিখ কুমিল্লা শত্র“ মুক্ত তথা স্বাধীন হয়। তবে এই ৯মাসে ঘটে যায় কুমিল্লায় ব্যাদনা বিধুর বিষাদ সিন্ধু। বুদ্ধিজীবী, শিক, ছাত্র, নারী-পুরুষ, শিশুসহ নিরস্ত্র নিরপরাধী কত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে তার সঠিক হিসাব পাওয়া যাবে বলে মনে হয়না। তবে স্বাধীনতার পর ১২টি গণ কবর খুঁড়ে এসব গন কবর থেকে ১০ হাজারের বেশি নরকঙ্কাল উদ্ধার করা হয়। সে সময়ে ১২ টি গণ কবর খনন করার পর আরো নতুন নতুন গণ কবরের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল বলে জানা যায়। গন কবরের অস্তিত্ব মুছে ফেলার জন্য পাকিস্তান সেনা বাহিনী বুলডোজার ও ব্যবহার করেছিল। এসব গণ কবরের অধিকাংশই ছিল হেলিপেড লাগোয়া দিকের নিম্নভূমিতে ব্রিগিডিয়ারের বাস ভবনের পশ্চিম অংশে। ব্রিগেড মসজিদের পশ্চিম পাশে স্কোয়াশ রুমের আশে পাশে এবং ২নম্বর কোয়ার্টারের পশ্চিম অংশে ঘটে যায় রক্তির হুলি খেলা। অগনিত লোক মারা যায়। মা বোনদের ইজ্জত লুণ্ঠিত হয়। সেই কালো দিনগুলোতে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় হাজার হাজার বাঙ্গালীর রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল। সেনাবাহিনীর বাঙ্গালী অফিসার , সৈনিক, বুদ্ধিজীবী রাজনৈতিক, শিাবিদ , শ্রমিক, কৃষক, সরকারী কর্মচারী, স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রী, গৃহবধু এমনকি মসজিদের ইমাম পর্যন্ত হানাদার পাক শকুনের হাত থেকে রা পায়নি। মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে নির্মমভাবে। নির্মম অত্যাচারের পর তাদের হত্যা করা হয়েছে। স্বাধীনতার পরপর ময়নামতি এলকার ছোট ঝোপ ঝার, ছোট টিলা অথবা সমতল ভূমির কাশবন, ডোবা বা নালার পাশে পাওয়া গেছে অসংখ্য নর কঙ্কাল। ইতস্তত বিপ্তি ভাবে এখানে সেখানে মানুষের কঙ্কাল দেখা গেছে। এই সেনানিবাসের অভ্যন্তরে কত লোককে এনে হত্যা করা হয়েছিল কত মা বোনের ইজ্জত লুণ্ঠন করেছিল এই পিচাশের দল তার সঠিক হিসেব কে দিবে। মসজিরেদ পশ্চিমে যে স্কোয়াশ রুম ছিল সেখান থেকে দুশ গজ দেিণই রয়েছে একটি গণ কবর। এই গণ কবর থেকেই পাচশ এর বেশি কঙ্কাল উদ্ধা করা হয়েছিল সে সময়। অভিজ্ঞজনদের ভাষ্য মতে বাঙ্গালী সেনা অফিসার, সৈনিক, বুদ্ধিজীবী, সাধারণ মানুষ সহ আটশতাধিক লোককে হত্যা করা হয়েছিল। সিগনাল লাইন সংলগ্ন স্থানেও একটি গণ কবর রয়েছে। এই গণকবর থেকে চশমা টুপিসহ অন্যান্য বেশ কিছু জিনিসপত্র উদ্ধার করা হয়েছিল।এখানে যেসব লাশ পাওয়া গিয়েছিল তাদের অনেককেই সনাক্ত করা সম্ভব হয়েছিল। এদের মধ্যে ব্রিগেড মসজিদের ইমাম আবদুল মান্ন্না, লে. কর্ণেল মেজর খালেক, মেজর জাহাঙ্গির, মেজর হাসিব, ক্যাপ্টেন আতাউর রহমান প্রমূখ। 

প্রবীন রাজনৈতিক ও ভাষা সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকেও এই এলাকায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। অমানুবিক নির্যাতন চালানো হয়েছিল তাদের উপর। ইতিহাস স্যা দেয় তার সমস্ত শরীর ত বিত করে টেনে হেচড়ে শাস্তি দিয়ে প্রচন্ড কষ্ট দিয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছিল। প্রত্য দর্শী রমনী শীল বলেছেন, তার সমস্ত শরীরে তুলা লাগানো ব্যান্ডেজ ছিল। তাকে সহসায় মারেননি। অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছিল ধীরেন্দ্র নাথ সহ অনেককেই। 

কুমিল্লার হত্যাযজ্ঞ চালানো হয় মুুলত ৫৩ নং গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধান লে. কর্ণেল ইয়াকুব মালকের নির্দেশে। এই সব হত্য যজ্ঞ চালানোর জন্য ইয়াকুব মালিক পুরস্কার হিসেবে বেশ বড় পদকও লাভ করেছিলেন। এই গণ হত্যাকারীর সাথে মেজর সুলতান, মেজন মোঃ ইয়াসিন খোন্দকার, ক্যাপ্টেন জাহিত জামাল, ক্যাপ্টেন ইফতেখার হায়দার শাহ, ক্যাপ্টেন নাসির মালিক, ক্যাপ্টেন আগা বোখারী এবং সুলতান ফয়েজ এক যোগে অংশ নিয়েছিল। প্রত্যক্ষদর্শী রমণী শীল বলেছেন যে মেজর মোঃ ইয়াসিন খোন্দকার নিজের হাতে বাঙ্গালী অফিসার মেজর আনোয়ারুল ইসলাম, লে. সালাউদ্দিন এবং সে. লে. আতিকুর রহমান সিরাজী সহ অসংখ্য বাঙ্গালীকে হত্যা করে। ক্যাপ্টেন ইফতেখার হায়দার শাহ এর নের্তৃত্বে কুমিল্লার পুলিশ লাইনে হামলা চালিয়ে অসংখ্যা নিরপরাধ নিরস্ত্র দেশ প্রেমিককে হত্যা করা হয়। আর ক্যাপ্টেন নাসির মালিক এর নেতৃত্বে পাক সেনারা ২৯ মার্চ রাতে কুমিল্লা শহরে হামলা চালিয়ে হাজার হাজার নারী পুরুষ ও শিশুকে হত্যা করে। 

পাক শকুনের দল এত পশু ছিল যে বাঙ্গালীদের হত্যা করে মাটি চাপা দিলেও হানাদার পাক সেনারা তাদের সাথীদেরকে যেখানে সেখানে কবর দেয়নি। তারা সযত্নে এসব লাশ সিএমএইচ এলাকায় কবরস্থ করে। নাম ঠিকানাসহ এসব কবরের অস্তিত্ব আজও পাওয়া যায়।

কুমিল্লা কোটবাড়ীর পশ্চিমে সাবেক ইপিআর ক্যাম্পের দিকে রূপবান কন্যার নামে পরিচিত স্থানে রয়েছে এক বিরাট গণকবর বধ্য ভূমি। এই স্থানটি হতে প্রথম পর্যায়ে প্রায় ১২শ এর মত নরকঙ্কাল উদ্ধার করা হয়েছে। স্বাধীনতার পর এসব স্থান থেকে যে সব নমুনা উদ্ধার করা হয়েছে সবই বেসামরিক নারী, পুরুষ, শিশুর। অনেক স্কুল কলেজের ছাত্র/ছাত্রীকেও এখানে এনে হত্যা করা হয়েছে এমন প্রমানও পাওয়া গিয়েছে।

কুমিল্লা চৌদ্দগ্রামের বেতিয়ারা গ্রামে রয়েছে গণকবর। এই কবরটিতে নয় জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শায়িত আছেন। ১১নভেম্বর পাক সেনাদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে এঁরা শহীদ হয়েছিলেন। শহীদ মুুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে স্থানটিতে তাদেরইসহ যোদ্ধারা একটি স্মৃতি সৌধ গড়ে তুলেছেন।

বরুড়া থানার পয়েল গাছার নারায়ন পুর গ্রামে রয়েছে ছয়জন মুক্তিযোদ্ধার কবর। ১৭ সেপ্টেম্বর তাঁরা সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন। গ্রামবাসীগণ তাদের একটি কবরে সমাহীত করেন। লালমাই যুদ্ধে শহীদ ৪ জন মুক্তিযোদ্ধার কবর রয়েছে বাগমাড়া দণি বাজার বিদ্যুৎ অফিসের উল্টোদিকে। মুক্তিযোদ্ধারা জাতীর শ্রেষ্ট সন্তান। তাদের আত্মদানকে সফল করা আমাদের দায়িত্ব।

শেয়ার করুনঃ

Author:

কুমিল্লা অঞ্চলটি একসময় প্রাচীন সমতট অঞ্চলের অধীনে ছিল। পরবর্তীকালে এটি ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে যোগ দেয়। খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে কুমিল্লা জেলা হরিকেল অঞ্চলের রাজাদের অধীনে আসে। অষ্টম শতাব্দীতে লালমাই ময়নামতি দেব বংশ এবং দশম থেকে একাদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চন্দ্র বংশের শাসনাধীনে ছিল। ১৭৬৫ সালে এ অঞ্চলটি ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে আসে। ১৭৯০ সালে জেলাটি ত্রিপুরা জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬০ সালে এর নাম পরিবর্তন করে কুমিল্লা রাখা হয়। ১৯৮৪ সালে কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা পৃথক জেলায় পরিণত হয়।

0 facebook: