01 February 2016

কুমিল্লা হবে তৃতীয় সমৃদ্ধ জনপদ


শুধু খাদি আর রসমালাই নয়, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও আর্থিকভাবে প্রসিদ্ধ ছিল কুমিল্লা। কিন্তু সেই সোনালি দিন আজ ঠাঁই নিয়েছে ইতিহাসের পাতায়। এখানে এখনো রয়েছে অনেক পুরার্কীতি। কিন্তু গড়ে ওঠেনি পর্যটনের পরিকল্পিত অবকাঠামো। বিমানবন্দর থাকলেও বিমান ওড়ে না চার দশক ধরে। ইপিজেড, বিসিক, স্থলবন্দরসহ ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও এর জন্য উদ্যোগের অভাব রয়েছে। অথচ সুষ্ঠু পরিকল্পনা থাকলে ঢাকা ও চট্টগ্রামের পরেই কুমিল্লা হয়ে উঠতে পারে দেশের সমৃদ্ধ জনপদ। এসব বিষয়, তথা কুমিল্লার সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে বিশিষ্টজনদের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ প্রতিদিন এর কুমিল্লা প্রতিনিধি মহিউদ্দিন মোল্লা
গৌরব ফেরাতে দরকার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত —ড. আলী হোসেন চৌধুরী
জনপদের নাম। পঞ্চম শতকে যখন ইউরোপ অন্ধকারে ডুবে ছিল, তখন এখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ ছিল চট্টগ্রাম, সিলেট ও কুমিল্লা অঞ্চলের আলোকবাতি। ১৯ শতকের প্রথম দিকে বাংলাদেশের মধ্যে একমাত্র কুমিল্লায় থিওসোফিক্যাল লজ নামের সংগঠন গড়ে ওঠে, যে সংগঠনে বিভিন্ন ধর্মের ভালো দিকগুলো নিয়ে আলোচনা হতো। যা সাম্প্র্রদায়িক সম্প্র্রীতি রক্ষায় ভূমিকা রেখেছিল। এসব কথা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, নজরুল গবেষক ড. আলী হোসেন চৌধুরীর। তিনি বলেন, ৭০-এর দশক পর্যন্ত সকালে কুমিল্লার রাস্তায় হাঁটলে বিভিন্ন বাড়ি থেকে গানের রেওয়াজের সুর ভেসে আসতো। কুমিল্লার সন্তান ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, শচীন দেব বর্মণ। তারা তাদের সুরে পৃথিবী মাতিয়েছেন। সে সময় কুমিল্লা শহরের বিভিন্ন মহল্লায় স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ ব্যায়ামাগার গড়ে তুলেছিলেন। আভিজাত্য ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কারণে শহরের প্রায় প্রত্যেক বাড়িতে পুকুর ছিল, ছিল বড় দিঘি। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি থাকায় কুমিল্লায় বিভিন্ন ব্যাংক ছিল। ব্রিটিশ আমলে কুমিল্লায় ১১টি ব্যাংকের প্রধান শাখা ছিল। এগুলোরই শাখা ছিল নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, ভারতের ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গে। তিনি আরও বলেন, আত্মিক উন্নয়ন না হলে কোনো উন্নয়নই কাজে আসবে না। মানের শিক্ষকের অভাবে কুমিল্লা শিক্ষা ক্ষেত্রে পিছিয়ে যাচ্ছে। কুমিল্লায় মাধ্যমিক পর্যায়ে আরও কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন। আর বিত্তশালীরা সহযোগিতা না করলে সাংস্কৃতিক চর্চা টিকিয়ে রাখা যাবে না। সুন্দরের চর্চা অব্যাহত না রাখলে সমাজে অসুন্দরের আধিপত্য বেড়ে যাবে। এজন্য রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বড় ভূমিকা রাখতে পারে। গৌরব ফেরাতে এটাই দরকার।
আবাসিক ব্যবস্থার উন্নয়ন ও নগর জাদুঘর প্রয়োজন — আবুল হাসনাত বাবুল
কুমিল্লায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য পুরাকীর্তি ও দর্শনীয় স্থান। এসব দেখতে কুমিল্লায় প্রতিনিয়িত দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন আসছেন। আবাসিক ব্যবস্থার উন্নয়ন করা এবং একটি নগর জাদুঘর গড়ে তোলা হলে আরও বেশি দর্শনার্থী আসবে। এ বক্তব্য কুমিল্লা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি আবুল হাসানাত বাবুলের। তিনি বলেন, কুমিল্লা নগরীর ধর্মসাগর উত্তরপাড়ে রানীর কুঠি রয়েছে। সেখানে নগর জাদুঘর করা যেতে পারে। জাদুঘরে জেলার পুরাকীর্তি ও দর্শনীয় স্থানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া যেতে পারে। জাদুঘরে ধারণা নিয়ে জেলায় দর্শনার্থীরা ছড়িয়ে পড়তে পারবেন। বিশেষ করে লালমাই পাহাড়, শালবন বিহার, ময়নামতি জাদুঘর, ওয়ার সিমেট্রি, বার্ড, রাজেশপুর ফরেস্টবিট, লাকসামে নওয়াব ফয়জুন্নেছার বাড়ি, মুরাদনগরে অনেকগুলো জমিদার বাড়ি ও কবি নজরুলের স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রামের মাঝামাঝি এবং যাতায়াতে সুবিধা থাকার পরেও পর্যটনে কুমিল্লা পিছিয়ে থাকার কারণ আবাসন ক্ষেত্রে অব্যবস্থা। এ অবস্থায় কোটবাড়ি কেন্দ্রিক আবাসিক হোটেল গড়ে তুলে পর্যটনকে এগিয়ে নেওয়া যেতে পারে। এজন্য প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের এগিয়ে আসতে হবে।
নগরীর জন্য দরকার সুষ্ঠু পরিকল্পনা —আলী আকবর মাসুম
কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন হয়েছে চার বছর হলো। নগরীতে এখন প্রতিযোগিতা করে বাড়ছে সুউচ্চ ভবন। কিন্তু রাস্তা-ড্রেন নির্মাণ, জলাবদ্ধতা ও যানজট নিরসনে তেমন পরিকল্পনা চোখে পড়ছে না। তাই নগরী অপরিকল্পিত বিল্ডিংগুলো কার্যত ‘বিল্ডিংবস্তিতে’ পরিণত হচ্ছে। এ বক্তব্য সচেতন নাগরিক কমিটি কুমিল্লার সভাপতি আলী আকবর মাসুমের। তিনি আরও বলেন, কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের এখনো প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা সৃষ্টি হয়নি। গত চার বছরে জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও নগরবাসীকে নিয়ে কোনো যৌথসভা করেনি কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন। সম্প্রতি নগরীর কান্দিরপাড়ে ফুটপাথের হকার উচ্ছেদ করা হয়েছে। এটা ভালো দিক। তবে সম্প্রতি নগরীর রাস্তা-ঘাটের কাজের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। তিনি বলেন, নগরীতে দ্রুত মানুষ বাড়ছে। কিছুদিনের মধ্যে কুমিল্লা বিভাগ হবে। কুমিল্লাকে বাসযোগ্য নগরী করতে হলে এখনি সুষ্ঠু পরিকল্পনা দরকার।
বিমানবন্দর চালু করতে হবে —মাসুদ পারভেজ খান ইমরান
কুমিল্লা বিমান বন্দর চার দশক ধরে বন্ধ হয়ে আছে। এটি চালু হলে কুমিল্লায় আরও বেশি বিদেশি বিনিয়োগ আসত। বিমান বন্দর সংলগ্ন ইপিজেডে বিনিয়োগ বাড়াতে বিমান চলাচল এখন সময়ের দাবি। কুমিল্লা ইপিজেডে বিনিয়োগ বাড়লে কর্মসংস্থান হতো বিপুল মানুষের। কুমিল্লার অর্থনীতিতে যোগ হতো নতুন মাত্রা। এছাড়া বাংলাদেশের মধ্যে কুমিল্লার সবচেয়ে বেশি মানুষ প্রবাসে অবস্থান করছে। তাদের ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ রুটে বিমান চলাচলে চাহিদা রয়েছে। এসব কথা বলেন কুমিল্লা চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি ও বিসিসিআইর পরিচালক মাসুদ পারভেজ খান ইমরান। তিনি বলেন, কুমিল্লা বিসিকে রাস্তা-ঘাট ও ড্রেনেজ সমস্যার কারণে ব্যবসায়ীরা দুর্ভোগে পড়ছেন। কুমিল্লায় সম্ভাবনাময় স্থলবন্দর রয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে কুমিল্লা। সহজে ঢাকা কিংবা চট্টগ্রাম বন্দরে যাওয়া যায়। এখানে শিল্পখাতে প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। কম মূল্যের শ্রমিক দিয়ে পণ্য উত্পাদনের সুযোগ রয়েছে। তবে সে তুলনায় শিল্পক্ষেত্রে কুমিল্লা অগ্রসর হতে পারেনি। এক্ষেত্রে বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের আরও এগিয়ে আসতে হবে। তাদেরকে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

শেয়ার করুনঃ

Author:

কুমিল্লা অঞ্চলটি একসময় প্রাচীন সমতট অঞ্চলের অধীনে ছিল। পরবর্তীকালে এটি ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে যোগ দেয়। খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে কুমিল্লা জেলা হরিকেল অঞ্চলের রাজাদের অধীনে আসে। অষ্টম শতাব্দীতে লালমাই ময়নামতি দেব বংশ এবং দশম থেকে একাদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চন্দ্র বংশের শাসনাধীনে ছিল। ১৭৬৫ সালে এ অঞ্চলটি ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে আসে। ১৭৯০ সালে জেলাটি ত্রিপুরা জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬০ সালে এর নাম পরিবর্তন করে কুমিল্লা রাখা হয়। ১৯৮৪ সালে কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা পৃথক জেলায় পরিণত হয়।

0 facebook: