20 October 2013

আমার শৈশব, যৌবন ও লিবার্টি সিনেমা হল [ প্রবীর বিকাশ সরকার ]

জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই চলচ্চিত্রর সঙ্গে পরিচয়। শিশুকালেই মার সঙ্গে সিনেমা হলে ছবি দেখেছি। অন্ততপক্ষে ৭ বছর বয়স পর্যন্ত দেখেছি। মা এখনো সিনেমা দেখা আর বইপড়ার পাগল। মার জন্য আলাদা টিভি কিনে দিয়েছে তার মেজো মেয়ে প্রতিমা। আগে সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখতো এখন টিভিতেই দেখে। ডিভিডি চালাতে জানলে সেটাও করতো। মার সঙ্গে যে কত ছবি দেখেছি তার হিসেব নেই। পাকিস্তান আমলেই বেশি। স্বাধীনতার পর মা কমই গিয়েছে সিনেমা হলে। সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে হয়নি।

কুমিল্লা শহরে জ্ঞান হওয়ার পর থেকে যে তিনটি সিমেনা হল আমি দেখেছি তার দুটোই এখন বন্ধ এবং ভগ্নদশায় পরিণত। এগুলো হলো রূপালী, রূপকথা ও লিবার্টি। রূপালী এখনো ধুঁকে ধুঁকে চলছে। সংস্কার হয়নি বহুবছর ধরে। সম্প্রতি এর মালিক রফিক সাহেব জানালেন এটা ভেঙ্গে ফেলা হবে বহুলতলবিশিষ্ট দালান হবে।

রূপকথার মালিক কি করবেন জানি না। এবং লিবার্টি হলটি নিয়ে মামলা চলছে অনেক বছর ধরে। শোনা যায় এখানেও বহুতল দালান হবে। কে করবেন জানি না। লিটার্টি ও রূপকথা দুটি হলেরই মালিক ছিলেন ভারত থেকে আগত ক্ষেত্রীরা। তারাও চলে গেছেন স্বাধীনতার আগে বা পরে। লিবাটি হলের ম্যানেজার ছিলেন বাদলবাবু স্বাধীনতার পর তিনি মালিক বলে দাবি করেছিলেন নাকি। ফলে সরকার মামলা ঠুকে দিয়েছে। বাদলবাবু এখন আর হলসংলগ্ন বাড়িতে থাকেন না কলকাতায় নাকি আছেন। তার ছোটভাই অতুলদার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা ছিল। তিনি প্রতিদিন ভিক্টোরিয়া কলেজের ব্যায়ামাগারে সকাল বিকেল ব্যায়াম করতেন। খুব হাস্যরসিক মানুষ ছিলেন।

বাদলবাবুও খুব ভালো মানুষ ছিলেন। শহরের অনেকেই মাগনা ছবি দেখতেন। আমরাও ছাত্রাবস্থায় অনেকবার বাদলদাকে বলে ঢুকে পড়েছি সেকেন্ড ক্লাসে ম্যাটিনি শোতে। তিনি চাঁদাও দিতেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। গোলগাল বেঁটে সদাহাস্যমুখ বাদলদার কথা খুব মনে পড়ে। কোর্টে গেলে বাবাকে খুব সমীহ করতেন। বিখ্যাত বা ভালো ছবি এলে তিনি টিকিট পাঠিয়ে দিতেন বাবার কাছে। মাও যেতো। এরকম একটা সংস্কৃতি ছিল এই শহরে বহু বছর ধরে। বাবা কিন্তু ছবি দেখতো না।

১৯৮৪ সাল পর্যন্ত কত যে ছবি দেখেছি এই সিনেমা হলগুলোতে বন্ধুদের নিয়ে হিসেব করতে পারবো না। একসময় আমিও মার মতো সিনেমাপাগল ছিলাম। মার ছেলে বলে কথা! ছোট্টবেলায় ছবিতে মারামারি হলে মুখ লুকাতাম, রক্ত দেখলে চিৎকার করে উঠতাম ভয়ে আর দুঃখের সিন এলে ফিছ ফিছ করে কেঁদে ফেলতাম। সেইসব স্মৃতি ঢের মনে আছে। মাঝে মাঝে মা বিরক্ত হয়ে বাইরে বারান্দায় গিয়ে বসতে বলতো। আমি সরু বারান্দায় গিয় বেঞ্চিতে বসে থাকতাম। আরও মহিলারা বসে থাকতেন পরবর্তী শো দেখার জন্য। বাইরে থেকে ছবির শব্দ, সংলাপ ও গান শোনা যেতো। গান এলে পলে পর্দা ফাঁক করে ঢুকে যেতাম, বসে পড়তাম মার কোলে। গানের পরই সচরাচর দুঃখের সিন চলে আসতো এবং আমিও বাইরে চলে আসতাম। বারান্দায় ভিড় বাড়তে থাকতো। পরিচিত জনও থাকতেন দেখতাম। পরচিত মা-বৌরা এটা সেটা দিতেন আমাকে। আদর করে পাশে বসিয়ে রাখতেন। আমি বসে বসে বাদাম খেতাম, লঞ্জেস চুষতাম। হলের কর্মচারী সবাই মাকে এবং আমাকে খুব ভালো করে চিনতো। মা কি নতুন ছবি দেখছে নাকি! মা তার কৈশোর থেকে ছবি দেখে আসছে। তাছাড়া পুলিশ কোর্টের জিআরও পরেশবাবুর স্ত্রীকে চেনে না এমন কেউ আছে নাকি এই শহরে! সুতরাং খারাপ লোকদের থেকে আমরা নিরাপদ ছিলাম। ব্ল্যাকার (যারা বেশি দামে টিকিট বিক্রি করতো অবৈধভাবে) দেখলেই মাকে লম্বা করে সালাম ঠুকতো, কারণ পরেশবাবুর স্ত্রী! ওদের তো প্রায়ই পুলিশ গ্রেপ্তার করে থানায় তারপর হাজতে নিয়ে যেতো। তাদের ভাই ও বৌরা এসে কান্নাকাটি করতো কোর্টে, বাবা দয়াপরবশ হয়ে ম্যাজিস্ট্রেটকে বলে ছেড়ে দেবার ব্যবস্থা করতেন। শুধু কি ব্ল্যাকার, ছোটোখাটো মজুতদার, চোরাকারবারী, রাজনৈতিক পার্টির নেতাদেরকেও বাবা কত যে সাহায্য-সহযোগিতা করেছে সেসব আরেক ইতিহাস। অনেক সময় সিনেমা হলের বারান্দায় বসে থাকতে দেখে ব্ল্যাকাররা চকোলেট এনে দিতো। কারণ এরা আমাকে বাবার অফিসে অনেকবার দেখেছে। ‘ছোটোবাবু’ আদাব বলে সেলামও করতো। আমি সময় কাটাতে দোতলার বারান্দা থেকে দেখা যায় আশেপাশের বাড়িঘরগুলো দেখতাম। কী সবুজ আর ছিমছাম সুন্দরই না ছিল কুমিল্লা শহরটি! ছবি শেষ হলে পরে আমরা রিকশায় চেপে চলে আসতাম। প্রচন্ড ভিড় হতো, মহিলা আর মহিলা ছাড়া কিছুই দেখা যেতো না। প্রচন্ড ঠেলাঠেলি আর হৈহৈ গুঞ্জন। বাদশা মামা আমাদেরকে খুঁজে বের করতেন। তিনি আমাদের প্রতিবেশী রিকশা চালান। তার রিকশায় করে হলে আসতাম আবার ছবি শেষ হওয়ার পর তার রিকশাতে চড়ে বাসায় ফিরতাম। তখন সন্ধে গড়িয়ে যেতো। অনেক সময় মা পাড়ার মাসি বা বান্ধবীদের সঙ্গে রাতের শো দেখতে যেতো। বাবা ও আমি বাসায় থাকতাম। বাদশা মামা নিয়ে যেতো। ভাড়া দিতো বাবা। আসলে পাড়ার গরীবরা বাবার ওপরই চলতো তখন। ছোটরা এলাকাটায় বিহারী কলোনী ছিল। মফিজাবাদ কলোনী নামেই খ্যাত। সবাই ছিল খুব গরীব দিনে এনে দিনেই খাওয়া লোকজন। বাবার অফিস সংলগ্ন আবার এই কলোনী। (আমার লিখিত ‘অতলান্ত পিতৃস্মৃতি’ উপন্যাসে এসব বর্ণনা আছে, এখনো অপ্রকাশিত।)

মনে পড়ে যখন একটু বড় হলাম তখন অনেক কিছুই বুঝি বয়স ৯-১০। তখন পাকিস্তান আমলে এবং স্বাধীনতার পরেও ইংলিশ ছবি দেখানো হতো তিনটিতেই। রবিবারে সকালে গিয়ে ছবি দেখতাম একেবারে থার্ড ক্লাসে পর্দার সামনে। গম গম করতো শব্দ। বেশির ভাগ দেখানো হতো কাউবয় মানে ওয়েস্টার্ন পিকচারগুলো। তাছাড়া মারামারির ছবিও দেখানো হতো। ততদিনে মারামারির ছবি দেখে সয়ে গেছে। বুঝতে পারছি যে এগুলো মানুষের বানানো নাটক বাস্তব নয়। মাঝে মাঝে মর্নিং শোতে স্কুলের শিক্ষকদের মুখে পড়ে যেতাম। তখন ভোঁ দৌড়। অবশ্য তারা স্কুলে ভুলেও কিছু বলতেন না।

একবার কুমিল্লা ধর্মসাগর পাড় চাঁদের হাটের সম্মেলন করার জন্য অর্থ তহবিল সংগ্রহার্থে চ্যারিটি শোর আয়োজন করেছিলাম। বাদলদা অনুমোদন দিয়েছিলেন একটি ইংরেজি ছবি দেখানোর। সপ্তাহ খানেক দেখানো হয়েছিল। ছবি কে ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন মনে নেই যতখানি মনে পড়ে হানিফ সংকেতই ছবিটি ঢাকা থেকে এনেছিলেন। তখন তিনি কুমিল্লাতেই থাকেন ১৯৭৬-৭৭ সালের কথা।

সমকালীন ইতিহাস লেখার ঐতিহ্য বাঙালির নেই। প্রবণতাও নেই। অথচ এটা খুব জরুরি। তথ্য না থাকলে ইতিহাস লেখা যেমন সম্ভব নয় তেমনি আধুনিকতাও গড়ে ওঠে না। কুমিল্লা এখন যাচ্ছেতাই একটা বাজে শহরে পরিণত হয়েছে। এই তিনটি সিনেমা হল মুছে যাওয়ার প্রতীক্ষায় নীরবে কাঁদছে। অথচ কত সুন্দরভাবেই না এগুলোকে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা হিসেবে রিনোভেট করা যায় সংস্কারের মাধ্যমে। নাগরিক সংস্কৃতি এখনো আধাশহর আধাগ্রাম বাংলাদেশে গড়ে ওঠেনি এটা হতাশাব্যঞ্জক। এর প্রধান কারণই হচ্ছে কলুষিত রাজনীতি। বর্তমান রাজনীতিকরা সংস্কৃতিবিরোধী।


শেয়ার করুনঃ

Author:

কুমিল্লা অঞ্চলটি একসময় প্রাচীন সমতট অঞ্চলের অধীনে ছিল। পরবর্তীকালে এটি ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে যোগ দেয়। খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে কুমিল্লা জেলা হরিকেল অঞ্চলের রাজাদের অধীনে আসে। অষ্টম শতাব্দীতে লালমাই ময়নামতি দেব বংশ এবং দশম থেকে একাদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চন্দ্র বংশের শাসনাধীনে ছিল। ১৭৬৫ সালে এ অঞ্চলটি ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে আসে। ১৭৯০ সালে জেলাটি ত্রিপুরা জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬০ সালে এর নাম পরিবর্তন করে কুমিল্লা রাখা হয়। ১৯৮৪ সালে কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা পৃথক জেলায় পরিণত হয়।

0 facebook: