22 October 2015

মাত্র একটি ঘর চান বীরাঙ্গনা মমতাজ বেগম


শাহাজাদা এমরানঃ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পাক হানাদার বাহিনী আমাদের যে সকল মা-বোনদের উপর অত্যাচার, নিপীড়ন চালিয়েছিলেন তাদেরই একজন হলেন মমতাজ বেগম। বিয়ের মেহেদি তখনো তার হাত থেকে শুকায়নি। স্বামী, শ্বাশুরী ও শ্বশুরবাড়ির স্বজনদের নিয়ে ১৬ থেকে ১৮ বছরের নববধুটি যখন রঙিন স্বপ্নে বিভোর ঠিক তখনি তার জীবনে নেমে আসে অমাবশ্যার কালো আঁধার। যে আঁধারে আঁধারে কেটে গেছে তার জীবনের ৬৫টি বসন্ত। স্বাধীনতার ৪৪ বছরে এসে কুমিল্লা জেলা প্রশাসন থেকে তিনি আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেলেন বীরাঙ্গনা হিসেবে। সাথে সাড়ে পাঁচ শতক জায়গায়ও। কিন্ত অনাবদী এই জমি দিয়ে কি করবেন তিনি ভেবে পাচ্ছেন না। কারণ, ৩ ছেলে, ছেলের বউ, দুই মেয়ে ও স্বামীর সংসারে তার রয়েছে মাত্র একটি দোচালা ঘর। তাই তার আকুতি সে যদি মাত্র আর একটি ঘর পেত তাহলে হয়তো মৃত্যুর আগে ভাল একটি ঘরে, একটু শান্তিতে শুয়ে যেতে পারতো।
বলছিলাম কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার কালির বাজার ইউনিয়নের আনন্দপুর গ্রামের মনু মিয়ার স্ত্রী মমতাজ বেগমের কথা।
মমতাজ বেগম কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার ময়নামতি ইউনিয়নের হরিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা-মার ৭ মেয়ের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। দেখতে শুনতে ভাল। তাই ১৪/১৫ বছরেই বাবা-মা বিয়ে দিয়ে দেন একই জেলার আদর্শ সদর উপজেলার কালিরবাজার ইউনিয়নের পশ্চিম আনন্দপুর গ্রামের মনু মিয়ার সাথে। ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে মমতাজ-মনু মিয়ার দাম্পত্য জীবন শুরু হয়। তখন স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু না হলেও দেশের অবস্থা ভাল ছিল না বলে মমতাজ বেগম জানান। অজোপাড়াগাঁয়ের টু-থ্রি পড়া মেয়ে ঢেড় বুঝতে পারতেন ঢাকায় যে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে তা। তখন সারা দেশেই থমথম অবস্থা বিরাজ করছিল। সেই সময় বিয়ের পর দিনই স্বামীর সাথে শ্বশুর বাড়ি চলে আসেন মমতাজ বেগম।
তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের বৈশাখ মাসের কোন এক সকাল, তখন ৮টা কি ৯ টা হবে। শ্বাশুড়ী, স্বামী ও ভাশুরকে নাস্তা বেড়ে দিচেছন। সবার নাস্তা খাওয়া শেষ। এখন তিনি নাস্তা করবেন। ঠিক এই সময় গ্রামে রটে গেল পাক বাহিনী গ্রামে প্রবেশ করেছে। গ্রামের গরু-ছাগল নিয়ে যাচ্ছে। যুবক ছেলেদের মারধর করছে আর যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচেছ। এ কথা শুনবার পর আমার শ্বাশুড়ী মা বলল, বউ পালাও- একথা বলে তিনি নিজেই দিলেন দৌঁড়। এই বাড়িতে আমি বউ হয়ে আসছি মাত্র ৩ মাস হতে চলল। ভালভাবে সবার বাড়ি ঘর চিনি না। কোন দিকে যাব বুঝতে পারছি না।
নাস্তা আর খাওয়া হল না। দিলাম হরুজী বাড়ির দিকে দৌঁড়। যেই মাত্র হরুজী বাড়ির উঠানে এলাম, ওমা! এসেই দেখি ৭/৮ জন পাক আর্মি আমার সামনে দণ্ডায়মান। দৌঁড়ের কারণে আমি হাঁপাচ্ছিলাম। অমনি একজন আমার চুলের খোঁপা ধরে কি ভাষায় যেন কি বলল, বুঝলাম না। তারা একটি ঘরে নিয়ে আমাকে ব্যাপক নির্যাতন করল। বাপ ভাই ডেকেও তাদের হাত থেকে রেহাই পেলাম না।
এক সময় আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জ্ঞান যখন ফিরে এল তখন দেখি চারদিকে অন্ধকার। চোখের পানি মুছতে মুছতে অজানা আশংকা নিয়ে অনেক রাতে বাড়ি ফিরি। ভাবছি হয়তো আজই আমার সংসার জীবন শেষ। স্বামী আমাকে তাড়িয়ে দেবে। কিন্ত না। ঘরে ঢুকেই দেখি সবাই আমার জন্য অস্থির হয়ে আছে। আমি হাউমাউ করে কেঁদে বিছানায় ঢলে পড়লাম। এমন সময় আমার ভাশুর ফজর আলী, স্বামী মনু মিয়া ও শ্বাশুড়ীসহ সবাই আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, যা ঘটেছে তার বিচার আল্লাহ করবেন। এতে তোমার কোন দোষ নেই। ভোর রাতে বরুড়ায় আমরা সবাই চলে যাব। এই গ্রামে আর না।
মনু মিয়া তার স্ত্রী মমতাজ বেগমকে নিয়ে ভোর রাতেই বাবার ফুফুর বাড়ি বরুড়া উপজেলার কাশেড্ডা গ্রামে চলে গেল। যাতে পাছে লোকে মমতাজ বেগমকে কিছু বলতে না পারে।
দেশ স্বাধীন হলো ১৬ ডিসেম্বর। মনু মিয়া তার স্ত্রী নির্যাতিতা মমতাজ বেগমকে নিয়ে ১৭ ডিসেম্বর সকালে নিজ বাড়ি আনন্দপুর ফিরলেন। মমতাজ বেগম লক্ষ করলেন, এতদিন যারা তাকে আদর করত, ডাক খোঁজ নিত, তারা এখন দূর থেকে তাকে আড় চোখে দেখে। কেউবা তাকে সান্ত্বনার নামে খোঁচা দিয়ে কথা বলে, তার চাপিয়ে রাখা কষ্টকে উসকে দেয়। তবে সান্ত্বনা এই যে, স্বামীর ঘরের কেউ-ই তাকে এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র দায়ী করে নি। বরুং তার প্রতি সহানুভূতি বেড়েছে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার ঘটনাকে শ্বাশুড়ী পাকদের প্রতি আল্লাহর গজব বলে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বিবেচনা করতেন বলে জানালেন মমতাজ।
মমতাজ বেগম আরো বলেন, ’৭১ সালের এই দুঃখজনক ঘটনার কারণে কখনো বেশী মানুষের সামনে গিয়ে দাঁড়াইনি। স্বজনদের নানা অনুষ্ঠানে কাছে যাই নি। যদি কখনো তারা এ প্রসঙ্গে কোন প্রশ্ন করে। কত নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে যে গত ৪৪ বছর ধরে বেঁচে আছি তা কাউকে বুঝাতে পারব না। শুনেছি, এ রকম নির্যাতিত মহিলাদের সরকারের প থেকে বীরঙ্গনা উপাধি দিয়ে নানা সাহায্য সহযোগিতা করছে। কিন্ত গত ৪৪ বছরে কেউ আমাদের খোঁজ নেয় নি।
এবার জেলা প্রশাসন কুমিল্লায় অনুষ্ঠান করে আমার মত আরো ১৪/১৫ জনকে সরকারী খাস জমি দিয়েছে। কিন্ত এ জমি এখন আমাদের কোন কাজে লাগছে না। আবাদ করতে পারছি না।
মমতাজ বেগম বলেন, ৪ মেয়ে ও তিন ছেলের সংসার আমার। স্বামীরও বয়স হয়েছে। কাজ করতে পারছেন না। ছেলেরা একবার কাজ করলে তো আরেকবার কাজ পায় না। আপনি দেখতে পাচ্ছেন এই ছোট দোচালা ঘরটিই আমার একমাত্র সম্বল। আমার ছোট মেয়েটি আফজল খান গার্লস হাই স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। টাকা পয়সার জন্য তার পড়া-লেখার খরচও চালাতে পারি না। এতগুলো মানুষ এই ছোট ঘরটিতে থাকতে পারি না।
এই সমাজের কাছে, সরকারের কাছে আমার একটাই দাবী, দয়া করে আমাকে মাত্র একটি ঘর দিন, যাতে মৃত্যুর আগে ঘরটির নিচে শান্তিতে ঘুমাতে পারি।
স্বামী মনু মিয়া বললেন, ভাই, পাকিস্তানি সৈন্যরা আমার স্ত্রীকে নির্যাতন করায় যতটুকু কষ্ট পেয়েছি তার চেয়ে বেশী কষ্ট পেয়েছি এই দেশের মানুষদের আচরণে, যারা সুযোগ পেলেই এই প্রসঙ্গটি এনে আমাকে খোঁচা দিয়ে কথা বলত। আমাকে অনেকে কটু কথা বলত। আমি কোন দিন তা মনে নেইনি। শুধু বলেছি, আমার স্ত্রীর কোন দোষ নেই। আমার স্ত্রী দেশের জন্য নির্যাতিত হয়েছেন এটাই আমার কাছে গর্বের বিষয়।

শেয়ার করুনঃ

Author:

কুমিল্লা অঞ্চলটি একসময় প্রাচীন সমতট অঞ্চলের অধীনে ছিল। পরবর্তীকালে এটি ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে যোগ দেয়। খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে কুমিল্লা জেলা হরিকেল অঞ্চলের রাজাদের অধীনে আসে। অষ্টম শতাব্দীতে লালমাই ময়নামতি দেব বংশ এবং দশম থেকে একাদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চন্দ্র বংশের শাসনাধীনে ছিল। ১৭৬৫ সালে এ অঞ্চলটি ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে আসে। ১৭৯০ সালে জেলাটি ত্রিপুরা জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬০ সালে এর নাম পরিবর্তন করে কুমিল্লা রাখা হয়। ১৯৮৪ সালে কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা পৃথক জেলায় পরিণত হয়।

0 facebook: