25 October 2015

কুমিল্লা হতে পারে সার্ক সাংস্কৃতিক রাজধানী


মোঃ শিহাব উদ্দিনঃ আমরা জানি সার্ক কালচারাল সেন্টার (শ্রীলঙ্কা) ২০১৬ সালে বাংলাদেশের একটি শহরকে সার্ক সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে ঘোষনা করবে। এই শহরটি হতে হবে রাজধানীর বাইরে কোন শহর। সেই শহরকে ঘিরে আয়োজন করা হবে বছরব্যাপী নানা অনুষ্ঠান। এতে যোগ দিবেন সার্কভুক্ত দেশের শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, গবেষক, বুদ্ধিজিবীরা। ইতিমধ্যে ২০১৫ সালের জন্য আফগানিস্তানের ঐতিহাসিক নগরি বামিয়ানকে  সার্ক সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে ঘোষনা করা হয়েছে।  বাংলাদেশের একটি স্থানকে নির্বাচিত করা হলে বহি:বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমুর্তি যেমন উজ্জ্বল হবে তেমনি আমাদের নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাংস্কৃতি ও কৃষ্টিকে বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরার ক্ষেত্র তৈরী হবে। ইতিমধ্যে কুমিল্লা, কুষ্টিয়া ও বগুড়াকে সার্ক সাংস্কৃতিক রাজধানী ঘোষনার জন্য প্রাথমিকভাবে নির্বাচন করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি শহরকে ২০১৬ সালের জন্য সার্ক সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে বেছে নেওয়া হবে। সার্ক সাংস্কৃতিক রাজধানী ঘোষনার জন্য ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাংস্কৃতি ছাড়াও ঢাকা থেকে যাতায়াত, আবাসন, মিলনায়তন, আপ্যায়ন ইত্যাদি বিষয়ও বিবেচনা করা হবে।
সব কিছু বিবেচনায় নিলে কুমিল্লাই সার্ক সাংস্কৃতিক রাজধানী ঘোষনার জন্য যথার্থ হবে বলে আমরা মনে করি। কারণ তুলনামুলক বিচার করলে আমরা দেখতে পাই কুমিল্লায় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতির অনেক নিদর্শন রয়েছে যা বগুড়া ও কুষ্টিয়ায় নেই। তাছাড়া ঢাকা থেকে যাতায়াত, আবাসন, মিলনায়তন, আপ্যায়ন ইত্যাদি বিবেচনায় নিলেও কুমিল্লা এগিয়ে থাকে। ঢাকা থেকে দুরত্ব বিবেচনায় কুষ্টিয়া ও বগুড়ার তুলনায় কুমিল্লা অনেক কাছে। তাছাড়া বর্তমানে চারলেন রোড হওয়ার ফলে বিদেশি অতিথিদের যাতায়াতেও অনেক সুবিধা হবে। কুমিল্লায় বার্ড মিলনায়তনে ১৯৯৬ সালে সার্ক আইন মন্ত্রিদের একটি সম্মেলন এবং ২০০৫ সালে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের আরেকটি সম্মেলন হয়েছিল। তাই মিলনায়তনের জন্য বার্ডের গুরুত্ব অনেক বেশি। এছাড়া কুমিল্লায় রয়েছে নূরজাহান, অফবিট, হাইওয়ে ইন, মিয়ামির মত থ্রি স্টার হোটেল যেখানে রয়েছে আবাসন আপ্যায়ন সহ কোন আর্ন্তজাতিক মানের অনুষ্ঠান করার বিশাল স্পেস। এই রকম কোন কিছু বগুড়া বা কুষ্টিয়ায় নেই। আবাসনের জন্য কুমিল্লা সার্কিট হাউজকেও বিবেচনা করা যেতে পারে। 
ইতিহাস ও এতিহ্যের দিক থেকে বগুড়ায় মহাস্থানগড় ও কুষ্টিয়ায় লালনের আখড়া ছাড়া আর তেমন কিছু নাই। অপরদিকে ঐতিহাসিক স্থানের মধ্যে কুমিল্লায় রয়েছে ময়নামতি প্রত্ততাত্বিক নিদর্শন ও যাদুঘর, লালমাই বোদ্ধ বিহার, শালবন বিহার, আনন্দ বিহার, লালমাই পাহাড়, ময়নামতি পাহাড়, রূপবান মুড়া, চন্ডীমুড়া, কুটিলামুড়া, ইটখোলা মুড়া, রানীর বাংলার পাহাড়, আনন্দ রাজার প্রাসাদ, ভোজ রাজদের প্রাসাদ প্রভৃতি। আরও আছে ত্রিপুরার রাজা মানিক্য রায় বাহাদুরের বাড়ি (রানির কুঠির), ধর্মসাগর দীঘি, বলেশ্বর দীঘি প্রভৃতি। এখানে উল্লেখ্য যে ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘে বাংলাদেশের পঁচিশ বছর পুর্তির অনুষ্ঠানে কুমিল্লার ময়নামতির একটি টেরাকোটা তৎকালিন মহাসচিব কফি আনানকে উপহার দেওয়া হয়েছিল। 
ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতির আরও অনেক নিদর্শন কুমিল্লায় রয়েছে যা বগুড়া বা কুষ্টিয়ায় অনুপস্থিত। যেমন কুমিল্লায় আছে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতি বিজরিত স্থান ও নজরুল ইনষ্টিটিউট। বাংলাদেশ পল্লি উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড), মুঘল শাসন আমলের শাহ সুজা মসজিদ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শহীদদের সমাধি, ঢুলিপাড়ায় মহত্ত্বাগান্ধির স্মৃতিময় অভয়আশ্রম, শতবর্ষ প্রাচীন ভিক্টোরিয়া কলেজ, ১৮ হোলের আর্ন্তজাতিক গল্ফ ক্লাব। আরও আছে রজশেপুর ইকোপার্ক, রুপসাগর পার্ক, ব্লু ওয়াটার পার্ক, ইব্রাহিমপুরের সিমান্তবর্তি শালবন টুরিষ্ট, বোটানিকাল গার্ডেন, মাটিয়ারায় নির্মনাধীন ফ্যানটাসি ওয়ার্ল্ড হিম পার্ক। এসমস্ত স্থান আগত বিদেশি অতিথিদের মুগ্ধ করবে ও তাদের জন্য অনেক আনন্দদায়ক হবে। প্রাচীন সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের মধ্যে আরও রয়েছে খাদি শিল্প, তাঁতশিল্প, কুটির শিল্প, মৃৎ ও কারুশিল্প, রসমলাই মিষ্টি, ময়নামতির শীতল পাটি ইত্যাদি।
এছাড়া কুমিল্লার বিখ্যাত ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন ব্রিটিশ শাসন আমলে একমাত্র নওয়াব উপাধি প্রাপ্ত নওয়াব ফয়জুননেসা, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা মেজর এম এ গনি, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, সচিন দেব বর্মন, রায় বাহাদুর মোহিনি মোহন, আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষার প্রথম প্রস্তাবক রফিক। আরও আছেন বর্তমানে নরওয়ে পার্লামেন্টের লেবার পার্টির প্রভাবশালি সদস্য সায়রা খান।
এই সমস্ত ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ব্যাক্তিত্ব শুধু কুমিল্লাই নয় সমস্ত বাংলাদেশেকে অনেক সমৃদ্ধ করেছে। তাই কুমিল্লাকে সার্ক সাংস্কৃতিক রাজধানী ঘোষনা করা হলে তাতে বাংলাদেশের এক সমৃদ্ধ শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি বিশ্ববাসির সামনে উপস্থাপন করা যাবে। অতএব আমরা ২০১৬ সালের জন্য কুমিল্লাকে সার্ক সাংস্কৃতিক রাজধানী ঘোষনা করার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।


শেয়ার করুনঃ

Author:

কুমিল্লা অঞ্চলটি একসময় প্রাচীন সমতট অঞ্চলের অধীনে ছিল। পরবর্তীকালে এটি ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে যোগ দেয়। খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে কুমিল্লা জেলা হরিকেল অঞ্চলের রাজাদের অধীনে আসে। অষ্টম শতাব্দীতে লালমাই ময়নামতি দেব বংশ এবং দশম থেকে একাদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চন্দ্র বংশের শাসনাধীনে ছিল। ১৭৬৫ সালে এ অঞ্চলটি ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে আসে। ১৭৯০ সালে জেলাটি ত্রিপুরা জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬০ সালে এর নাম পরিবর্তন করে কুমিল্লা রাখা হয়। ১৯৮৪ সালে কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা পৃথক জেলায় পরিণত হয়।

0 facebook: