25 November 2015

ঘুষের হাট কুমিল্লার পাসপোর্ট অফিস


কুমিল্লা রিপোর্ট২৪ ডেস্কঃ  তাকে সবাই পাসপোর্ট অফিসের ‘বড় সাহেব’ বলেই জানেন। কেউ জানেন তিনি উপ-পরিচালক, কেউ আবার সহকারী পরিচালক হিসেবে স্যার বলে সম্বোধন করেন। অফিসে তিনি দাপুটে কর্মকর্তা বলে সবার কাছে পরিচিত। পাসপোর্ট অফিসের চেয়ার-টেবিলে বসে তিনি বিভিন্ন ফাইলপত্রে সই-স্বাক্ষরও করেন। সিদ্ধান্তের জন্য তার টেবিলে জমা হয় নানা ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ফাইলও। তিনি বেতনও পান মোটা অংকের। কিন্তু অবাক হলেও সত্য যে, আসলে তিনি পাসপোর্ট অফিসের কেউ নন। ক্ষমতাধর এ ব্যক্তির নাম সফিউজ্জামান। এ ক্ষমতার মূল কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছেন তার চাচা-পাসপোর্ট ও বহির্গমন অধিদফতরের বর্তমান মহাপরিচালক এনএম জিয়াউল আলম।
পাসপোর্ট অধিদফতরের প্রধান কার্যালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, ডিজির এ করিতকর্মা ভাতিজা কুমিল্লা পাসপোর্ট অফিসে বসেই সারা দেশের ঘুষের চ্যানেল সমন্বয় করেন। দেশের ৬৭টি আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে প্রতি মাসে গড়ে ১৭ কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্য হয়। এ টাকার একটি বড় অংশ ঢাকার প্রধান কার্যালয়ে চলে আসে নিয়মিত। এটাকে ডিজির পার্সেন্টেজ বলা হয়।
 যুগান্তরের মাসব্যাপী অনুসন্ধানে চাঞ্চল্যকর এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। জানা গেছে, শুধু ডিজির ভাতিজা সফিউজ্জামান একা নন, এভাবে দেশের সবগুলো পাসপোর্ট অফিসজুড়ে বসে আছেন পাসপোর্ট অফিসের প্রভাবশালী কর্তাব্যক্তিদের ঘনিষ্ঠরা। তাই ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধে কর্তাব্যক্তিরা রাত-দিন মুখে ফেনা তুললেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। বরং পর্দার আড়াল থেকে এসব হাত ঘুরিয়ে প্রতি মাসে কাঁড়ি কাঁড়ি ঘুষের ভাগ নিচ্ছেন অনেক প্রভাবশালী। আর যখন এসব ঘুষ কালেক্টরদের বিষয়ে প্রশ্ন তোলা হয়, তখন তাদের না চেনার ভান করা হয়। কেউ কেউ ধরা পড়ে গেলে বলার চেষ্টা করেন আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে নেয়া হতে পারে।
 এদিকে পাসপোর্ট অধিদফতরের সাবেক এক শীর্ষ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, এসব গোপন চ্যানেলের টাকা (ঘুষ) বন্ধ করার পদক্ষেপ নেয়ার চেষ্টা কখনোই কেউ করেনি। বরং ঘুষের টাকা কিভাবে আরও বাড়ানো যায় প্রকারান্তরে সেই চেষ্টা করা হয়েছে। কেউ কেউ এমনও আছেন তারা পারলে টেন্ডার দিতেও পিছ পা হবেন না। এরফলে এসব অফিসে যারা আসেন তারা প্রকৃত প্রাপ্য সেবা পাওয়ার পরিবর্তে পদে পদে হয়রানি ও ভোগান্তির শিকার হন।
 যুগান্তরের এক মাসের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে প্রতি মাসে শুধু কুমিল্লা পাসপোর্ট অফিসেই ঘুষ আদায় হয় প্রায় ২ কোটি টাকা। এ পাসপোর্ট অফিস ঘিরে দালাল চক্রের সক্রিয়তা একেবারেই ওপেন সিক্রেট। কেননা, পাসপোর্ট অধিদফতরের বর্তমান মহাপরিচালক এনএম জিয়াউল আলমের ভাতিজা সফিউজ্জামান কুমিল্লা অফিসের হর্তকর্তা। তার নিয়ন্ত্রণেই চলছে এখানকার দালাল সিন্ডিকেট। তিনি সরকারি কর্মকর্তা না হলেও সবাই তাকে অফিসের ‘বড় সাহেব’ বলেই জানেন। তিনি রীতিমতো চেয়ার-টেবিল নিয়ে বসে কুমিল্লা পাসপোর্ট অফিসে দায়িত্ব পালন করেন।
 বৃহস্পতিবার ওই অফিসে গিয়ে দেখা যায়, সফিউজ্জামান কুমিল্লা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস ভবনের নিচতলায় চেয়ার-টেবিলে বসে কাজ করছেন। টেবিলের ওপর পাসপোর্টের অসংখ্য আবেদনত্রের স্তূপ। দম ফেলার ফুরসত নেই তার। আবেদনগুলোতে তিনি সই-স্বাক্ষর দিচ্ছেন। তার কক্ষে আসছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বড় কর্মকর্তার মতোই তিনি তাদের নানা ধরনের নির্দেশনাও দিচ্ছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দালাল চক্রের এক সদস্য জানান, পাসপোর্ট আবেদন জমা ও ছবি তোলার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সম্মানীর নামে প্রতি পাসপোর্ট আবেদনের জন্য ২ থেকে ৩ হাজার টাকা চ্যানেল ফি দিতে হয়।
 যুগান্তরের অনুসন্ধান চলাকালে চ্যানেল ফি (ঘুষ) আদায়ের প্রক্রিয়াটি জানার জন্য বেশ কয়েকটি আবেদনপত্র পরীক্ষা করে দেখা হয়। এতে বেরিয়ে আসে চ্যানেলে জমা হওয়া প্রতিটি আবেদনপত্রেই বিশেষ চিহ্ন রয়েছে। এ বিশেষ চিহ্ন দালালদের সংকেত হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
 সূত্র জানায়, অফিসের নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে গেলে বিশেষ চিহ্নযুক্ত এসব আবেদনপত্র ডিজির ভাতিজা সফিউজ্জমানের টেবিলে জমা হয়। এসব আবেদনপত্র যাচাই-বাছাইয়ের জন্য গভীর রাত পর্যন্ত অফিস করেন তিনি।
 তার ব্যস্ত অফিসের ছবি তুলতে গেলে তিনি যুগান্তর প্রতিবেদকের পরিচয় জানতে চান। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তিনি কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়েন। এ পর্যায়ে ভোল পাল্টে বলেন, এখানে তিনি ‘অফিস সমন্বয়ক’। তবে কুমিল্লা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান ‘সফিউজ্জামান এখানকার কোনো বৈধ কর্মচারী নন। এখানে ‘সমন্বয়ক’ বলে কোনো পদও নেই।
 যুগান্তরের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, কুমিল্লা পাসপোর্ট অফিসের এ কথিত ‘বড় সাহেব’ সফিউজ্জামানের চাচা পাসপোর্ট ও বহির্গমন অধিদফতরের বর্তমান মহাপরিচালক জিয়াউল আলম। তার বাড়ি কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামে। জিয়াউল আলম ডিজি পদে যোগদানের পর তার বড় ভাই জাকিউল আলমের ছেলে সফিউজ্জামান কুমিল্লা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে যোগ দেন। মূলত ‘চাচা ডিজি’ হওয়ার সুবাদেই এখানে তিনি রীতিমতো বড় সাহেব পরিচয়ে অফিস করছেন। কুমিল্লা পাসপোর্ট অফিস থেকেই তাকে মোটা অংকের বেতনও দেয়া হয়। যদিও এ টাকাও ‘ঘুষ ফান্ড’ থেকেই সরবরাহ করা হয়।
 যুগান্তরের দেবিদ্বার প্রতিনিধি আকতার হোসেন জানান, সফিউজ্জামানের গ্রামের বাড়ি দেবিদ্বারেও সবাই তাকে পাসপোর্ট অফিসের বড় কর্মকর্তা হিসেবেই জানেন। গত ২ মাস আগে কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার পূর্ব চণ্ডিপুর গ্রামে বিয়ে করেন তিনি। বিয়ের সময় কুমিল্লা পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা পরিচয়েই তার বিয়ে হয়। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সফিউজ্জামানের পিতা ও পাসপোর্ট অধিদফতরের মহাপরিচালক এনএম জিয়াউল আলমের ভাই এনএম জাকিউল আলম যুগান্তরকে জানান, তার ছেলে সফিউজ্জামান আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে কুমিল্লা পাসপোর্ট অফিসে চাকরি পেয়েছে। এটি কোনো সরকারি নিয়োগ নয় বলেও তিনি স্বীকার করেন। এ বিষয়ে সফিউজ্জামানের শ্বশুর হাজী শরাফত আলী জানান, তার মেয়ের জামাই সফিউজ্জামান কুমিল্লা পাসপোর্ট অফিসে বড় পদে চাকরি করেন বলেই তারা জানেন। তবে কোন পদে নিযুক্ত আছেন সে বিষয়ে তার কিছু জানা নেই।
 এসব বিষয়ে কুমিল্লা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপ-পরিচালক তৌফিকুল ইসলাম খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি। তবে মঙ্গলবার পাসপোর্ট অধিদফতরের মহাপরিচালক এনএম জিয়াউল আলম যুগান্তরকে বলেন, কুমিল্লা পাসপোর্ট অফিসে তার ভাতিজা কাজ করছেন এ বিষয়টি তিনি এই প্রথম শুনলেন। তিনি এটিকে গুরুতর অপরাধ উল্লেখ করে বলেন, এর বিরুদ্ধে তিনি অবশ্যই ব্যবস্থা নেবেন। দালাল চক্রের মাধ্যমে মোটা অংকের ঘুষ আদায় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দালালের দৌরাত্ম্য বন্ধের জন্য তিনি সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছেন। বিভিন্ন আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসগুলোতে দক্ষ এবং সৎ কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। প্রধান কার্যালয়ে ক্যাশিয়ার নিয়োগের অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, এগুলো মোটেও সত্য নয়। নিয়ম মেনেই কর্মকর্তাদের প্রধান কার্যালয়ে বদলি করা হয়।
 এদিকে দেশজুড়ে পাসপোর্ট অফিসে চাঞ্চল্যকর এ ঘুষ বাণিজ্যের গোমর যুগান্তরের কাছে ফাঁস করে দেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পাসপোর্ট অধিদফতরের সাবেক এক শীর্ষ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, একাধিকবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ে এ বিষয়ে প্রতিবেদনও পাঠানো হয়। কিন্তু এ ঘুষ বাণিজ্য বন্ধ করা যায়নি। তিনি দাবি করেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী কর্মকর্তাও এই ঘুষের টাকার ভাগ পেয়ে থাকেন। এ কারণেই এটি বন্ধ করা যায়নি। আর এই বিশাল ঘুষের টাকার কারণেই পাসপোর্ট অধিদফতরের ডিজির পদটিও অত্যন্ত লাভজনক ও লোভনীয় বলে ধরা হয়।

– দৈনিক যুগান্তর

শেয়ার করুনঃ

Author:

কুমিল্লা অঞ্চলটি একসময় প্রাচীন সমতট অঞ্চলের অধীনে ছিল। পরবর্তীকালে এটি ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে যোগ দেয়। খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে কুমিল্লা জেলা হরিকেল অঞ্চলের রাজাদের অধীনে আসে। অষ্টম শতাব্দীতে লালমাই ময়নামতি দেব বংশ এবং দশম থেকে একাদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চন্দ্র বংশের শাসনাধীনে ছিল। ১৭৬৫ সালে এ অঞ্চলটি ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে আসে। ১৭৯০ সালে জেলাটি ত্রিপুরা জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬০ সালে এর নাম পরিবর্তন করে কুমিল্লা রাখা হয়। ১৯৮৪ সালে কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা পৃথক জেলায় পরিণত হয়।

0 facebook: