20 July 2013

কুমিল্লার ‘সাপ্তাহিক আমোদ’


তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানের ছোট্ট জেলা শহর কুমিল্লা থেকে শুধুমাত্র খেলাধুলার বিষয় নিয়ে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা চালান অচিন্তনীয় ব্যাপার ছিলআমোদনামের সেই খেলাধুলার পত্রিকাকেই পরবর্তীতে সাধারণ পত্রিকা হিসেবে প্রকাশ ও কত ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, এবং পত্রিকাটি প্রকাশের ক্ষেত্রে কত বাধা বিপত্তির সম্মুখিন হতে হয়েছে এ বিষয় গুলোই এই এ্যসাইনমেন্টে আলোচনা করা হয়েছেএছাড়াও বাংলাদেশে আঞ্চলিক সংবাদপত্রের বিভিন্ন সমস্যার কথা সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে এই এ্যাসাইনমেন্টটি করতে গিয়ে আমি আঞ্চলিক সংবাদপত্রের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে জানতে পেরেছিএছাড়াও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি পিআবি-র লাইব্রেরিয়ান নাজিম সাহেবের প্রতিআমোদসম্পর্কে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন আমোদের রিপোর্টার ইমরুল কবির সাহেব, তাকেও ধন্যবাদ জানাই



আমোদএর সম্পাদক সম্পর্কে কিছু কথাঃ

আমোদএর প্রতিষ্ঠাতা প্রকাশক-সম্পাদক মোহাম্মদ ফজলে রাব্বি ১৯৪৫ সালে বৃটিশ ভারতে ত্রিপুরা জেলার অর্থাৎ বর্তমান বৃহত্তর কুমিল্লা মুসলিম লীগ ন্যাশনাল গার্ড বাহিনীর সালার-ই-জিলা, (জিলা কমান্ডার) নির্বচিত হনতখন ঘুনাক্ষরে ও ভাবতে পারেন নি যে রাজনৈতিক জীবনের প্রবল নেশা কাটিয়ে তিনি একদিন সাংবাদিক হবেন,অথবা পত্রিকার সম্পাদক হবেনসালার-ই-জিলার দায়িত্ব পালনের পর ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের দেশ রক্ষা বাহিনীর অফিসার্স ট্রেনিং স্কুলে ৬ষ্ঠ কোর্সে শিক্ষা লাভের পর কমিশন লাভ করেন এবং ৫২ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছর লেফটেন্যান্ট পদে চাকরি করেন৫২ সালে সামরিক বাহিনী থেকে বিদায় নিয়ে ৫৫ সালের ৫ই মে আমোদপ্রকাশের আগ পর্যন্ত তিনি তার পরবর্তী জীবনের লক্ষ্য স্থির করা নিয়ে দ্বীধা-দ্বন্দ্বে ভোগেনতার পর মৃত্যুও আগ পর্যন্ত আমোদের সাথেই ছিলেনআমোদের এর প্রতিষ্ঠাতা ফজলে রাব্বী ১৯৯৪ সালের ২৮ নভেম্বর ইহলোক ত্যাগ করেন
এরপর আমোদের দায়িত্ব নেন তার সহধর্মিণী শামসুন নাহার রাব্বী ও ছেলে বাকীন রাব্বীপারিবারিক ভিত্তিতে পত্রিকা চালানোর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আমোদতার স্ত্রী, ছেলে এবং ৩ মেয়ে মিলে সংবাদ সংগ্রহ থেকে শুরু করে প্রুফ দেখা, প্রেস চালানো, পত্রিকা বাইন্ডিং এবং পেস্টিং এর কাজও করেছেনপ্রথমদিকে বৃহত্তর নোয়াখালী এবং সিলেটেও আমোদ-এর সার্কুলেশন ছিলমানুষের ব্যক্তিজীবনের সুখ-দুঃখের সঙ্গে জাতীয় জীবনের বিশেষ মুহূর্তেও আমোদ কাণ্ডারির ভূমিকা পালন করেছেবিশেষ করে ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০-এর নির্বাচন, ৭১-এর অসহযোগ আন্দোলন তথা মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে
আঞ্চলিক সংবাদপত্র হিসেবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখার কারণে আমোদতার যোগ্য স্বীকৃতিও পেয়েছেজাতিসংঘের অঙ্গ সংগঠন ইউনেস্কো কর্তৃক এশিয়ার পাঁচটি সেরা আঞ্চলিক পত্রিকার একটি হিসেবে আমোদ স্বীকৃতি লাভ করে


আমোদপ্রকাশের পটভূমি ও নাম করণঃ

আমোদ প্রকাশের পটভূমি সম্পর্কে জনাব ফজলে রাব্বি তার লেখা গ্রন্থ কাগজের নৌকায় বলেন-১৯৪৬ সালের দিকে একদিন কোলকাতায় তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার শিক্ষামন্ত্রী আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয়, খান বাহাদুর মোয়াজ্জেম উদ্দীন সাহেবের বাড়িতে যাই নিজের একটা প্রয়োজনেতিনি তখন তাঁর বাড়ির অফিস রুমে বসে কি যেন ডিকটেশন দিচ্ছিলেনএমন সময় দুজন লোক এসে তাঁর সাথে কিছু বলে তা নোট বইয়ে টুকে নিয়ে গেলেনতাদের একজন কুমিল্লার চর্থার গনি সাহেবগনি সাহেব তখন আজাদ পত্রিকায় কাজ করতেনপরদিন সকালে আজাদ পত্রিকায় দেখলাম তিন কলাম হেডিং দিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য ছাপা হয়েছেসেই সময় সাংবাদিক বা সংবাদপত্রের সাথে জড়িত ছিলাম না বলে ব্যাপারটি আমার কাছে খুব চমকপ্রদ ও আশ্চর্যজনক মনে হয়েছিলমন্ত্রীর সাথে দুচারটে কথা থেকে এত সুন্দর একটা খবর ছাপা হয়ে গেলঘটনাটি আমার মনকে বেশ নাড়া দিয়ে গেল
সে সময় কুমিল্লার খেলার মাঠের প্রতিটি ঘাসের সাথে জনাব রাব্বির যেন মিতালী হয়ে গিয়েছিলতখন মাঝে মাঝে তিনি কুমিল্লার খেলাধুলার অঙ্গনের কিছু কিছু খবর লিখে তৎকালীন ইংরেজী দৈনিক মর্নিং নিউজে-এ পাঠাতেনসে সব খবর ছাপা হত বিশেষ করে ব্যাডমিন্টন খেলার খবরের প্রতি তার বেশ ঝোঁক ছিলকারণ ঐ সময় তিনি নিজে একজন ব্যাডমিন্টন তারকা বলে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন
মর্নিং নিউজে তার পাঠানো খবর ছাপা হতে দেখে তিনি মনে মনে আগ্রহী হয়ে উঠেন এবং মনে মনে একটা খেলাধূলার পত্রিকা বের করার কথা ভাবতে থাকেন ব্যাপারে একদিন তিনি সি ডি এস এর সেক্রেটারী শফিউদ্দিন আহম্মদ ( হারুন মিয়া সাহেব), কুমিল্লা কালেক্টরিয়েট এ, সি-র নওশের আলী সাহেব, পাক ইউনাইটেড ক্লাবের সুলতানুর রহমান সাহেবের সাথে আলাপ করেনতারা জনাব রাব্বির এই চিন্তাধারা লুফে নিলেনএবং বললেন কুমিল্লা খেলাধূলার ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগামী হলেও খেলাধূলার কোন বিস্তারিত খবর কোন পত্রিকায় ছাপায় নাতাদের সহযোগিতা ও পরামর্শে একটি ক্রিড়া বিষয়ক সাপ্তাহিকী প্রকাশের সিদ্ধান্ত হলো কিন্তু পত্রিকাটির নাম কি হবে, কোথা থেকে কেমন করে ছাপা হবে, কারা খবর লিখে দিবে, কে সম্পাদকীয় লিখবে ইত্যাদি এমন হাজারও চিন্তা পেয়ে বসল জনাব রাব্বিকেতখন তার বন্ধুরা এগিয়ে এলেনএকদিন খেলার মাঠে বসেই তাঁর বন্ধু সুলতানুর রহমানের পরামর্শে পত্রিকার নাম ঠিক করে ফেলেন আমোদএভাবেআমোদ”-ই হয়ে গেল কুমিল্লা থেকে প্রকাশিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম ক্রীড়া বিষয়ক সাপ্তাহিকীর নাম

আমোদএর সংগ্রামঃ

রাজধানী শহরের বাইরে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলো প্রধানত যে সকল সমস্যায় আক্রান্ত হয় তার মধ্যে রয়েছে- অর্থ সংকট, অনুন্নত প্রযুক্তি ও অদক্ষ কর্মীএছাড়াও সময়ে সময়ে বিভিন্ন পর্যায় থেকে হামলা-মামলা, হুমকি ও বিভিন্ন চাপের মধ্যে থেকে পত্রিকা প্রকাশ করতে হয়কুমিল্লা থেকে প্রকাশিতআমোদও এর ব্যতিক্রম কিছু নয়আমোদপ্রকাশের ক্ষেত্রে যে সকল বাধা-বিপত্তির সম্মুখিন হয়েছে তার কিছু কিছু নিচে আলোচনা করা হলো-

আমোদএর আর্থিক দৈন্যঃ

পূর্বে একটা কথা প্রচলিত ছিল যে, teachers & editors are always poor. অবশ্য বর্তমানে এর উল্টোটাই দেখা যাচ্ছে
স্থনীয় পর্যায় থেকে যারা সংবাদ পত্র প্রকাশ করেন এদের অনেকেই মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে আসা কিছু সচেতন উৎসাহী ব্যাক্তি
আমোদেরসম্পাদক প্রকাশক জনাব ফজলে রাব্বি বলেন আমোদকে কারো সাহায্য ছাড়াই চালাবার একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলাম.......আমোদের উপার্জনেই আমোদ চালাবো এবং আমিও চলবোসম্পাদকের এই সিদ্ধান্তের কারণে আমোদকে অনেক বাধার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছেআমোদ প্রকাশে বাধা হয়ে দাড়িয়েছিল এরকম আর্থিক সংকটের কিছু উদাহরণ তুলে ধরা হলো-


ক্যমেরা সংকট ও সেনা প্রধানের ছবি তোলার বিপত্তি :

১৯৫৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মোহাম্মদ মুসা কুমিল্লায় আসেনবিমান বন্দরে তার খবর সংগ্রহ ও ছবি তুলতে আমোদ সম্পাদক নিজেই যানঘটনা হলো যখন সেনা প্রধান বিমানের সিঁড়ি থেকে নামছিলেন তখন তার কয়েকটি ছবি তোলেনকিন্তু যখন সেনা প্রধান প্যরেডে সালাম গ্রহন করছিলেন তখন সম্পাদক মহা বিপদে পড়েনতার ধার করে আনা অন্যের ক্যমেরাটি হঠাৎ করে বিকল হয়ে পড়েতখন দুঃশ্চিন্তায় অসহায় জনাব রাব্বি ছবি তোলার ভান করে কোন রকমে সেদিনের মত পার পেয়ে যানআর্থিক সংকটের কারণে ভালো একটি ক্যমেরার অভাবে সেদিন তাকে এই দুরবস্থায় পড়তে হয়েছিল
জনাব ফজলে রাব্বি তার লেখা কাগজের নৌকায়লেখেন পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে যখন আমোদ নিজ গতিতে চলতে থাকে, তখন এর পরিচালনায় দৈন্য ভাব প্রকট ভাবে দেখা দেয়আনুষঙ্গিক অনেক কিছুরই প্রয়োজন অনুভব করছিলামতখন একদিন আমোদের পরম হিতাকাঙক্ষী ,এক কালের বিপ্লবী নেতা অতীন্দ্র মোহন রায়ের বাসায় বসে আমোদ পরিচালনার কথা আলোচনা করেছিলামবলতে গিয়ে অনেকটা আবদারের সাথে বলেছিলাম, এখন আমার একটি টেলিফোন, একটা ক্যমেরা ও একটা টাইপ রাইটার মেশিনের খুব দরকার

আর্থিক অনটনের কারণে বড় আকারে আমোদছাপাতে ব্যর্থ:

আমোদ প্রকাশের পর দীর্ঘ ১২ বছর পর্যন্ত শহরের বিভিন্ন প্রেসে ঘুরে ঘুরে পত্রিকা ছাপান হয়সম্পাদক মাঝে মাঝে ঈদ, স্বাধীনতা দিবস ইত্যাদি বিশেষ বিশেষ দিনে বড় আকারে আমোদ প্রকাশ করতে চাইতেন; কিন্তু সেই সময় বাদুড় তলাস্থ সিংহ প্রেস ছাড়া শহরে আর বড় কোন প্রেস ছিল নাকিন্তু সেই সিংহ প্রেসের মালিক কখনই সম্পাদকের অনুরুধে বড় আকারে পত্রিকা ছেপে দেন নি

সামরিক আইন:

১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে আইয়ুব খান সামরিক আইন জারির মাধ্যমে দেশের ক্ষমতা ভার নেওয়ার পর সংবাদপত্রগুলোকে সংবাদ লেখার ধারা বদলাতে হয়৫৮ সালের পর বিভিন্ন সময়ে দেশে সামরিক আইন জারী হয়েছেসংবাদপত্র গুলোকে সামরিক আমলে সরকারের বিভিন্ন ধরনের চাপের মধ্যে থেকে কাজ চালিয়ে যেতে হয়েছে


মার্চ-ডিসেম্বর ৭১ এর কিছু ভয়াবহ ঘটনাঃ

১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ ছিল বৃহস্পতিবার, তার আগের দিন বুধবার রাতে যখন আমোদ ছাপা হচ্ছিল তখন দুজন সাধা পোশাকের সামরিক গোয়েন্দা অফিসার আমোদ প্রেসে এসে মেশিন ম্যনকে বিভিন্ন কথা জিজ্ঞেস করতে থাকে, মেশিন ম্যন ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সম্পাদকের কাছে এসে বলে দুজন পাঞ্জাবী লোক এসে আমরা পত্রিকায় কী ছাপছি জানতে চাচ্ছে তখন আমি আসলে আমাকেও তারা একই প্রশ্ন করেপরে পত্রিকার ফাইনাল কপিটি নিয়ে চলে যায়
২৫ মার্চের পর ১০ সপ্তাহ আমোদের প্রকাশনা বন্ধ থাকেতারপরও জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে সামরিক উর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশ এলো শহরে ¯^াভাবিক অবস্থা বিরাজ থাকতে হবেঅন্যন্য প্রতিষ্ঠানের মত প্রেস মালিকদেরও নির্দেশ দেয়া হলো ২৪ ঘন্টার মধ্যে প্রেস খুলে কাজ আরম্ভ না করলে প্রেস বাজেয়াপ্ত করা হবেএই নির্দেশ শুনে প্রেস মালিকদের মাথায় যেন বজ্রাঘাত হলোতারপরও ঝাড়া-মোছা করে প্রেসের দরজা খুলে দিলেনযদিও কোন কাজ ছিল না

১৯৭৫ সালের ১৬ জুনের ঘোষণা:

১৯৭৫ সালের ১৬ জুন বাংলাদেশের চারটি পত্রিকা রেখে বাকি সব পত্রিকা সরকারী ভাবে বন্ধের ঘোষণা দেয়া হয়এই ঘোষণার ফলে অন্য সকল পত্রিকার সাথে আমোদ ও বন্ধ হয়ে যায়এর ফলে আমোদ প্রকাশক এক গভীর সংকটে পড়ে যানতিনি কাগজের নৌকায় লেখেন-স্ত্রী ও চার সন্তান নিয়ে আমি আমোদচালাচ্ছিলাম এবং আমোদই ছিল আমার জীবিকা নির্বাহের একমাত্র উৎস, একমাত্র ব্যবসাএই আমোদ ছাড়া আমার জীবিকা নির্বাহের আর কোন উপায় ছিল নাতাই ছেলে মেয়ে নিয়ে কিভাবে চলব বা অন্য আর কি ব্যবসা করা যায় ঐ মুহূর্তে তা কিছুই ভাবতে পারছিলাম না

পত্রিকায় নাম না আসায় কটু কথা শুনতে হয়:

একটি জনসভার খবরে ভুল বসতঃ সভার সভাপতির নাম বাদ পড়ে যায়বিকালে জনসভা শেষে তাড়াহুড়ো করে খবর লিখে দেনতাই সভাপতির নাম দিতে ভুল হয়ে যায়ঐ সভার সভাপতি ছিলেন সম্পাদকের পুরান বন্ধুঅথচ পরদিন কাগজে তার নাম না দেখে বেশ কিছু কটু কথা শুনাতে কার্পণ্য করেন নি

বিজ্ঞাপন বন্ধ:

একজন বিত্তশালী ব্যাক্তি ও রাজনৈতিক নেতা তিন বছর ধরে নিয়মিত আমোদকে একটি বিজ্ঞাপন দিয়ে সাহায্য করে আসছিলতার এলাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ খবর জনস্বার্থে সংলিত হলেও সেই নেতারস্বার্থের পরিপন্থী ছিলএকদিন ঐ খবরের প্রেক্ষিতে সেই বিত্তশালী নেতার বিরুদ্ধে এক বিরাট গণআন্দোলন হয় আন্দোলনের সাথে আমোদের সংবাদটি জড়িত বলে চাটুকাররা উস্কায়ে দেয়ফলে ঐ নিয়মিত বিজ্ঞাপনটি বন্ধ হয়ে যায়

সাংবদিককে সব জান্তা মনে করা:

আমোদ প্রকাশের সূচনাকালে অর্থাৎ পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে ঐ অঞ্চলের লোকজন খবর, খবরের কাগজ বা সাংবাদিকতা সম্পর্কে খুব একটা সচেতন ছিলেন না ব্যাক্তিগত বা কোন সংগঠনের পক্ষ থেকে কেউ কোন খবর লিখে কাগজের অফিসে পাঠাত নাএমনকি রাজনৈতিক দলগুলো থেকে যে খুব একটা সাড়া পাওয়া যেত তাও নাতেমন কোন ঘটনা ঘটলে সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসীর সাথে কোথাও হঠাৎ দেখা হয়ে গেলে তারা অভিযোগ বা অনুযোগ করে বলতেন, অমুক দিন অমুক জায়গায় এরকম একটা ঘটনা ঘটল আপনি খবরটা ছাপালেন না কেন ?এর উত্তরে বিনয়ের সাথে যদি বলা হত আপনি যদি খবরটা জানাতেন তাহলে অবশ্যই ছাপান হততখন তারা বলে আপনি সাংবাদিক আপনার উচিৎ সব খবরাখবর সংগ্রহ করে কাগজে ছাপানতারা সাংবাদিকদেরকে সবজান্তা মনে করত

পরীক্ষার ফল প্রকাশের কারণে অসুবিধা:

১৯৬৩ সালে কুমিল্লা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের প্রথম পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়সাতচল্লিশ পূর্ব কালে ম্যাট্রিক সহ অন্যান্য পরীক্ষার ফলাফল কোলকাতা ও সাতচল্লিশোত্তর কালে ঢাকার বড় বড় দৈনিক পত্রিকা সমূহে প্রকাশিত হতকুমিল্লা শিক্ষাবোর্ড প্রতিষ্ঠিত হবার পর প্রথম আমোদসম্পাদক পরীক্ষার রেজাল্ট ছাপাবার সিদ্ধান্ত নেনসে অনুযায়ী রেজাল্ট প্রকাশের আগের দিন বিকাল ৪ টায় রেজাল্ট শিট নিয়ে ছাপার কাজ শুরু করেন কিন্তু পূর্ব অভিজ্ঞতা না থকার কারণে কয়েক ঘণ্টা পরেই দেখা গেল প্রেসে অংকের টাইপের টান পড়ছেকারণ রেজাল্টে যে প্রচুর পরিমাণ অংকের টাইপের প্রয়োজনএটা তিনি আগে ততটা ধারনা করতে পারেন নিপরে শহরের অন্যান্য প্রেস থেকে ফিগার টাইপ গুলো ধার করে এনে কাজ চালিয়ে নেন
অসুবিধা হলো পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অফিস থেকে রেজাল্ট শিট দেয়ার সময় বলেছিল কোনমতেই যেন পরদিন সকাল ৬টার আগে রেজাল্ট লীক না হয়, অথচ রেডিওতে রেজাল্ট প্রকাশের খবর প্রচার হওয়ার পর ছাত্ররা-অভিভাবকরা শিক্ষাবোর্ডে ভীড় জমাতে থাকেএদিকে শিক্ষা অফিসের লোকজন নিজেদের গা বাচানোর জন্য আমোদেফল বেরুচ্ছে বলে বলে সব ছেলেদের আমোদ-এর প্রেসে পাঠিয়ে দেয়সন্ধা থেকেই আমোদের অফিসের সামনে ভীড় জমতে থাকেভীড় এমন পর্যায়ে পৌছে যে রাস্তায় যানবাহন ও মানুষের হাটা-চলা বন্ধ হয়ে যায়সেই সময় আমোদ সম্পাদকের ঘর ও প্রেসটি ছিল বেড়ার ঘরছেলেরা বেড়ার ফাঁক দিয়ে তাদের ন¤^রটা জানাবার জন্য অনুরোধ করতে থাকেরাত বাড়ার সাথে সাথে তাদের ভীড় ও অনুরোধের মাত্রা বেড়েই চলছিল
তবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে ছেলেদের চাইতে তাদের অভিভাবক ও শিক্ষকরাই বেশি অধৈর্যের পরিচয় দিয়েছিলেন সেদিন

অসত্যকে সত্য বলে প্রমান করা:

সত্য সংবাদ প্রকাশ করেও অবস্থার চাপে সংশোধনী দিতে হয়েছিল১৯৬৪ সালের কথা, আমোদে একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল কিস্তিতে মনি অর্ডারের টাকা বিলি কাগজের কৌকায় ফজলে রাব্বি লেখেন-সংবাদ প্রেরক আমারই প্রেসের একজন পুরনো কর্মচারীকাজেই সংবাদ কোন মতেই ভুল হতে পারে নাতার মুখ থেকে সংবাদটি শুনে আমি সুন্দরভাবে খবরটি লিখে দেই যে,একটি গ্রামের পোস্টমাস্টার গ্রামবাসীদের মনি অর্ডারের টাকা কিস্তিতে বন্টন করেন এবং অনেক সময় কারো টাকা সম্পূর্ণ পরিশোধও করেন নাএই খবরটি দেখে কুমিল্লা অঞ্চলের পোস্টাল সুপার তার সহকারিকে তাড়াতাড়ি ঘটনাস্থলে সরেজমিনে তদন্তের জন্য পাঠান দুইদিন পর সহকারী পোস্টাল সুপার তদন্ত শেষে ফিরে এসে আমাকে বললেন যে,এবার সেই খবরের সংশোধনী ছাপাতে হবেভদ্রলোক রসিয়ে রসিয়ে আরো বললেন, গ্রামের পোস্ট অফিসের পোস্টমাস্টার সম্পর্কে তদন্ত করতে গেলে ঐ এলাকার চেয়ারম্যান, মেম্বার, শিক্ষক ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ীদের কাছে গেলে সবাই এক বাক্যে পোস্টমাস্টার সাহেবের ভূয়সী প্রশংসা করেনশুধু তাই নয় যে ভদ্রলোকের টাকার জন্য খবরটি পরিবেশন করা হয়েছিল সেই ভদ্রলোকও পোস্টমাস্টার সাহেবের প্রশংসা করেনআমার সংবাদ বাহক প্রেস কর্মচারী জয়নাল মিয়াকে এ কথা জানালে সে অবাক হয়ে যায় এবং ঐ লোককে এ রকম মিথ্যা সাক্ষ্য দেবার কারণ কি জিজ্ঞেস করেন ব্যক্তি ধীরস্থিরভাবে আমার কর্মচারীকে বুঝিয়ে বলে যে, আমি তো এখনও পোস্টমাস্টার সাহেবের কাছে মনি অর্ডারের ২০ টাকা পাওনা আছিতবুও আমাকে তার সম্পর্কে ভাল বলতে হয়েছে এজন্য যে, তিনি এলাকার একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং আমার মাদ্রাসার একজন সদস্যতার বিরুদ্ধে কিছু বললে বা লিখলে আমার চাকরিটাই থাকবে না
পরের সপ্তাহে আমাকে সংশোধনী দিয়ে মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হল বেঁচে গেলেন পোস্টমাস্টার সাহেব, বেঁচে গেলেন মাদ্রাসার ঐ শিক্ষকমাঝখানে আমি ও আমার প্রেসের কর্মচারী মিথ্যাবাদী হলাম

যে খবর দুশ্চিন্তায় ফেলেছিলঃ
সম্ভবত ১৯৬৪-৬৫ সালের দিকে একটি খবর ছাপাতে গিয়ে চরম সংকটে পড়তে হয়েছিল খবরটি ছিল এইরকম-একদিন জনৈক দিন মজুর পুলিশ লাইনের পাশে এক বাড়িতে লাকড়ি কাটতে গিয়ে কিছু ভুল-ত্রæটি বা অন্যায় করলে গৃহকর্তা জনৈক দারোগা সাহেবের মারধোরের ফলে ক্ষীণকায় দিনমজুরটি শেষ পর্যন্ত মারা যায়দারোগার হাতে শ্রমিকের মৃত্যুও খবরটি শহওে বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেসেই সুযোগে জনৈক উদীয়মান তরুণ নেতার নেতৃত্বে শ্রমিকেরা বিভিন্ন শ্লোগান সহকারে এক শোভযাত্রা বের করেস্থানীয় পুলিশ কর্তৃপক্ষ এ ব্যপারটি নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েতারা এ সংবাদটি ধামাচাপা দেবার জন্য পি,পি,জি,পি ও পত্রিকার সাংবাদিকদের সাথে যোগাযোগ করতে থাকে এবং এক পর্যায়ে সংবাদটি চাপা দিতে সংবাদিকদের রাজি করিয়ে ফেলেকিন্তু আমোদে সেটি ছাপিয়ে সম্পাদক খুবই দুশ্চিন্তায় পড়েন

সে দিন যে খবর প্রকাশ করা যায় নিঃ

১৯৬৭-৬৮ সালের দিকে একটি খবর সেদিন আমোদেছাপাতে পারেন নিখবরটি ছিল একটি মুরগি হত্যারজনাব আখতার হামিদ খানের ছোট ভাই কুমিল্লা রাণীর বাজারস্থ মোহাজের কো-অপারেটিভ কারখানার তৎকালীন ম্যানেজারের একটি মুরগি কারখানার পার্শ্ববর্তী জেলা জজ সাহেবের বাংলোয় কে বা কারা হত্যা করেছে বলে কথা কাটাকাটি ও বাকবিতণ্ডা এবং শেষ পর্যন্ত আদালতে গড়ায়খবরটি খুব মুখরোচক হলেও এর সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন এক দিকে সম্পাদকের ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও আমোদের পৃষ্ঠপোষক আখতার হামিদ খান, অপর দিকে জেলা ও দায়রা জজ সাহেব ও সম্পাদকের অত্যন্ত পরিচিত ব্যক্তিশেষ পর্যন্ত এই মামালাটিতে আখতার হামিদ খান সঠিক বিচার পাবেন না বলে মামালাটি ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়

জেলা প্রশাসকের তলবঃ

৫০ দশকের শেষ দিকে ছোট্ট একটি খবরে শহরে বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়কেউ কেউ আমোদ সম্পাদকের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসকের কাছে নালিশ করেএর প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক সম্পাদককে ডেকে পাঠানএভাবে প্রায়ই জেলা প্রশাসকেরা সম্পাদককে ডেকে পাঠাতেন
আবার কোন কোন জেলা প্রশাসক ডেকে তার খবর প্রকাশ করতে বলতেন

উপসংহারঃ

পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম ক্রীড়া সাপ্তাহিক 'আমোদ' এ বছর ৫৮ বছরে পদার্পণ করেছে১৯৫৫ সালের ৫ মে এর যাত্রা শুরু হয়পরে তা সাধারণ সংবাদপত্রে রূপ নেয়প্রথম সংখ্যাটির মূল্য ছিল এক আনাবয়সের দিক দিয়ে সংবাদ, ইত্তেফাক ও অবজারভারের পরেই আমোদের স্থান
জনাব ফজলে রাব্বি আমৃত্যু আমোদের সাথেই ছিলেন১৯৯৪ সালের ২৮ নভেম্বর তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন
তার মৃত্যুর পর আমোদের দায়িত্ব নেন তার সহধর্মিণী শামসুন নাহার রাব্বী ও ছেলে বাকীন রাব্বীপারিবারিক ভিত্তিতে পত্রিকা চালানোর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আমোদতার স্ত্রী, ছেলে এবং ৩ মেয়ে মিলে সংবাদ সংগ্রহ থেকে শুরু করে প্রুফ দেখা, প্রেস চালানো, পত্রিকা বাইন্ডিং এবং পেস্টিং এর কাজও করেছেন প্রথমদিকে বৃহত্তর নোয়াখালী এবং সিলেটেও আমোদ-এর সার্কুলেশন ছিলমানুষের ব্যক্তিজীবনের সুখ-দুঃখের সঙ্গে জাতীয় জীবনের বিশেষ মুহূর্তেও আমোদ কাণ্ডারির ভূমিকা পালন করেছেবিশেষ করে ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০-এর নির্বাচন, ৭১-এর অসহযোগ আন্দোলন তথা মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে
আঞ্চলিক সংবাদপত্র হিসেবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখার কারণে আমোদ তার যোগ্য স্বীকৃতিও পেয়েছেজাতিসংঘের অঙ্গ সংগঠন ইউনেস্কো কর্তৃক এশিয়ার পাঁচটি সেরা আঞ্চলিক পত্রিকার একটি হিসেবে আমোদ স্বীকৃতি লাভ করে


শেয়ার করুনঃ

Author:

কুমিল্লা অঞ্চলটি একসময় প্রাচীন সমতট অঞ্চলের অধীনে ছিল। পরবর্তীকালে এটি ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে যোগ দেয়। খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে কুমিল্লা জেলা হরিকেল অঞ্চলের রাজাদের অধীনে আসে। অষ্টম শতাব্দীতে লালমাই ময়নামতি দেব বংশ এবং দশম থেকে একাদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চন্দ্র বংশের শাসনাধীনে ছিল। ১৭৬৫ সালে এ অঞ্চলটি ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে আসে। ১৭৯০ সালে জেলাটি ত্রিপুরা জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬০ সালে এর নাম পরিবর্তন করে কুমিল্লা রাখা হয়। ১৯৮৪ সালে কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা পৃথক জেলায় পরিণত হয়।

0 facebook: