15 November 2015

তিন কারণে কুমিল্লা বিভাগ হওয়া যুক্তিযুক্ত


আবুল কাশেম হৃদয়ঃ ভৌগলিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অবস্থানের কারনে কুমিল্লা বিভাগ হওয়া যুক্তিযুক্ত। চতুর্থ শতাব্দির স্তম্ভ লিপিতে উল্লেখ পাওয়া সমতট রাজ্যের কেন্দ্র ছিল ত্রিপুরা বা আজকের কুমিল্লা। পঞ্চম শতাব্দিতে গুপ্ত সম্রাটদের প্রত্যক্ষ শাসনাধীনে আসা কুমিল্লা অঞ্চলের মহারাজা রুদ্র দত্ত ও মহারাজা বিজয় সেন নামে দুই সামন্ত অর্থরক্ষক ও শান্তি রক্ষক ছিলেন বলে প্রমান পাওয়ায় গুপ্ত সম্রাটদের যুগ থেকে কুমিল্লার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক গুরুত্ব অপরিশীম বলে প্রতীয়মান হয়। কুমিল্লা সে সময় সুনিদ্দিষ্ট ভৌগলিক সীমারেখা দ্বারা চিহ্নিত না থাকলেও ১৭৮১ সালে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী যে প্রশাসনিক অঞ্চল কাঠামো প্রস্তুত করে তাতে কুমিল্লার ভৌগলিক সীমারেখা নির্ধারিত হয়। পার্বত্য ত্রিপুরার কুমিল্লা জেলা ও পার্শ্ববর্তী আরো কিছু এলাকাকে ত্রিপুরা রাজ্য বলে তারা অবহিত করে। বর্তমান কুমিল্লা জেলার ৪২৬ বর্গকিলোমিটার ও নোয়াখালী জেলার ১০২ বর্গকিলোমিটার এলাকা রওশনাবাদ চাকলার অন্তর্গত ছিল। কুমিল্লা জেলার উত্তর মধ্য ও দক্ষিণ অঞ্চল নিয়ে রওশনাবাদ চাকলা গঠিত হয়। রাজস্ব আদায়ের জন্য ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ১৭৬৯ সালে মিডলটোন নামে একজনকে ঢাকা প্রদেশের তত্বাবধায়ক নিয়োগ করে। কুমিল্লার জালালপুর ছিল তার অধীনে। ১৭৭৬ সালে কুমিল্লাকে কালেক্টরের অধীন করা হয়। ১৭৯০ সালে ত্রিপুরা কালেক্টরেটের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ১৯৬০ সালে ত্রিপুরার নামকরন করা হয় কুমিল্লা। এর অধীনে দুটি মহাকুমা ছিল একটি চাঁদপুর আরেকটি ব্রাহ্মণবাড়িয়া। ১৯৮৪ সালে চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে আলাদা জেলা করা হয়।
চতুর্থ শতাব্দি থেকে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অবস্থানের গুরুত্ব পাওয়া কুমিল্লায় বিভাগ হওয়ার দাবি রাখে।

১. দেশের প্রচীন চারটি পৌরসভার মধ্যে একটি কুমিল্লা। বাকি তিনটি ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ। এর মধ্যে ঢাকা, চট্টগ্রাম বিভাগ হয়েছে অনেক আগেই। ময়মনসিংহ বিভাগও ঘোষণা করা হয়েছে। প্রাচীন শহর কুমিল্লা বিভাগ হওয়ার দাবি রাখে এ কারনে।
২. ১৯৬২ সালেই কুমিল্লাকে বিভাগ করার কথা ছিল। সব আয়োজন চূড়ান্তও হয়েছিল। কিন্তু কুমিল্লার পরিবর্তে তখন করা হয় চট্টগ্রামকে। কুমিল্লাকে দেয়া হয় শিক্ষা বোর্ড। সেই বোর্ড ভেঙ্গে তিন টুকরো করা হয়। অর্ধ শতাব্দি ধরে বঞ্চিত কুমিল্লাবাসীর বঞ্চনার ইতিহাস ঘুছাতে কুমিল্লা বিভাগ হওয়ার যুক্তিযুক্ত।

৩. কুমিল্লা অঞ্চলে(কুমিল্লা, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী, লক্ষিপুর, নোয়াখালী) জনসংখ্যা ১ কোটি ৭৬ লাখ ৩৮ হাজার ৯ শ ৭০ জন। এর মধ্যে কুমিল্লায় ৫৬ লাখ ২ হাজার ৬ শ ২৫ জন অধিবাসী। জনসংখ্যার ভিত্তিতে কুমিল্লাকে বিভাগ করা জরুরি।

৪. ‘কুমিল্লা পদ্ধতি’র দেখানো পথে কৃষিখাতে উন্নতি করায় বাংলাদেশ আজ খাদ্যে সয়ংসম্পূর্ণ। বাংলাদেশ আজ খাদ্যে উদ্বৃত্ত দেশ। একারণে কুমিল্লাকে বিভাগ করার দাবি রাখে।
৫. প্রত্নর্কীতির ক্ষেত্রে কুমিল্লা গৌরবময় ঐতিহ্যের অধিকারী। লালমাই ময়নামতি অঞ্চলে আবিস্কৃত প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসের এক গৌরবময় ঐতিহ্যের সন্ধান দিয়েছে। এসব প্রাচীন র্কীতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ইতিহাসে কুমিল্লা অঞ্চলের সমহান অবদানের কথা পৃথিবীর সামনে তুলে ধরে। ১৯৫৫-৫৬ সালে খনন করে প্রাচীন র্কীতির ৫৪টি নিদর্শন আবিস্কার করা হয় যা আমাদের জাতীয় জীবনে পরম সম্পদ ও পরম গৌরব বস্তু।
৬. শিক্ষা ক্ষেত্রে কুমিল্লা অবদান গর্ব করার মতো। চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দিতে কুমিল্লার দেবীদ্বারের গুনাইঘরে আশ্রম বিহার ও রাজ বিহার নামে দুটি বিহার (বিশ্ববিদ্যালয়) ছিল। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা এখানে শিক্ষা লাভ করতেন। কুমিল্লা তথা সমতট রাজ্যে সপ্তম শতাব্দিতে ত্রিশটির বেশি বৌদ্ধ বিহার ছিল। সমতটের ব্রাহ্মণ রাজবংশে জন্মগ্রহণকারী শীলভদ্র জগদ্বিখ্যাত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান আচার্য ও সর্বাধ্যক্ষ ছিলেন। তার জন্য বাঙালি জাতির মুখ উজ্জল হয়। তারই অব্যাহত ধারাবাহিকতা কুমিল্লা শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখে আসছে। ১৮৩৭ সালে কুমিল্লা জেলা স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। বেগম রোকেয়ার জন্মের ৯ বছর আগে কুমিল্লার নওয়াব ফয়জুন্নেসা প্রতিষ্ঠা করে ইংরেজি স্কুল। ১৮৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় দক্ষিণ পূর্ব অঞ্চলের অক্সফোর্ড খ্যাত কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ। কুমিল্লা জন্ম দিয়ে অনেক কৃতী শিক্ষক ও ছাত্র। এ কারণে কুমিল্লা বিভাগ হতে পারে।
৭. সুপ্রাচীনকাল থেকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে সমগ্র উপমহাদেশে কুমিল্লা অনন্য স্থান দখল করে আছে। এই কুমিল্লা কৃতীসন্তানরা উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলকে সমৃদ্ধ করেছে। প্রাচীন শহর কুমিল্লাকে সার্ক সংস্কৃতি রাজধানী করার বিষয়টি বিবেচনাধীন।
৮. অনেক র্কীতিমান জন্মেছেন এই কুমিল্লায়। প্রতি শতাব্দিতেই কুমিল্লায় জন্মেছেন বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিত্ব। জগদ্বিখ্যাত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান আচার্য শীলভদ্র, বাংলা সাহিত্যের প্রথম ধারাবাহিক ইতিহাস লেখক দীনেশচন্দ্র সেন, উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ শচীন দেব বর্মন, নওয়াব ফয়জুন্নোসা চৌধুরানী, দানবীর মহেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, শিক্ষানুরাগী রায়বাহাদুর আনন্দচন্দ্ররায়, গুনী শিক্ষক সত্যেন্দ্রনাথ বসু, সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান, ওস্তাদ আয়েত আলী খান, ভাষা সংগামের রুপকার শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, জেলা প্রথম গদ্য লেখক কৈলাশচন্দ্র সিংহ প্রমুখের জন্মস্থান এই কুমিল্লা। এই কুমিল্লা জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিধন্য। কুমিল্লায় তার শশুরবাড়ি।
৯. রাজস্ব আদায়ে কুমিল্লা শীর্ষে। গত অর্থবছরে কুমিল্লা কাস্টমস এক্সাইজ এন্ড ভ্যাট অফিস আদায় করেছে এক হাজার ৮ শত ৫৫ কোটি টাকা। কুমিল্লা কর অঞ্চল গত অর্থ বছরে সাড়ে ৪ শ কোটি টাকার লক্ষ্য মাত্রার চেয়ে বেশি অন্তত ৫ শ কোটি টাকা কর আদায় করে দেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় ভূমিকা রাখছে। এ কারনে কুমিল্লা বিভাগ হওয়ার দাবি রাখে।
১০. মৎস উৎপাদন করে জেলার চাহিদা মিটিয়ে দেশের চাহিদা অন্তত এক লাখ মেট্রিক টন মাছ জোগান দিচ্ছে।

১১. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভৌগলিক অবস্থান বিবেচনায় কুমিল্লায় বিমান বন্দর করা হয়। মিয়ানমারের সাথে যুদ্ধের জন্য। কুমিল্লা প্রতিষ্ঠা করা হয় সবচেয়ে বড় ময়নামতি সেনানিবাস। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীনের পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কুমিল্লায় বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন।

১২. কুমিল্লার বাখরাবাদে আবিস্কৃত গ্যাস জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করার মাধ্যমে কুমিল্লা জাতীয় উন্নতিতে অবদান রাখছে।
১৩. কুমিল্লায় স্থল বন্দর রয়েছে।

১৪. স্টল বিমান বন্দর সুবিধাসহ রপ্তানি প্রক্রিয়াজাত করণ অঞ্চল ইপিজেড রয়েছে।

১৫. কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৩টি বিশ্ববিদ্যালয় , ৫ শ সয্যা হাসপাতাল। সরকারি মেডিকেল কলেজসহ ৩টি মেডিকেল কলেজ আছে। সেই সাথে আছে আছে ক্যাডেট কলেজ, ট্যাকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার, বিএড কলেজ।
১৬. কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কুমিল্লাকে বিভাগ করা যুক্তিকতা সুদৃঢ় হয়েছে।

শেয়ার করুনঃ

Author:

কুমিল্লা অঞ্চলটি একসময় প্রাচীন সমতট অঞ্চলের অধীনে ছিল। পরবর্তীকালে এটি ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে যোগ দেয়। খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে কুমিল্লা জেলা হরিকেল অঞ্চলের রাজাদের অধীনে আসে। অষ্টম শতাব্দীতে লালমাই ময়নামতি দেব বংশ এবং দশম থেকে একাদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চন্দ্র বংশের শাসনাধীনে ছিল। ১৭৬৫ সালে এ অঞ্চলটি ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে আসে। ১৭৯০ সালে জেলাটি ত্রিপুরা জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬০ সালে এর নাম পরিবর্তন করে কুমিল্লা রাখা হয়। ১৯৮৪ সালে কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা পৃথক জেলায় পরিণত হয়।

0 facebook: