06 March 2017

ভারতখ্যাত কুমিল্লার গীতিকার ও সুরকাররা


আধুনিক বাংলা গানের ইতিহাস দীর্ঘ এবং অনন্য আলোয় উদ্ভাসিত। এই শুভসূচনার জনক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরবর্তীকালে অর্থাৎ তিরিশের দশকে চলচ্চিত্র এসে এই আধুনিকতাকে এমন পর্যায়ে নিয়ে এসেছে যাকে ধুন্ধুমার কাণ্ড বলতে হবে! কথায়, যন্ত্রে আর সুরের আলোকে এমন সব গান সৃজন করেছেন রবীন্দ্র-পরবর্তী একদল গীতিকার, সুরকার ও কন্ঠশিল্পী মিলে, যা একটি সুদীর্ঘ সোনালি যুগ ভারতীয় সাংস্কৃতিক ইতিহাসে।

বিশেষ করে চলচ্চিত্রের জন্য লিখিত গানগুলো এমন একদল সৃজনপাগল প্রতিভাধরদের সময়কে ধারণ করে আছে যা উত্তরকালে আমাদের বড় বেশি স্মৃতিকাতরায় অস্থির করে তোলে, সেই সব গান শুনে আবেগে আপ্লুত হই আজও। একসময় আবার চলচ্চিত্রের বাইরেও একটি রীতি হিসেবে গড়ে ওঠে যেমন দুর্গাপূজার সময় আধুনিক গান রচনা করা। আশির দশক পর্যন্ত শ্রোতারা অধীর প্রতীক্ষায় থাকতেন কলকাতার বাৎসরিক পূজার গান কার কেমন হবে শোনার জন্য!

১৯৩১ সালে ভারতে সবাক্ চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হলে পরে ১৯৩২ সালেই হিন্দুস্থান ও মেঘাফোন রেকর্ড কোম্পানি প্রতিষ্ঠালাভ করে। ১৯৩৫ সালে সেনোলা কোম্পানি। আবার ১৯৩৫ সালেই প্রথম প্লে-ব্যাক প্রথা চালু হয় ‘ভাগ্যচক্র’ চলচ্চিত্র দিয়ে। এর সফল উদ্যোক্তা ছিলেন নীতিন বসু, হীরেন বসু ও পঙ্কজ মল্লিক। প্রথম গানটি ছিল ‘মোরা পুলক যাচি তবু সুখ না মানি’। কন্ঠ দিয়েছিলেন পঙ্কজ মল্লিক ও সুপ্রভা (ঘোষ) সরকার। এই সময় আরও অনেক খ্যাতিমান কন্ঠশিল্পী ও অভিনয়শিল্পী ছিলেন যেমন কানন দেবী, কেএল সায়গল, কমলা ঝরিয়া, মানিকমালা, হরিমতী, যূথিকা রায়, বিনয় গোস্বামী, পাহাড়ি সান্যাল, কৃষ্ণচন্দ্র দে, বীণাপানি, পূর্ণিমা, শৈলদেবী, প্রমথেশ বড়ুয়া, ছায়াদেবী প্রমুখ।

বিশ শতকের প্রথম দিকে সাধারণত বাংলা গান ছিল রবীন্দ্রসঙ্গীত, দ্বীজেন্দ্রগীতি, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত তথা ভক্তিগীতি, কীর্তন, ভজন, টপ্পা প্রভৃতি। সবাক্ চলচ্চিত্র ও গ্রামোফোন কোম্পানির আত্মপ্রকাশের ফলে তিরিশ দশকের মধ্যভাগ থেকে বাংলা গানের ক্ষেত্রে একটি নতুন জোয়ার আসে। অনেক তরুণ আধুনিক গীতিকার ও সুরকারের আবির্ভাব ঘটে। শ্যামাসঙ্গীত ও ইসলামি গানেরও সূত্রপাত এই সময় থেকেই। আধুনিক গান বলতে যা বোঝায় তার শুরু হয়েছিল বাংলা গানের সুরের জগতের বিস্ময়কর প্রতিভাধর দিকপাল কমল দাশগুপ্তর সুরে যূথিকা রায়ের কন্ঠে গীত ‘আমি ভোরের যূথিকা’গানটি দিয়ে ১৯৩৪ সালে, তখন গায়িকার বয়স মাত্র চৌদ্দ আর গানটি লিখেছিলেন জমিদারপুত্র প্রণব রায়।

উল্লেখ্য যে, যাশোহরের সন্তান কমল দাশগুপ্ত পিতার ব্যবসার সুবাদে কয়েক বছর পরিবারের সঙ্গে কুমিল্লায় ছিলেন, ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়ালেখা করেছেন। তখন শচীন দেবদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল কিনা জানি না।

সেই আধুনিক বাংলা গানের মধ্যগগনে অর্থাৎ তিরিশ-চল্লিশ দশকে বাংলা গানে আধুনিকতার আলো যাঁরা জ্বেলেছিলেন তাঁদের মধ্যে প্রথম সারির যে কয়েক জন ছিলেন তাঁদের মধ্যে তৎকালীন ত্রিপুরা রাজ্য তথা কুমিল্লার কতিপয় প্রতিভাধরও অসামান্য ইতিহাস সৃষ্ট করে গেছেন। যা সত্যি অভাবনীয়! তাঁরা হলেন অসাধারণ মেধাবী সঙ্গীতজ্ঞ সুরকার শচীন দেববর্মণ (১৯০৬-১৯৭৫), সুরসাগর হিমাংশু দত্ত (১৯০৮-১৯৪৪) এবং গীতিকার অজয় ভট্টাচার্য (১৯০৬-১৯৪৩) ও সুবোধ পুরকায়স্থ (১৯০৭-১৯৮৪)।

এঁরা যেমন ভারতীয় ধ্রুপদী রাগসঙ্গীত এবং বিদেশি যন্ত্রসঙ্গীতযোগে আধুনিক গান সৃজন করেছেন, তেমনি আবহমান কালের গ্রামীণ সুরধারা যেমন পদাবলি, পল্লীগীতি, ভাওয়াইয়া, মারফতি, বাউল প্রভৃতি নিয়েও কাজ করেছেন। বিদেশি বাদ্যযন্ত্রসমেত নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করেছেন। শচীনকর্তা তো বোম্বের হিন্দিভাষী চলচ্চিত্রে সমতটের পাগলপারা বিরহী বাঁশির সুর, নদীর বর্ষামদির কলতান ব্যবহার করে চমকে দিয়েছেন! হিন্দি চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গীতধারাকেই পাল্টে দিয়েছেন। তাঁদের লিখিত ও সুরারোপিত অসংখ্য গান চিরকালের গান হিসেবে আজও লোকপ্রিয়, অনুকরণীয়, ভবিষ্যতেও তাই থাকবে। একইভাবে তাঁর সুযোগ্য পুত্র পঞ্চম তথা রাহুল দেব বর্মণও বাবার মতোই আজ কিংবদন্তি।

সেই তুলনায় হিমাংশু দত্ত বোম্বে না যাওয়ার কারণে পিছিয়ে পড়েছিলেন সত্য কিন্তু বাংলা গানের জগতে এক উজ্জ্বল সুরজ্যোতিষ্ক হয়ে আছেন এবং থাকবেন। অন্যদিকে বরাবরই আড়ালে থাকা গীতিকারদের মধ্যে অজয় ভট্টাচার্য এবং সুবোধ পুরকায়স্থ যেন বিস্মৃতির আড়ালেই চলে গেছেন।

শচীনদেবকে নিয়ে যত লেখালেখি ও গ্রন্থাদি রচিত হয়েছে তার তুলনায় হিমাংশু, অজয় ও সুবোধকে নিয়ে তেমনটি হয়নি বললেই চলে। ফলে তাঁদের সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য বিস্তারিত তথ্যাদি জানা বড়ই দুষ্কর। সেরকম প্রবীণ সহযোগী, সহপাঠী কিংবা সতীর্থও নেই যাঁদের কাছে তাঁদের সম্পর্কে শোনা বা জানা যাবে। তবে যতখানি জানা যায় সুরকার ও গীতিকার হিসেবে তাঁদের অবদান কুমিল্লাবাসীকে গৌরবান্বিত করে রেখেছে।

স্বদেশী আন্দোলনে উন্মাতাল সেই অস্থির সময়টায় যে সকল গীতিকার মনোমুগ্ধকর চিত্তজয়ী গানগুলো লিখেছেন তাঁদের মধ্যে পথিকৃৎ ছিলেন বাণীকুমার, হীরেন বসু, তুলসী লাহিড়ি, কাজী নজরুল ইসলাম, মনোজ বসু, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রকুমার রায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বিমল ঘোষ, কৃষ্ণধন দে প্রমুখ। কিন্তু তখন গান রচনায় এগিয়ে ছিলেন কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র। তিনি চলচ্চিত্রের সংলাপ এবং কাহিনীও লিখেছেন। তবে গীতরচনায় যে তিনজন অসামান্য জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন তাঁরা হলেন ত্রিরত্ন অজয় ভট্টাচার্য, শৈলেন রায় এবং প্রণব রায়। তাঁদের রচিত অনেক বিখ্যাত গান আজও প্রবীণদের শুধু নয় নবীনদেরও উদ্বেলিত করে। রিমেক গাওয়ার চেষ্টাও অব্যাহত আছে।

এই ত্রিরত্নর মধ্যে অজয় ভট্টাচার্য ছিলেন কুমিল্লা শহরের সন্তান। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আগত অজয় ভট্টাচার্যের বাবা রাজকুমার ভট্টাচার্য কুমিল্লা জজ কোর্টের উকিল ছিলেন। তাঁর তিন ছেলের মধ্যে দুই ছেলেই ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন সাহিত্য, নাট্য ও চলচ্চিত্র জগতে। একজন অজয় ভট্টাচার্য, অন্যজন ইতিহাস-সৃষ্টিকারী সাহিত্য সাময়িকী ‘পূর্ব্বাশা’র সম্পাদক কবি ও সাহিত্যিক সঞ্জয় ভট্টাচার্য। দুই সহোদরই ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। দুজনেই প্রথমে ঈশ্বর পাঠশালার ছাত্র, পরে ভিক্টোরিয়া কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেন। পেশায় অধ্যাপক অজয় ভট্টাচার্য একাধারে ছিলেন কবি, গীতিকার, নাট্যকার, মঞ্চাভিনেতা, অনুবাদক, কাহিনীকার, সংলাপরচয়িতা ও চলচ্চিত্রকার। চলচ্চিত্রের কথা বললে কুমিল্লা শহরের কৃতীসন্তান দাগু বর্ধন ও সুশীল মজুমদার অনুজ ননী মজুমদার কলকাতায় অবিস্মরণীয় ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন চিত্রনির্মাতা হিসেবে।

কুমিল্লা টাউন হল মঞ্চে নিজের লেখা একাধিক নাটক মঞ্চস্থ করে অভিনেতা হিসেবে অজয় ভট্টাচার্য প্রভূত প্রশংসা কুড়িয়েছেন তরুণকালে। তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯২১ সালে যখন অজয় অষ্টম শ্রেণী থেকে নবম শ্রেণীতে উঠলেন তখন তাঁর স্কুল ঈশ্বর পাঠশালায় বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান উপলক্ষে প্রথম নাটক মঞ্চস্থ করা হয়। এই নাটকটির রচয়িতা ছিলেন ছাত্র অজয় ভট্টাচার্য। স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা দানবীর মহেশচন্দ্র ভট্টাচার্যর নির্দেশ ছিল নাটক হবে স্ত্রী চরিত্রবিহীন। কোনো ছেলে নাটকে মেয়ে সাজতে পারবে না। অজয় গিরিশচন্দ্র ঘোষের নাটক সিরাজ-উদ-দৌলা, নবীনচন্দ্র সেনের পলাশীর যুদ্ধ এবং অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় রচিত গবেষণামূলক গ্রন্থাদি থেকে সার সংগ্রহ করে স্ত্রী চরিত্রবিহীন বিদ্যালয়ে অভিনয়যোগ্য একটি নাটক রচনা করেন। তিনিই এই নাটকের প্রধান চরিত্র এবং নির্দেশক। তাঁর কনিষ্ঠ ভাই সঞ্জয় সেনাপতি মোহনলালের ভূমিকায় অভিনয় করে দর্শকবৃন্দকে বিমোহিত করেন। সঞ্জয় তখন মাত্র ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। তাঁর মুখে স্বদেশপ্রেম ও স্বাধীনতা রক্ষার আকুতিতে নিজেকে উৎসর্গ করার দৃঢ় প্রত্যয় উপস্থিত সকলকে অশ্রুসিক্ত করেছিল। এই মুহূর্তে অজয় রচিত নাটকটির নাম পাওয়া যাচ্ছে না তবে ‘সিরাজ-উদ-দৌলা’জাতীয় কিছু হবে। অনায়াসলব্ধ ছিল তাঁর জ্ঞান। ১৬ বছর বয়স থেকেই তিনি কবিতা লিখতেন, ছবি আঁকতেন, গান গাইতেন ও আড্ডায় বন্ধুবান্ধবদের শোনাতেন। বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য সেই সময়কার শিক্ষক ও সহাপাঠীদের বিস্মিত করতো। তাঁর অনুজ সঞ্জয়ের সহপাঠী পরবর্তীকালে ডিপিআই তথা ডিরেক্টর অব পাবলিক ইন্সট্রাকশন, ওয়েস্ট বেঙ্গল সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা অমিয়ভূষণ দত্তগুপ্ত এক স্মৃতিচারণে বলেছিলেন, ‘অজয় ভট্টাচার্যের কাছে শক্ত বলে কোনোকিছু ছিল না।’

কুমিল্লার ত্রিরত্ন হিসেবে অসামান্য সাফল্য লাভ করেছেন গীতিকার অজয় ভট্টাচার্য এবং সুরকার হিসেবে শচীন দেববর্মণ ও হিমাংশু দত্ত। কৈশোর থেকেই তাঁদের ছিল গলায়-গলায় বন্ধুত্ব। সিনেমা তো আছেই, এর বাইরেও অনেক গান অজয় ভট্টাচার্য লিখেছেন আর সেগুলোতে সুর দিয়েছেন বন্ধু শচীন ও হিমাংশু। যেমন ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের গাওয়া অসাধারণ রাগপ্রধান গান ‘যদি মনে পড়ে’ ও ‘শেষের গানটি ছিল তোমারই লাগি’ অজয় ভট্টাচার্যের অমর কীর্তি। তাঁর রচিত গান যেসকল চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলোর কয়েকটি হলো বিদ্রোহ, গৃহদাহ, দ্বীপান্তর, ব্যথার দান, মায়া, দিদি, মুক্তি, অভিজ্ঞান, দেশের মাটি, সাথী, অধিকার, জীবনমরণ, বড়দিদি, ডাক্তার, পরাজয়, শাপমুক্তি, রাজকুমারের নির্বাসন, মায়ের প্রাণ, আলোছায়া, রাজগী, এপার ওপার, রাজ নর্তকী, নিমাই সন্ন্যাস, মহাকবি কালিদাস, ছদ্মবেশী, দোটানা, প্রতিমা, পরভৃতিকা।

তাঁর হৃদয়ছোঁয়া সংবেদনশীল শব্দমালার জন্য রবীন্দ্র-নজরুল-কান্তকবিদের পরবর্তী পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ গীতিকার হিসেবে অসামান্য সফলতা অর্জন করেছেন তিনি। অজয়ের আমলে প্রায় সকল জাঁদরেল সুরকার ও সঙ্গীতজ্ঞ যেমন রাইচাঁদ বড়াল, পঙ্কজ মল্লিক, কমল দাশগুপ্ত, তিমিরবরণ, অনুপম ঘটক, শচীনদেব, হিমাংশু তাঁর গানে সুর দিয়েছেন। অজয় ভট্টাচার্যের বিখ্যাত কয়েকটি গান হলো, দুঃখে যাদের জীবন গড়া, প্রেমের পূজায় এই তো লভিলি ফল, এই পেয়েছি অনলজ্বালা, একটি পয়সা দাওগো বাবু, এ গান তোমার শেষ করে দাও, তোমার কাছে চাইতে বঁধু, পাখি আজ কোন কথা কয়, বাংলার বধূ, আমি বনবুলবুল গাই গান, বিদেশিরে উদাসীরে, একদিন যবে গেয়েছিল পাখি, আজো ওঠে চাঁদ, আমার দেশে যাইও সুজন, যদি মনে পড়ে সেদিনের কথা, যার লাগি মোর, শুধু সুরে সুরে প্রভৃতি। তাঁর রচিত এবং শচীন দেববর্মণ ও হিমাংশু দত্ত সুরারোপিত গান শুনে কবি, গীতিকার ও সুরকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পুত্র দিলীপকুমার রায়ের মতো প্রভূত প্রভাবশালী সঙ্গীতজ্ঞ গুণীজন পরিতৃপ্তি লাভ করে বলেছিলেন, ‘অজয়কুমারের এক-একটি সঙ্গীত এক-একটি কাব্য।’ তাঁর রচিত গীতসংকলন ‘শুকসারী’ থেকে কয়েকটি অধ্যাত্মসঙ্গীত দিলীপকুমার রায় সুদূর দক্ষিণভারতের পন্ডিচেরি শহরে অবস্থিত ঋষি শ্রীঅরবিন্দ ঘোষের আশ্রমে তাঁকে শোনালে পরে শ্রীঅরবিন্দ অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে প্রশস্তিপত্র পর্যন্ত লিখেছিলেন অজয়কে: The songs are very beautiful. Here is evident everywhere in them a delicate psychic inspiration and poetic gift.

অজয় ভট্টাচার্য নিরলস লিখতেন। অনুজ সঞ্জয় ভট্টাচার্যের সাহিত্য কাগজ ‘পূর্ব্বাশা’তে প্রচুর লেখা প্রকাশ করেছেন। তাঁর একাধিক কাব্যগ্রন্থ রয়েছে যেমন 'রাতের রূপকথা', 'রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম', 'তমসা, ঈগল ও অন্যান্য কবিতা', 'সৈনিক ও অন্যান্য কবিতা' উল্লেখযোগ্য। একটিমাত্র উপন্যাস ‘যেথা নাই প্রেম’ সাড়া জাগিয়েছিল। বিখ্যাত ইংরেজ সাহিত্যিক এরিখ মারিয়া রেমার্কের উপন্যাস ‘রোড ব্যাক’ বাংলায় অনুবাদ করে পূর্ব্বাশা কাগজেই প্রকাশ করেছেন। জনপ্রিয় গানের সংকলন ‘আজো ওঠে চাঁদ’ তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়। তিনি প্রায় দুই হাজার গান লিখেছেন বলে জানা যায়, তবে অধিকাংশই সিনেমার জন্য। ১৯৩৯ সালে ‘সুরের লিখন’ নামে তাঁর স্বরলিপি সংকলন প্রকাশিত হয়। সেই সুবাদে তিনি ছিলেন চিত্রগীতির ক্ষেত্রে পৃথিকৃৎ। ১৯৯১ সালে ত্রিপুরা রাজ্যসরকার ত্রিপুরা সঙ্গীত একাডেমী থেকে ‘অজয় ভট্টাচার্য’ নামে একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করে। অনুরূপ শচীন দেববর্মণের নামেও স্মারকগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল জন্মশতবর্ষে। তাঁর সম্পর্কে একাধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে এবং তথ্যাদিও পাওয়া যায়। তাঁকে নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে এবং হচ্ছেও কিন্তু অজয় ভট্টাচার্য, হিমাংশু দত্ত কিংবা সুবোধ পুরকায়স্থ সম্পর্কে আলোচনা খুব একটা দৃষ্টিগোচর হয় না।

অন্যদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আরেক কৃতী সন্তান সুরসাগর হিমাংশু দত্ত যাঁকে কলকাতার ‘সারস্বত মহামণ্ডল’ ১৯৩০ সালে ‘সুরসাগর’ উপাধিতে ভূষিত করে। খুবই বিরল এবং মর্যাদাসম্পন্ন একটি উপাধি। এই উদ্যোগের পেছনে ছিলেন কলকাতার শোভাবাজারের রাজা গোপালকৃষ্ণ দেব। তিনি ছিলেন এই সংস্থার সভাপতি। তখন হিমাংশুর বয়স মাত্র বাইশ বছর। প্রথম জীবনে কলকাতায় পরিচয় ঘটে বিশ্বভারতীর অধ্যাপক পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেনের সঙ্গে। তখন সেন মহাশয় বিখ্যাত বিচিত্রা পত্রিকায় লিখছেন মীরার ভজন নিয়ে প্রবন্ধ ‘মীরার সঙ্গীত জীবন’ আর সেইসব ভজনের স্বরলিপি করছেন হিমাংশু। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও একটি গান ‘সকরুণ বেণু বাজায়ে’র স্বরলিপি করে খ্যাতিমান হন। ঢাকায় পনের বছরের হিমাংশুর কন্ঠে গান শুনে রবীন্দ্রনাথ বিমোহিত হয়ে পড়েছিলেন। পরবর্তীকালে বিচিত্রা পত্রিকায় হিমাংশুর সঙ্গীতবিষয়ক লেখা পাঠ করে রবীন্দ্রনাথ আবারও চমকে ওঠেন এবং কর্মসচিব কবি অমিয় চক্রবর্তীকে দিয়ে তাঁকে আহবান করে এনে কবিও তাঁর সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যুগলবন্দি হন। এমন ঘটনা খুব একটা বেশি ঘটেনি সেই সময়। তাঁর কাব্যসঙ্গীতচর্চা রবীন্দ্রনাথের প্রভাবমুক্ত স্বজাত্যে ভাস্বর ছিল। যেটা তখন ভাবনারও অতীত! ভারতীয় রাগসঙ্গীতের প্রভাব ব্যাপকভাবেই হিমাংশুর ওপর পড়েছিল বলে অনেকেই মনে করেন। রাগসঙ্গীতনির্ভর রোমান্টিসিজম তাঁর সুরে অনায়াসেই কাজ করেছে। কতখানি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল তাঁর সুর সেইসময়কার প্রখ্যাত কন্ঠশিল্পী সুপ্রভা সরকার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ, সর্বশ্রেষ্ঠ বললেও অত্যুক্তি হবে না, সেই সুরস্রষ্টা, সেই মহাগুণী পুরুষটির নাম হিমাংশু দত্ত সুরসাগর।’

কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে ছিল তাঁর গভীর সখ্য। মনে হয় নজরুল কুমিল্লা থাকতেই তাঁদের মধ্যে জানাজানি ছিল, তিনি হিমাংশু ও সুবোধকে কলকাতায় আহ্বান করেছিলেন। নজরুলের লিখিত গানেও সুর করেছেন হিমাংশু। কবি অধ্যাপক বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গেও তাঁর ছিল প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। বুদ্ধদেব এক স্মৃতিচারণে লিখেছেন, ‘সারাদিনের পাট চুকিয়ে কখনো একটু বেশি রাত্রে আসেন তিনি, খুব উৎফুল্ল, কেননা সেদিনই একটি নতুন রচনা সাঙ্গ করেছেন, রাণুকে (স্ত্রী প্রতিভা বসু) শেখান সেই গান।’

কুমিল্লা শহরের ঝাউতলার অধিবাসী সেই তুখোড় আড্ডাবাজ শচীন, অজয়, সঞ্জয়ের সুহৃদ হিমাংশু দত্ত যৌবনে কলকাতায় গীতিকার শৈলেন রায়, প্রণব রায় ও সুবোধ পুরকায়স্থর অনেক গানে সুর দিয়ে সুখ্যাতি লাভ করেছেন। তাঁর সুরে বিখ্যাত সব শিল্পীরা কন্ঠ দিয়ে স্মরণীয় হয়ে আছেন যেমন, হেমন্ত, সন্ধ্যা, মানবেন্দ্র, শ্যামল, প্রতিমা, শিপ্রা বসু, আরতি, কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়, অনুপ ঘোষাল, নির্মলা মিশ্র প্রমুখ। তিনি একাধারে ছিলেন কন্ঠশিল্পী, সঙ্গীত পরিচালক ও সুরকার।

শচীনদেবের সহপাঠী হিমাংশু কৈশোরে ছিলেন কুমিল্লা জিলা স্কুলের ছাত্র। পরে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এই সময় থেকে তাঁর সঙ্গীতজগতে কন্ঠশিল্পী হিসেবে জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাঁর সুরারোপিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘দক্ষযজ্ঞ’ ১৯৩৪ সালে নির্মিত হয়েছিল। এরপর ১৯৩৭ সালে ‘প্রভাস মিলন’। তবে এ দুটিতে তিনি যৌথভাবে সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন। এককভাবে সঙ্গীত পরিচালনা করেন ‘অভিনয়’ ছবিতেই প্রথম। ১৯৩৯ সালে সঙ্গীত পরিচালনা করেন ‘পরশমণি’ ছবিতে। এটাতে শৈলেন রায় রচিত ‘রাতের ময়ূর ছড়াল’ একটি অবিস্মরণীয় চিত্রগীতি। এভাবে তিনি রুক্ষ্মিণী, নন্দিনী, পথ ভুলে, স্বামী স্ত্রী, অবতার, শ্রীরাধা, সমাজ, গৃহলক্ষ্মী, অভিসার, জননী, পাপের পথে, সন্ধ্যা, জীবনসঙ্গিনী প্রভৃতি ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন। সব ছবিতেই সুররচনার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত রেখেছেন। তাঁর জনপ্রিয় কালজয়ী গানগুলোর মধ্যে তোমারই পথপানে চাহি আমার এ পাখি গান গায়-শৈলেন রায় রচিত এবং শ্যামল মিত্র গীত- আজও মানুষের মুখেমুখে ফেরে। অন্যগুলোর মধ্যে চাঁদ কহে চামেলীগো, বিরহিণী চিরবিরহিণী, নিশীথে চলে হিমেল বায়, বর্ষার মেঘ নামে, তব স্মরণখানি, আলোছায়া দোলা, আবেশ আমার যায় উড়ে কোন ফাল্গুনে, খুঁজে দেখা পাইনে যাহার, ডাক দিয়ে যায় কেগো আমায় বাজিয়ে বাঁশি, তুমি তো বঁধু জানো, নতুন ফাগুন যাবে, বর্ষার মেঘ ডাকে ঝড় বরিষণে, মম মন্দিরে, প্রেমের না হবে ক্ষয়, আকাশের চাঁদ মাটির ফুলেতে, আশা পাখি মোর, মনরে তারে বাঁধবি, নবঘন সুন্দর শ্যাম, আজ ফাগুনের প্রথম দিনে উল্লেখযোগ্য। প্রখ্যাত গীতিকার ও গায়ক সুমন চট্টোপাধ্যায় তাঁর একটি গান ‘তোমাকে চাই’-এর একটি জায়গায় গেয়েছেন ‘.....ভুলে যাওয়া হিমাংশু দত্তের সুরে’। এই হিমাংশুই কুমিল্লার গৌরব সুরসাগর হিমাংশু দত্ত। সুমন তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছেন সঙ্গত কারণেই। তরুণ প্রজন্ম তাঁকে জানে না, যেমন জানে না অজয় অথবা আরেক সৃষ্টিপুরুষ জমিদারপুত্র গীতিকার সুবোধ পুরকায়স্থকেও (১৯০৭-১৯৮৪)।

সুবোধ কুমিল্লা শহরেরই আরেক কৃতী সন্তান। একদল সাহিত্য, সঙ্গীত ও নাট্যপাগল তরুণ আড্ডা দিতেন যৌবনে শহরের কান্দিরপাড়সংলগ্ন নজরুল এভিনিউস্থ ‘লক্ষ্মী কেবিন’ চায়ের দোকানে, যার কর্ণধার ছিলেন দীনেশ ও গণেশ দুই ভাই। আড্ডারুরা ছিলেন শচীন দেব, অজয়, সঞ্জয়, সুবীর সেন, সুধীর চক্রবর্তী, অজিতকুমার গুহ, নারায়ণ চৌধুরী, অমিয় চৌধুরী, সত্যপ্রসন্ন দত্ত, সুশীল মজুমদার, ননী মজুমদার, ত্রিদিব দত্ত প্রমুখ। সুবোধ পুরকায়স্থ তাঁদের মধ্যে ছিলেন অন্যতম। তাঁরাই আড্ডা দিতে গিয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ‘পূর্ব্বাশা’ কাগজ প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। কুমিল্লার বিখ্যাত ‘জগৎ সুহৃদ প্রেসে’ সেটা ছাপা হতো, মাঝে মাঝে আরেকটি গৌরবময় প্রতিষ্ঠান ‘সিংহ প্রেসে’ও মুদ্রিত হতো। সেই মেধাবী কবি সুবোধ পুরকায়স্থ ১৯৪৩ সালে যখন বন্ধু অজয় ভট্টাচার্যের অকাল মৃত্যু ঘটে তিনি হিমাংশুর সঙ্গে জুটি বেঁধে অনেক গান সৃজন করেন। তিনিও কুমিল্লা জিলা স্কুলে হিমাংশুর সহপাঠী ছিলেন। হিমাংশুও অজয়ের মতো অকালে মৃত্যুবরণ করেন মাত্র ৩৬ বছর বয়সে। ব্যর্থপ্রেম ছাড়াও নানারকম মানসিক ব্যাধিতে তিনি ছিলেন অসুখী একজন মানুষ। সুবোধের পিতাও ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে এই শহরে এসেছিলেন বলে জানা যায়।

১৯৪৪ সালে সুবোধ প্রথম গান লিখেন ‘সন্ধি’ ছায়াছবির জন্য যার সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন হিমাংশু দত্ত বলে প্রতীয়মান হয়। সুরকার অনিল বিশ্বাসের সুরে ‘শান্তি’ এবং কমল দাশগুপ্তের সুরে ‘চন্দ্রশেখর’ ছায়াছবির জন্য লিখিত তাঁর গীতরচনা ব্যাপক সাফল্য এনে দিয়েছে। তবে সিনেমার গানের তুলনায় সুবোধ পুরকায়স্থ আধুনিক বাংলা গানের জন্য বেশি খ্যাত। তাঁর লিখিত বিখ্যাত গানগুলোর মধ্যে, মেনেছি গো হার মেনেছি- কমল দাশগুপ্ত সুরারোপিত এবং জগন্ময় মিত্রর কন্ঠে গীত- আজও আপ্লুত করে শ্রোতার মনকে; অন্যান্য গানগুলো হচ্ছে, চাঁদ কহে চামেলীগো, হে নিরুপমা, নবজীবনের প্রথম অরুণ প্রাতে, আজি মিলন নিশি ভোরে, জানি জানি গো, তুমি যারে চাও, হৃদয় কাহারে যেন, আজ ফাগুনের প্রথম দিনে প্রভৃতি।

বাংলা গানের জগতে সুবোধ পুরকায়স্থর একটি বিশেষ অবদান হচ্ছে গানের রেকর্ডে গীতিকারদের নাম মুদ্রণের দাবি আদায়ের কাজ সম্পাদন। তিনি একক উদ্যোগে এটা সফল করেছিলেন। যে কারণে আজকে বিস্মৃত অনেক গীতিকারদের নামও আমরা খুঁজে পাচ্ছি পুরনো রেকর্ডে। তা না হলে হয়তো সেসব নাম কালের গর্ভে হারিয়েই যেত। বাংলা সিনেমার গানের তিন দশকে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন অজয় ভট্টাচার্য-শৈলেন রায়-প্রণব রায় ত্রয়ী। যেমনটি পরবর্তীকালের পঞ্চাশ-ষাট দশকের ত্রয়ী জনপ্রিয় গীতিকার ছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, শ্যামল গুপ্ত ও পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়।

শেয়ার করুনঃ

Author:

কুমিল্লা অঞ্চলটি একসময় প্রাচীন সমতট অঞ্চলের অধীনে ছিল। পরবর্তীকালে এটি ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে যোগ দেয়। খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে কুমিল্লা জেলা হরিকেল অঞ্চলের রাজাদের অধীনে আসে। অষ্টম শতাব্দীতে লালমাই ময়নামতি দেব বংশ এবং দশম থেকে একাদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চন্দ্র বংশের শাসনাধীনে ছিল। ১৭৬৫ সালে এ অঞ্চলটি ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে আসে। ১৭৯০ সালে জেলাটি ত্রিপুরা জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬০ সালে এর নাম পরিবর্তন করে কুমিল্লা রাখা হয়। ১৯৮৪ সালে কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা পৃথক জেলায় পরিণত হয়।

1 comment:

  1. এটি প্রবীর বিকাশ সরকারের রচনা। লেখার সাথে তাঁর নামটি দেয়ার অনুরোধ জানাই।

    ReplyDelete