23 July 2013

জাহাপুর জমিদার বাড়ি

হাতিশালায় হাতি নেই, আস্তাবলে ঘোড়া নেই, সিংহ দরজায় সিংহ নেই দালানগুলোই শুধু স্মৃতি বহন করছে ৪০০ বছর আগের এ জমিদার বাড়িটিরকুমিল্লার মুরাদনগরের জাহাপুরে এর অবস্থানগোমতি বিধৌত এ জাহাপুরগোমতির কল কল ঢেউয়ের তালে তালে এক সময় বয়ে চলত জমিদারদের গয়নানৌকাতাদের ব্যাপারে বাংলার বার ভূঁইয়ার এক ভূইয়া কেঁদার রায় নাকি বলেছিলেন, মেঘনার পূর্ব পাড়ে কোন বড় জমিদার নেইশাকের মধ্যে লবণতুল্য আছে জাহাপুরের জমিদাররা
কি কি দেখবেন
জমিদার বাড়িতে পৌঁছেই দেখবেন মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে দুটি সিংহতারা আপনাকে এ বাড়িতে নিঃশব্দে স্বাগত জানাবেপ্রধান ফটকে সবসময় দুজন রক্ষী থাকতজমিদারি আমলে এলে পরিচয় দিয়ে ঢুকতে হতোএখন আর সেদিন নেইরাইফেল অথবা তীর-ধনুক হাতে মাথায় পাগড়ি নিয়ে কোন শিখকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখবেন নাবহিরাঙ্গন এবং অন্দরমহল তারাই দেখতেনআপনাকে মূল গেটে দেখে হয়তো কেউ এগিয়ে আসবেনতিনি আপনাকে মূল বাড়িতে নিয়ে যাবেন
প্রথম বিল্ডিংটি তিন তলাপুরোটাই ইট-সুরকি দিয়ে নির্মিতএরকম আরও ৯টি বিল্ডিং ছিল২টি সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছেকিছু জড়াজীর্ণ অবস্থায় রয়েছেবাকিগুলো ভালো১মটি বাদে বাকি সবগুলো দোতলাপ্রধান গেট দিয়ে প্রবেশ করেই একটি মন্দির দেখতে পাবেনএটি নাট মন্দিরদুর্গা পূজার সময় এখানে ভক্তরা সমবেত হনপাশেই রয়েছে দুর্গাদেবীর প্রতিমাপ্রতিমাটি স্থায়ীভাবে নির্মাণ করা হয়েছে
এখান থেকে সোজা চলে যাবেন অন্দর মহলেএ মহলেই বর্তমান বংশধররা বসবাস করছেএখানে দেখা হবে ১১তম বংশধর শ্রী আশীষ কুমার রায়, সমরেন্দ্র রায় ও অজিত কুমার রায়ের সঙ্গেএছাড়া রয়েছেন প্রফেসর অঞ্জন কুমার রায়, অধ্যক্ষ রঞ্জন কুমার রায় ও তাদের পরিবারবর্গতারাই বর্তমানে এ বিশাল বাড়িটি দেখাশোনা করছেনজমিদারদের আরও ২টি পরিবার এখানে বসবাস করছেতবে ওই পরিবারগুলোর অধিকাংশ সদস্যই জীবিকার প্রয়োজনে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জায়গায় বসবাস করছেনতাই তাদের কারও সঙ্গে আপনার দেখা নাও হতে পারেআপনার চোখের সামনের ভবনটির দরজার ওপরে খোদাই করা লেখা ১৩৩৪ বঙ্গাব্দদেখবেনএটি তৈরি করেছন অঞ্জন কুমার রায়ের দাদা অশ্বিনী কুমার রায়
এটি জমিদার বাড়ির সর্বশেষ ভবনএর সামনে প্রশস্ত বারান্দা রয়েছেফ্লোর থেকে ছাদের উচ্চতা ১৪ ফুটছাদের নিচের অংশে কাঠের এবং লোহার তৈরি কারুকার্যময় সিলিং দেখতে পাবেনদোতলায় ওঠার জন্য সরু সিঁড়ি দেখতে পাবেনএকটু ওঠে মাঝখানে দাঁড়াবেনদোতলায় ৮ থেকে ১০টি কক্ষইচ্ছে করলে ছাদ থেকে প্রায় ৩ একর আয়তনবিশিষ্ট পুরো জমিদার বাড়িটি দেখতে পারেন
১৮৬২ সালে এ বংশের লোকরা জমিদারি লাভ করেন জমিদারি শুরু করেন গৌরি মোহনতার ভাই রাম দয়াল ও কমলা কান্ত তাকে সহযোগিতা করেন তাদের অওতাধীন বর্তমান তিতাস, মুরাদনগর, দাউদকান্দি, চান্দিনা, দেবিদ্বার ও নবীনগর বিস্তৃত ছিলনাস্তা শেষে আবার বাড়িতে প্রবেশ করুনবাড়ির বাইরের অংশের একটি ঘরে উঁচু রথ দেখতে পাবেনলোকজনের মুখে জানবেন, জমিদার অশ্বিনী কুমার রায় ১৩২৪ বঙ্গাব্দে জগন্নাথ দেবের রথ ও মন্দির প্রতিষ্ঠা করেনআপনি যদি রথ যাত্রার সময় যান তাহলে দেখবেন হাজার হাজার ভক্ত সমবেত হয়
বাড়ির বাইরের অংশে সুউচ্চ দেয়াল দেখবেনএকদিকে কাঁটা তারের বেড়া রয়েছেএকে একে সবগুলো ভবন ঘুরে দেখুনদেখবেন কোনটা আই টাইপ, কোনটা এল টাইপে নির্মিতসবগুলো ভবনেই সুশোভিত নকশা রয়েছেসবগুলোতে ফুলের নকশা করা হলেও একই ধরনের ফুল ব্যবহার করা হয়নিএমনকি জানালার গ্রিলগুলোতেও নকশা করা রয়েছেএ ধরনের নকশা আজকাল আর দেখা যায় নাজমিদার বাড়ির লোকদের কাছে জানবেন, বাড়িগুলোর নকশা তৈরিতে ঢাকার বিক্রমপুরের মিস্ত্রিরা কঠোর পরিশ্রম করেছেন এগুলো মুঘল রীতিতে তৈরি
এবার প্রবেশ করুন রানী মহলেসেখানে গিয়ে রানী নন্দ রানী, মহামায়া রায়, ও শ্যামা সুন্দরী দেবীর স্মৃতি মনে পড়বেরানী মহলের সামনে একটি পুকুর ছিলওই পুকুরের পানিতে জাফরান মিশিয়ে রানীরা গোসল করতেনএছাড়া হস্তচালিত পাম্পের মাধ্যমে ৩ তলায় পানি উঠিয়ে রানীরা গৃহকর্ম সম্পাদন করতেন
এবার চলে আসুন বেডরুমেজমিদারদের ব্যবহƒত শৌখিন খাট, নকশা করা চেয়ার, গা এলিয়ে দেয়া ইজি চেয়ার, কারুকার্যখচিত ফুলদানি সবকিছুই দেখতে পাবেনকাউকে জিজ্ঞেস করলে জানবেন, সেগুন কাঠের তৈরি নকশা করা আসবাবপত্রগুলো শতাধিক বছরের পুরনোএবার আয়নামহলের দিকে এগিয়ে যানএখানে প্রতিদিন সন্ধ্যায় নাচ-গানের আসর বসতওই সময় ব্যবহƒত দু-একটি হ্যাজাক লাইট দেখতে পাবেনশৌখিন জমিদাররা জারবাতি ব্যবহার করতেনতবে বিদ্যুতের ব্যবস্থা না থাকায় সেগুলোতে মোমবাতি ব্যবহার করা হতোতখন কোন বৈদ্যুতিক পাখা না থাকায় হাতে টানা পাখা ব্যবহার করা হতোএমন পাখা রঞ্জন বাবুর কাছে সন্ধান করলে দেখতে পাবেন
জমিদার গিরিশ চন্দ্র রায়ের পুত্র হেম চন্দ্র রায় সংস্কৃতিবান ছিলেনতার আমলে জলসা ঘরে বড় ধরনের সাংস্কৃৃতিক অনুষ্ঠান হতো
বসতঘরের সামনে একটি ছোট্ট বাগান দেখতে পাবেনএ বাগানে এক সময় শোভা পেত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আনা রঙ-বেরঙের ফুল গাছউড়িষ্যা থেকে আনা গোলাচি গাছটি দীর্ঘ দিন জীবিত ছিলএখনও আছে নয়নাভিরাম পারিজাত, চাপা, ম্যাগনেশিয়াম ও কনকচাঁপাএছাড়া পৃথক ফলবাগানও ছিল
এবার আপনি চলুন ডাইনিং পে¬সেএখানে নিয়মিত কয়েকজন পাকা রাঁধুনি থাকতজমিদার পরিবারের সদস্য ছাড়াও খাওয়া-দাওয়া করত পাইক-পেয়াদা ও খাজনা আদায়ে নিয়োজিত কর্মচারীরাজমিদারদের ব্যবহƒত শ্বেত পাথরের একটি পে¬ট দেখে নিজের চোখকে ধন্য করতে পারেনভাত খাওয়ার পর ফল খাওয়া ছিল তাদের নিত্যদিনের অভ্যাসতখনকার যুগে হাটবাজার কিংবা গলির মোড়ে আপেল-আঙ্গুর পাওয়া যেত নানিজস্ব গয়না নৌকা দিয়ে চাঁদপুর গিয়ে সেখান থেকে স্টিমারে কলকাতা গিয়ে আপেল, আঙ্গুর নিয়ে আসা হতোডাইনিং পে¬সের চারদিকে চোখ রাখুন, দুর্লভ অনেক কিছু চোখে পড়বেবর্তমানে আমরা পানি বিশুদ্ধ করার জন্য ফিল্টার ব্যবহার করি আজ থেকে ১শবছর আগেও জমিদাররা যে কতটা স্বাস্থ্যসচেতন ছিলেন তা দরজার পাশে রাখা ফিল্টারটির দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেনফিল্টারটির নিচের অংশে চোখ নিলে দেখতে পাবেন ছোট্ট করে লেখা রয়েছে, ‘মেইড ইন লন্ডন
এবার খাওয়ার ঘর থেকে বেড়িয়ে আসুনবের হওয়ার রাস্তায় দেখবেন একটি ছাতাতবে এটি যেনতেন ছাতা নয়, রুপার হাতলের ছাতা জমিদার বাবুরা যখন প্রজাদের সুখ-দুঃখ দেখার জন্য বের হতেন তখন দুজন লোক এটি বয়ে বেড়াত
মূল বাড়ি থেকে বের হয়ে এবার শ্মশানে চলে আসুনএখানে সমাহিত রয়েছেন জমিদার রাম মোহন রায়, কৃষ্ণমোহন রায়, গৌরি মোহন রায়সহ বহু জমিদারতবে হিন্দুরীতি অনুযায়ী আগুনে দাহ না করে মাটি দেয়া হয় সাধু পুরুষ কমলাকান্ত রায়কেএখানে প্রতিদিন সন্ধ্যায় মোমবাতি জালানো হয়হিন্দু-মুসলমান সবাই তাকে সম্মান করততার ভক্তদের মুখে শুনবেন তার সমাধির সামনের পুকুরটির নাম ফেনপুকুর এক সময় বহু ভক্ত এখানে আসত তাদের জন্য ফ্রি খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা ছিলশোনা যায়, তাদের জন্য রান্না করা ভাতের মার ফেলতে ফেলতে এ যায়গাটি গর্ত হয়ে পুকুরটির সৃষ্টি হয়েছে
সমাধি সৌধ অতিক্রম করে সামনে গেলে দেখতে পাবেন বেশ কয়েকটি মন্দিরএলাকাবাসরী মুখে শুনবেন, শুধু মন্দির নয় জাহাপুরের জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় বহু রাস্তা, ব্রিজ-কালভার্ট, মাদ্রাসা, হাইস্কুল, পোস্ট অফিস ও দাতব্য চিকিৎসালয় গড়ে উঠেছেহাতে সময় থাকলে সব ঘুরে ঘুরে দেখবেনএ সময় আপনাকে সহযোগিতা করবেন জমিদার বংশের বারতম বংশধর অধ্যক্ষ রঞ্জন কুমার রায়
কিভাবে যাবেন
ঢাকার সায়েদাবাদ ও রাজধানী সুপার মার্কেটের সামনে থেকে কুমিল্লা অথবা কোম্পানীগঞ্জগামী সৌদিয়া, তিশা অথবা অন্য কোন লাক্সারিয়াস বাসে উঠবেনময়নামতি সংলগ্ন ক্যান্টেনমেন্টে পৌঁছবেন কুমিল্লা শহরের আগে মাত্র ২ ঘণ্টায় কোম্পানীগঞ্জের বাসে উঠলে আর বাস পরিবর্তন করতে হবে নাকুমিল্লার বাসে উঠলে ময়নামতিতে নামতে হবেএখান থেকে আবার কোম্পানীগঞ্জের বাসে উঠে দেবিদ্বারের পান্নারপুলে নামতে হয়সেখান থেকে বাখরাবাদ রোডে ১০ কিলোমিটার গেলেই জাহাপুর পৌঁছতে পারবেন
ফেরার পথ
যদি নিজস্ব যানবাহনে আসেন তাহলে দিনে দিনেই ফিরতে পারবেনসমস্যা হলে কোম্পানীগঞ্জ অথবা দেবিদ্বারের কোন হোটেলে উঠুনঅথবা ১ ঘণ্টা হাতে নিয়ে কুমিল্লা শহরের অন্য যে কোন হোটেলে উঠুনবাসায় ফেরার সময় প্রিয়জনের জন্য ঐতিহ্যবাহী খদ্দরের পোশাক এবং রসমলাই নিয়ে যেতে ভুলবেন না কিন্তু!


শেয়ার করুনঃ

Author:

কুমিল্লা অঞ্চলটি একসময় প্রাচীন সমতট অঞ্চলের অধীনে ছিল। পরবর্তীকালে এটি ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে যোগ দেয়। খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে কুমিল্লা জেলা হরিকেল অঞ্চলের রাজাদের অধীনে আসে। অষ্টম শতাব্দীতে লালমাই ময়নামতি দেব বংশ এবং দশম থেকে একাদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চন্দ্র বংশের শাসনাধীনে ছিল। ১৭৬৫ সালে এ অঞ্চলটি ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে আসে। ১৭৯০ সালে জেলাটি ত্রিপুরা জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬০ সালে এর নাম পরিবর্তন করে কুমিল্লা রাখা হয়। ১৯৮৪ সালে কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা পৃথক জেলায় পরিণত হয়।

0 facebook: