22 July 2013

কুমিল্লার মুরাদনগরের দৌলতপুরে বিদ্রোহী কবি


মানুষের জীবনের উজ্জ্বল সময় তার যৌবনএকজন কবির জীবনে এ সময়টি নক্ষত্রের মতো আলোকিতআমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের যৌবনের কিছু সময় কেটেছে কুমিল্লার মুরাদনগরের দৌলতপুরেবিদ্রোহী কবি দৌলতপুরে এসে হয়ে গেলেন প্রেমের কবিকবির জীবনের গতিপথ বদলে দিল এক নারীকবি নিজেই বলেছেন এক অচেনা পল্লী বালিকার কাছে এত বিব্রত আর অসাবধান হয়ে পড়েছি, যা কোন নারীর কাছে হয়নি
এ বালিকাটি আর কেউ নয় সে হচ্ছে মুরাদনগরের বাঙ্গরা ইউনিয়নের দৌলতপুর গ্রামের মুন্সী বাড়ির আবদুল খালেক মুন্সীর মেয়ে সৈয়দা খাতুনকবি আদর করে ডাকতেন নার্গিস
দৌলতপুরে যাওয়ার আগেই বাঙ্গরা পেরিয়ে দেখবেন নজরুল গেটজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে সম্প্রতি নজরুল তোরণটি পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে
নজরুল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেনএ যুদ্ধ জাপান-জার্মান-ইতালির সঙ্গে অন্য পক্ষের দীর্ঘ পাঁচ বছর চলেছিলনজরুল যুদ্ধে গিয়েছিলেন ১৯১৭ সালেতিনি ব্যাটালিয়ন কোয়ার্টার মাস্টার ছিলেনতখন ক্যাপ্টেন আলী আকবর খাঁর সঙ্গে তার পরিচয় হয়১৯১৯ সালে যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়নজরুল তখন মুসলিম সাহিত্য সমিতির (কলকাতায়) অফিসে আফজাল-উল-হক সাহেবের সঙ্গে থাকতেনসে সময় আলী আকবর খানের সঙ্গে নজরুলের হƒদ্যতা গড়ে ওঠেআলী আকবর নজরুলের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাকে কুমিল্লায় তার গ্রামের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানান
নজরুল ৩ এপ্রিল ১৯২১ কলকাতা থেকে চট্টগ্রাম মেইলে রাতে আসেনআলী আকবর খাঁ নজরুলকে নিয়ে যানওঠেন কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড়ে  এখানে তার সহপাঠী বন্ধু ইন্দ্র কুমার সেনের ছেলে বীরেন্দ্র কুমার সেনের বাড়িতে ওঠেনএখানে বীরেন্দ্রের মা বিজয়া সুন্দরীদেবীকে নজরুল মা বলে সম্বোধন করতেন
দুদিন বেড়ানোর পর ছয় এপ্রিল আলী আকবর খাঁ নজরুলকে নিয়ে মুরাদনগরের বাঙ্গরা ইউনিয়নের দৈলতপুরে নিয়ে আসেনবর্তমানে যেখানে আলী আকবর মেমোরিয়াল ট্রাস্টের বিল্ডিংটি অবস্থিতএখানে আরেকটি ঘর ছিল, ঘরেই নজরুলকে থাকতে দেয়া হয়  এ ঘরটি ৪৫ হাত দৈর্ঘ্য ও ১৫ হাত প্রস্থ ছিল বাঁশের তৈরি আটচালা ঘরটির একেবারে পূর্ব পাশে নজরুল থাকতেন
নজরুলের কক্ষটির পাশেই ছিল কামরাঙ্গা গাছকবি এ গাছকে নিয়েই লিখেছেন কামরাঙ্গা রঙ্গ লোকের পীড়ন থাকে/ঐ সুখের স্মরণ চিবুক তোমার বুকের/তোমার মান জামরুলের রস ফেটে পড়ে/হায় কে দেবে দামসে সেথায় একডজন কামরাঙ্গা গাছ ছিলএখন পুরো বাড়িতে ঘুরে মাত্র দুটি কামরাঙ্গা গাছ দেখতে পাবেনএকটি গাছে একটি ফলক লাগানো রয়েছে
দুটি বড় আম গাছ নজরুলের স্মৃতির সঙ্গে জড়িতপুকুরের দক্ষিণপাড়ে অবস্থিত আম গাছটির নিচে বসে নজরুল বাঁশি বাজাতেনযদিও সে গাছটি আর নেইকয়েক বছর আগে গাছটি মারা গেছেগাছের গোড়াটি পাকা করে রাখা হয়েছেআম গাছের সামনে রয়েছে একটি শান বাঁধানো ঘাটএ পুকুরটি ছিল তার নিত্যদিনের সঙ্গীকবি এখানে নিয়মিত সাঁতার কাটতেনপাড়ার ছেলেমেয়েদের নিয়ে  খেলতেনপানিতে ডুব দিয়ে কলের গান বাজাতেনকবি সাবান দিয়ে গোসল করার সময় পুরো পুকুর ফেনায় আচ্ছাদিত হয়ে যেতকবি একবার পানিতে নামলে আর উঠতেই চাইতেন না
পুকুরের পশ্চিমপাড়ে একটি আম গাছ দেখতে পাবেনএ আম গাছটিতে এসে কবির মা (কবি আলী আকবর খাঁর নিঃসন্তান বোন ইফতেখারুন্নেছাকে মা ডাকতেন)  খাবার নিয়ে এসে ডাকতেন আয় নুরু, খেতে আয়!তখন কবি গোসল সেরে বাড়িতে এসে ভাত খেতেন
নজরুল যখন বিকালবেলা গাছের ছায়ায় শীতলপাটি বিছিয়ে কবিতা, গান রচনা করতেন, আলী আকবর খাঁ এর সঙ্গে গল্প করতেন, রূপকুমারী নার্গিস খানম নানা কাজের ছলে তখন ছুটে আসতেনকবি ও কবির প্রিয়া চোখের ভাষায় ভাব বিনিময় করতেনখাঁ বাড়ির পাশেই মুন্সী বাড়িআপনি সেখানে যাবেননার্গিস এ বাড়ির আবদুল খালেক মুন্সীর মেয়েবাল্যকালে নার্গিসের বাবা-মা মারা গেছেননার্গিস অধিকাংশ সময় মামার বাড়িতে থাকতেন 
সেখানে গিয়ে শুনবেন নজরুলের কবিতায় আটি গাঙ্গের কথা এসেছেএটি দৌলতপুরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছেবুড়ি নদী একটি, তবে কবি নজরুলের সেই আটি এখন খালে পরিণত হয়েছেআটি নদীতে তিনি সাঁতার কেটেছেনগোমতীতে নিয়মিত সাঁতার কাটার কোন সংবাদ পাওয়া না গেলেও গোমতীকে তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেনতাই তো তার কবিতায় এসেছে আজো মধুর বাঁশরী বাজে/গোমতীর তীরে পাতার কুটিরে/আজো সে পথ চাহে সাঁঝে
নজরুলের দৌলতপুরে আগমন যেন নজরুলের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়তেমনি বাংলা সাহিত্যের জন্যও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণনজরুল দৌলতপুরে ৭৩ দিন অবস্থানকালে লিখেছেন ১৬০টি গান ও ১২০টি কবিতাএগুলো নজরুলকে প্রেমিককবি হিসেবে পাঠক দরবারে পরিচিত করেছেআর এ গান ও কবিতার বিষয় শুধুই নার্গিসএখানেই ১৮ জুন ১৯২১ নজরুল-নার্গিসের বিবাহ সম্পন্ন হয়বর্তমানে সেখানে আলী আকবর খাঁ মেমোরিয়াল স্কুলের বিল্ডিংটি অবস্থিতএর পশ্চিমপাশে নজরুল-নার্গিসের বাসর হয়েছিলবাসর ঘরে ব্যবহৃত খাট, পালঙ্ক ও নজরুল ব্যবহৃত কাঠের সিন্ধুকটিও এখনও সংরক্ষিত রয়েছে 
নজরুলের জন্মবার্ষিকী অনুষ্ঠান সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য নজরুল মঞ্চ পালন করা হয়েছেপাশে একটি পাঠাগারও রয়েছেএদিকে আলী আকবর খাঁর বাড়িটিকে নজরুল জাদুঘর, বাসর ঘরটি নজরুল গবেষণাগার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি দীর্ঘদিনের হলেও তা প্রতিষ্ঠা হয়নি


শেয়ার করুনঃ

Author:

কুমিল্লা অঞ্চলটি একসময় প্রাচীন সমতট অঞ্চলের অধীনে ছিল। পরবর্তীকালে এটি ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে যোগ দেয়। খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে কুমিল্লা জেলা হরিকেল অঞ্চলের রাজাদের অধীনে আসে। অষ্টম শতাব্দীতে লালমাই ময়নামতি দেব বংশ এবং দশম থেকে একাদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চন্দ্র বংশের শাসনাধীনে ছিল। ১৭৬৫ সালে এ অঞ্চলটি ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে আসে। ১৭৯০ সালে জেলাটি ত্রিপুরা জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬০ সালে এর নাম পরিবর্তন করে কুমিল্লা রাখা হয়। ১৯৮৪ সালে কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা পৃথক জেলায় পরিণত হয়।

0 facebook: