খন্দকার মোশতাক একটি নাম, নামটি বাঙালীর বুকে গভীরতম ক্ষত, কাঁধে পাপের বিশাল বোঝাসম। পলাশীর যুদ্ধের মীর জাফরের সঙ্গে তার ভীষণ মিল। দুজনই ছিলেন ক্ষমতালোভী ও উচ্চাভিলাসী। মীর জাফরকে বিশ্বাস করে ঠকেছিলেন নবাব সিরাজ-উদ- দৌলা, এর সোয়া দুইশ বছর পর খন্দকার মোশতাককে বিশ্বাস করে ঠকেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। সিরাজের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে মসনদে বসেন মীর জাফর। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বেইমানী করে মোশতাক ক্ষমতায় বসেন। মসনদে বসলেও মীর জাফর যেমন ছিলেন ইংরেজদের হাতের পুতুল, তেমনি মোশতাকও ছিলেন সেনাবাহিনীর বিপথগামী অসৎ অফিসারদের হাতের পুতুল। মীর জাফর আর মোশতাক কেউই গদিতে বেশি দিন থাকতে পারেননি।দুজনের দারুণ মিল, নয় কী?
সোয়া দুইশ বছর আগে মীরজাফর মরেছে কুষ্ঠরোগে পচে গলে একাকী প্রকোষ্ঠে, আর খন্দকার মোশতাকও মরেছে একাকী অন্ধকার ঘরে, আত্মীয়-বান্ধব বিবর্জিত অবস্থায়।
খন্দকার মোশতাক আহমদ ১৯১৮ সালের ৫ মার্চ কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দির দশপাড়া গ্রামে জন্ম নেন। তার পূর্বপুরুষ ঝিনাইদহ থেকে আসে, তার বাবা ছিলো তাবিজ বিক্রেতা। সাধারণ লেখাপড়া শেষে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করেন। ছাত্ররাজনীতিতে তার বিচরণ ছিল। পাকিস্তান আমলে মুসলিম লীগের ছাত্র শাখার নেতৃত্ব শেষে যোগ দেন মূল মুসলিম লীগে। পরে ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দীর হাত ধরে তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগ দেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন উদীয়মান তরুণ এবং ক্যারিশমেটিক নেতা। এ সময় বঙ্গবন্ধুর নজরে আসেন মোশতাক। বঙ্গবন্ধু তার স্বভাবসুলভ ঔদার্য আর ভালোবাসা দিয়ে বুকে তুলে নেন পরবর্তীতে তারই ঘাতক মোশতাককে।
মোশতাকের রাজনৈতিক চরিত্র বলতে আগাগোড়া কিছু ছিল না। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নমিনেশন না পেয়ে হক-ভাসানীর নেতৃত্বের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন। আবার আইন পরিষদে হুইপ পদ পাওয়ার লোভে আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে কৃষক শ্রমিক পার্টির সরকারে ঢোকেন। পরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একসাথে জেলখাটার সুবাদে আওয়ামী লীগ ফিরে ১৯৭০ এর নির্বাচনে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মোশতাক অন্যদের মতো ভারতে পাড়ি জমান এবং মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত হন। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গেও বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন মোশতাক। তিনি মুজিবনগরে বসে মাহবুব আলম চাষী এবং তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করেন। মুক্তিযুদ্ধ বানচাল করে পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশন গঠনই ছিল এই চক্রের মূল উদ্দেশ্য।
একাত্তরে মোশতাকের উদ্যোগে একটি প্রচারপত্র মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিলি করে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়। গুজব ছড়ানো হয়, তাজউদ্দিন পাকিস্তান কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু মুক্তি পাক চান না। তিনি চান পাকিস্তানের জেলে মুজিবের মৃত্যু হোক। এতে তাজউদ্দিন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিজে স্থায়ী হতে পারবেন।
এই ষড়যন্ত্রের দায়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক দূরদর্শী তাজউদ্দিন আহমেদ মোশতাকের ঘনিষ্ঠ সহচর মাহবুব আলম চাষীকে স্বাধীন বাংলা সরকারের পররাষ্ট্র সচিব থেকে বরখাস্ত করেন।স্বাধীন বাংলার প্রতিনিধি হিসেবে মোশতাকের নিউইয়র্ক যাত্রা বাতিল করেন। তার পরিবর্তে বিচারপতি আবু সায়ীদ চৌধুরীকে জাতিসংঘে প্রতিনিধিত্ব করতে পাঠান।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরলে তার পদলেহনকারীতে পরিণত হন খন্দকার মোশতাক। বঙ্গবন্ধুর উদার দৃষ্টিভঙ্গির কারণে মোশতাকের বিরুদ্ধে অভিযোগে কান না দিয়ে তাকে বিদ্যুৎ, সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী এবং পরে বাণিজ্য মন্ত্রী করেন। বঙ্গবন্ধুর সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ভারত নীতিতে মোশতাকের সমর্থন ছিল না।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতের অন্ধকারে একদল কুচক্রী ও বিপথগামী সেনাসদস্যের অভ্যুত্থানে সপরিবারে নিহত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শোকাহত জাতিকে পরদিন শোকের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিল, যখন জানা গেল এই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের পেছনে ছিলেন বঙ্গবন্ধুরই স্নেহধন্য মন্ত্রী এবং নিজ হাতে গড়া নেতা খন্দকার মোশতাক আহমদ। ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর মোশতাক উল্লাস প্রকাশ করে খুনিদের 'সূর্যসন্তান' এবং এই বর্বরতাকে আখ্যা দিলেন 'হিস্টোরিকাল নেসেসিটি' বলে।
ওই দিনই মোশতাক নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে এবং বঙ্গবন্ধুর অপর চার সহচর তথা স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকপাল তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান এবং ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে বন্দী করে জেলে পাঠান। শুধু জেলে পাঠিয়েই ক্ষান্ত হননি খন্দকার মোশতাক। তারই নির্দেশে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেলখানায় হত্যা করা হয় এই চার নেতাকে।
এত কিছুর পরও ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি খন্দকার মোশতাক। ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র তিন মাথায় খালেদ মোশারফের পাল্টা অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন মোশতাক। ৬ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে তাকে বন্দী করা হয়। জিয়াউর রহমান ক্ষমতা গ্রহণ করলে প্রথমে বন্দী থাকলেও পরে ১৯৭৮ সালে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্ত হয়ে ডেমোক্রেটিক লীগ নামে নতুন রাজনৈতিক দল গড়তে গিয়ে ব্যর্থ হন মোশতাক। পরবর্তী ১৮ বছর রোগ-শোক আর একাকিত্বে দিন কাটাতে হয় তাকে।
১৯৯৬ সালের ৫ মার্চ ৭৮ বছর বয়সে নিঃসঙ্গ অবস্থায় একাকী অন্ধকার ঘরে খন্দকার মোশতাক নামের দ্বিতীয় মীর জাফরের জীবনাবসান হয়। মৃত্যুর পরও অন্যসব বেইমানের মতোই মুক্তি পায়নি মোশতাক। ইতিহাসে তার কথা ঘৃণার সঙ্গেই লেখা থাকবে, বাংলার মানুষ ঘৃনার সঙ্গেই তাকে স্মরণ করবে।
0 facebook: