27 June 2015

বিলুপ্ত প্রায় কুমিল্লার তাঁতশিল্প


নিজস্ব প্রতিবেদক: একসময় ছয় শতাধিক তাঁত কলে দিন-রাত ঠকাঠক মাকুর আওয়াজ শোনা যেত কুৃমিল্লার ময়নামতি, চান্দিনা, মুরাদনগর, গৌরীপুর ও দেবিদ্বার গ্রামিন জনপদে। সেদিন আর আগের মতো নেই। 

তাঁতশিল্পের অস্তিত্ব কোন রকমে ধরে রেখেছে চান্দিনা আর দেবিদ্বারের তাঁতীরা। আজকের সময়ে নানা প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে কুমিল্লার তাঁতশিল্প টিকে রয়েছে আগের সুনাম নিয়ে। 

মোগল আমল থেকেই কুমিল্লা অঞ্চল ছিল তাঁতশিল্পের জন্য বিখ্যাত। সপ্তদশ শতাব্দির প্রথম দিকে তদানীন্তর ত্রিপুরা রাজ্যের সর্বত্রই অসংখ্য তাঁতী ছিল। ওই সময়ে বৃহত্তর কুমিল্লার ময়নামতি, চান্দিনা, দেবিব্দার, গৌরীপুর নবীনগর, সরাইল, এলাকা প্রায় ১৫ হাজার তাতীঁ শাড়ী, লুঙ্গি, ধুতি, চাদর, গামছা, তৈরীর কাজে নিয়োজিত ছিল।

তাতীঁদের বেশির বাগই হিন্দু গোষ্ঠি সম্প্রদায়ের ছিল। স্বদেশী আন্দোনের সময় তাঁত কাপড়ের চাহিদা বৃদ্ধি পেলেও মুসলমানরা আগের পেশায় অকৃষ্ট হতে থাকে। মুরাদনগরের তাতীঁদের তৈরী মাদ্রাজি, লুঙ্গির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাজার বাজিমাত করেছিল। 

বর্তমান সময়ে কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার বেলাশ্বর, বাড়েরা, অসাদনগর, ভানী, ভোমরকান্দি ও দেবিব্দারের বরকামতা, চাউমুড়া, নবাবপুরসহ বেশকটি গ্রাম বর্তমানে অর্ধশতাধিক তাতঁকলের অস্তিত্ব মিলবে। আগে তাঁতকলের সংখ্যা ছিল ছয় শতাধিক।

বর্তমানে বরকামতায় প্রায় ১০টি তাঁতকলে খদ্দরের কাপড় তৈরির কাজ চলে। অন্যান্য গ্রামের তুলনায় বরকাম তাঁতেই এখনো অধিক সংখ্যক তাঁত পরিবার রয়েছে। যার সীমাহীন দুঃখ কষ্টের মাঝেও নাান প্রতিকৃলতা মোকাবেলা করে ও এই পেশায় জড়িয়ে রয়েছে।

বরকামতার নাথ বাড়ির শশী মোহন দেবনাথ ছিলেন এই অঞ্চলের খ্যাতিমান তাঁতী। প্রায় ৪৩ বছর হয়েছে তিনি মারা গেছেন। তার এই তাঁত পেশা এখনো আকড়ে ধরে এ শিল্প টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন ছেলে রঞ্জিত বেদনাথসহ তার অন্য সহোদররা। বরকামতার আরো কটি পরিবার তাঁত পেশা এখনো আঁকড়ে ধরে রেখেছে।

এ পেশা নিয়ে বরকামতার তাঁতীরা বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, বাপ-দাদার পেশা ছাড়তে পারিনা। মায়া জন্মানো আর দেশী পন্যের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকেই শত কষ্টের ও তাঁতের ব্যবসাটা ধরে রেখেছি। সুতার দাম, কারিগর খরচ, জীবনযাত্রার মান সবই বেড়েছে। কিন্তু পাইকারদের কাছে তাঁতীদের বুনা কাপড়ের দাম বাড়ে না। আমরা তো অনেক কষ্ট সহ্য করে হলেও পূর্বপুরুষের এ পেশা আঁকড়ে ধরে  জীবিকা নির্বাহ করছি। কিন্তু ভীষন চিন্তা হয়, আগামী প্রজন্মের তাঁতীদের জন্য। এতো কষ্ট যে শিল্পে সেই তাঁতে কী তারা আসতে চাইবে? তবে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া ন্যায্য মূল্য সুতা বিতরন কার্যক্রম শুরু হলে তাঁতশিল্পে নতুন করে প্রান ফিরে পাবে। কুমিল্লার তাঁতশিল্পের সুনাম ঐতিহ্য রক্ষা করতে আমাদের সন্তানরা ও এগিয়ে আসবে।

বর্তমানে কুমিল্লার চান্দিনা ও দেবিদ্বারের যে কটি গ্রাম তাঁতকল রয়েছে সেখানে থান কাপড়, চাদর, পাঞ্জাবির কাপড়, ফতুয়ার কাপড়, সালোয়ার কামিজ এবং ওড়নার কাপড় তৈরী করা হয়। তাঁতীদের বুনা এসব কাপড় কুমিল্লা শহরসহ বিভিন্ন উপজেলায়, ঢাকা, চট্রোগ্রাম, নারায়নগঞ্জ, ময়মনসিংয়হসহ বিভিন্ন জেলায় চালান করা হয়। 

২৫০ বছরের বেশি সময় ধরে দেশীয় সাংস্কৃতি আর ঐতিহ্যর ধারক কুমিল্লার তাঁতশিল্প। কুমিল্লাবাসীর প্রত্যাশা, কালের পুরিক্রমায় ও আধুনিক যন্ত্রের যাতাকলের ভিড়েও যেনো কুমিল্লার তাঁতশিল্প হারিয়ে না যায়। এখানকার তাঁতীদের বর্তমান আশা যে, বংশ পরষ্পরায় টিকে থাকে এ পেশায়।

শেয়ার করুনঃ

Author:

কুমিল্লা অঞ্চলটি একসময় প্রাচীন সমতট অঞ্চলের অধীনে ছিল। পরবর্তীকালে এটি ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে যোগ দেয়। খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে কুমিল্লা জেলা হরিকেল অঞ্চলের রাজাদের অধীনে আসে। অষ্টম শতাব্দীতে লালমাই ময়নামতি দেব বংশ এবং দশম থেকে একাদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চন্দ্র বংশের শাসনাধীনে ছিল। ১৭৬৫ সালে এ অঞ্চলটি ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে আসে। ১৭৯০ সালে জেলাটি ত্রিপুরা জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬০ সালে এর নাম পরিবর্তন করে কুমিল্লা রাখা হয়। ১৯৮৪ সালে কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা পৃথক জেলায় পরিণত হয়।