21 October 2015

গাছের ডালে আশ্রয় নিয়েও শেষ রক্ষা পাননি আফিয়া বেগম


শাহাজাদা এমরান: আফিয়া বেগম বলেন, বাবা, একজন নারীর জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ হল তার সতিত্ব। এই সতিত্ব বাঁচানোর জন্য কখনো আম গাছের ডালে, কখনো পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে কচুরী পানা মাথায় দিয়ে, কখনো বা ঘরের ভিতর বাঙ্কার আশ্রয় নিয়ে লুকিয়ে রয়েছি। কিন্ত শেষ রক্ষা করতে পারিনি। বাড়ির পাশে হাসানপুর রেলস্টেশনে ছিল আর্মি ক্যাম্প।
স্থানীয় রাজাকারদের মাধ্যমে পাক আর্মির মানুষ রুপী পশুরা জেনে যায় আমার কথা। তখন আমার বয়স ১৭/১৮ হবে। বিয়ে হয়নি। ২/১ দিন পর পর আমাকে খুঁজতে তারা আমাদের বাড়িতে হানা দিত। যেহেতু বাড়ির কাছেই আর্মি ক্যাম্প তাই তারা আসছে এ খবর পেয়েই আমি লুকিয়ে থাকতাম। ভয়ে সারা শরীর কেঁপে উঠতো। বাবা-মা ও আমি কত যে এক সাথে গলায় ধরে কেঁদেছি তার কোন হিসাব নেই। বিভীষিকাময় সেই অবস্থা থেকে বাঁচার জন্য মাঝে মাঝে ফাঁস দিয়ে মরে যেতে ইচ্ছে করত। কিন্ত মা’র জন্য পারিনি। মা সব সময় পাহাড়া দিয়ে রাখত। এখন ভাবছি সেদিন মরে গেলেও ভাল হতো। তা হলে আজ তিন বেলা ভাত খাওয়ার জন্য আর রাতে ঘুমানোর জন্য চিন্তা করতে হতো না।
আমাদের ছোট একটি ঘর ছিল। ঘরের ভিতর বাঙ্কার ছিল। যখনি শুনতাম পাক আর্মি আসছে দৌঁর দিয়ে বাঙ্কারে উঠে যেতাম। তারা আমাকে সারা ঘর খুঁজে না পেয়ে বাবাকে মারধর করে চলে যেতো। অনেক দিন তাদের আগমনের কথা শুনলে ঘরের পিছনে একটি বড় আম গাছ ছিল সেই গাছে প্রচুর ডাল ছিল।  সেই গাছে উঠে ডালার পাতা দিয়ে নিজকে লুকিয়ে রাখতাম। একদিন আমরা সবাই সকালে নাস্তা খাব। এমন সময় খবর এল পাক আর্মি আমাদের বাড়ির প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে। দৌঁড় দিয়ে পুকুরে লাফ দিয়ে কচুরি পানার মধ্যে লুকিয়ে রইলাম। এ দিন আমাকে না পেয়ে বাবার সাথে মা-কেও বেধরক মেরেছিল। এ বাড়ি ঐ বাড়ি গিয়েও অনেক লুকিয়ে ছিলাম। গরিব মানুষ, কোথাও যাওয়ার নেই। রাতে প্রায় ঘরের বাঙ্কার ঘুমাতাম। কিন্ত এত কিছু করেও আমি আমার ইজ্জ্বত রক্ষা করতে পারিনি।
আমাকে যখন তারা কোন মতেই ধরতে পারছিল না তখন সোর্স হিসেবে নিয়োগ করল স্থানীয় এক রাজাকারকে। একদিন সকালে পুকুর পাড়ে থালা-বাসন পরিষ্কার করছি এমন সময় রাজাকারের মাধ্যমে খবর পেয়ে তারা আমাকে ধরে নিয়ে গেল হাসানপুর রেলস্টেশনের ক্যাম্পে। বাঁধা দেওয়ায় আমার সামনেই বাবা-মাকে প্রচণ্ড মারল। হাসানপুর ক্যাম্পে নিয়েই চালাল নির্মম নির্যাতন-এ কথা বলেই অঝোর ধারায় কান্না শুরু করল নাঙ্গলকোট উপজেলার ঢালুয়া ইউনিয়নের মোগরা গ্রামের আলতাব আলী ও নুরুন নাহারের দ্বিতীয় মেয়ে আফিয়া বেগম। পিতা-মাতার ২ ছেলে ও ৪ মেয়ের মধ্যে আফিয়া বেগম দ্বিতীয়। বড় বোনের আগেই বিয়ে হয়ে যাওয়াতে রক্ষা পেয়েছে সে।
আফিয়া বেগম জানালেন, পাক বাহিনীর অত্যাচারের ক্ষত নিয়ে যখন বাড়ি ফিরলাম সেদিন বাবা-মা ছোট ভাই-বোনেরা আমাকে জড়িয়ে ধরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে অনেকক্ষন কাঁদলেন। কিন্ত আমি কাঁদিনি। নীরব পাথরের মত অনেক দিন চুপ করেছিলাম। আত্মহত্যা করতে পারি আঁচ করতে পেরে অনেক রাত আমাকে পাহারা দিতেন মা। আশেপাশের লোকজন আমাকে বাঁকা চোখে দেখতো। সমাজে বাবা-মাকে ঘৃণা করত। চোখের সামনে সব দেখতাম। বিয়ে এলেই পাক বাহিনীর অত্যাচারের কথা শুনে বিয়ে ভেঙ্গে যেত।
স্বাধীনতার দেড় বছর পর পার্শ্ববর্তী ইউনিয়নের বক্সগঞ্জের টুনু মিয়ার সাথে আমার বিয়ে হয়। টুনু মিয়া ঢাকায় তিব্বতে ভাল চাকুরী করত। পাক বাহিনীর নির্যাতনের কথা জেনেও টুনু মিয়া বিয়ে করেছিল। কিন্তু বিয়ের পর আমার শ্বাশুড়ী, শ্বশুর, দেবর ও ননদরা কথায় কথায় খোটা দিত। অসতী বলে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলত। প্রথম প্রথম স্বামী তাদের পক্ষ না নিলেও এক পর্যায়ে তাদের পক্ষ হয়ে সেও আমাকে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন শুরু করল। এর মধ্যে আমার দুটি মেয়ে হয়। বড় মেয়ের বয়স তিন বছর আর ছোট মেয়ের বয়স যখন ৩ মাস তখন আমাকে এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। এই যে স্বামী ও দুই মেয়েকে হারালাম আজো জানতে পারি নি তারা কোথায় আছে।
প্রায় ৮/১০ বছর পর বাবা আবার আমাকে বরিশালের একটি ছেলের সাথে আবার বিয়ে দেয়। দ্বিতীয় স্বামীর ঘরে একটি ছেলে হয়। তারপর স্বামী যে কোথায় গেল জানি না। বর্তমানে বেঁচে আছে না মরে গেছে তাও বলতে পারব না।
আফিয়া বেগমকে এলাকাবাসী চাঁদা তুলে স্থানীয় একজনের একটি খালি জায়গায়  ভাঙ্গা  ঘর তুলে দিয়েছে। কিন্ত বৃষ্টি-বাদল এলে এই ঘরটি আর ঘর থাকে না। সমস্ত ঘর পানিতে সয়লাব হয়ে যায়। বর্তমানে জায়গার  মালিক আফিয়া বেগমকে নোটিশ দিয়ে বলেছে, দ্রুত জায়গায় ছেড়ে দিতে নতুবা তাকে উচেছদ করা হবে। অসুস্থ্য ও বয়সের ভারে নূহ্য আফিয়া বেগম এ কথা বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন।
এক বুক হতাশা নিয়ে বীরাঙ্গনা আফিয়া বেগম বললেন, বাবারে, স্বাধীনতার পর অনেকেই বলেছে, সরকার আপনাকে বীরাঙ্গনা উপাধী দিবে। আপনি বড়লোক হয়ে যাবেন, ঘর বাড়ি টাকা পয়সা সব পাবেন। গত ৪৪ বছর ধরে এই স্বপ্ন দেখেই আসছি। কিন্তু বাস্তবে কোন ফল পাচ্ছি না। আর  কবে যে পাব আল্লাহই ভাল জানেন। এই ৪৪ বছরে আজ পর্যন্ত সরকার তো দূরের থাক এলাকার একজন মেম্বারও স্বাধীনতা যুদ্ধে আমার এ ত্যাগের কথা স্মরণ করল না।
চলতি বছর কুমিল্লা জেলা প্রশাসন থেকে বীর নারী মুক্তিযোদ্ধা তথা বীরাঙ্গনাদের কুমিল্লায় নিয়ে আপনাদের  যে সম্মান জানাল এবং উপজেলার চরজামুরাইল মৌজার ১নং খতিয়ানের ৪৪ দাগের ০.০৮ শতক জায়গা দিল এ কথা স্মরণ করিয়ে দিলে বীরাঙ্গনা আফিয়া বেগম ক্ষোভের সাথে বললেন, বাবা, আমাকে যেখানে জায়গায় দিয়েছে, প্রথমেই বলতে পারি এটা দিয়ে কোন কাজে আসবে বলে মনে হয় না। আমাদের গ্রাম থেকে অনেক দূরে। বার মাসের মধ্যে এগার মাস থাকে পানি। আর জায়গাটি যার দখলে আছে সে বলে দিয়েছে এ জায়গায় আসলে আমাকে প্রাণে মেরে ফেলবে।  ভিক্ষা করে করে ২ বারে ২ হাজার করে ৪ হাজার টাকা দিয়েছি অফিসারকে মেপে দেয়ার জন্য।
আফিয়া বেগমের শেষ অনুরোধ, বাবা, আমি সরকারের কাছে আর জীবনে কিছুই চাই না। আমার জীবন তো শেষ। যদি পারেন তাহলে একটু লিখে দিবেন, সরকার যেন, আমাকে মরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত পেট ভরে তিন বেলা খাওয়ার আর রাতে ঘুমাবার ব্যবস্থা করে দেন।

শেয়ার করুনঃ

Author:

কুমিল্লা অঞ্চলটি একসময় প্রাচীন সমতট অঞ্চলের অধীনে ছিল। পরবর্তীকালে এটি ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে যোগ দেয়। খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে কুমিল্লা জেলা হরিকেল অঞ্চলের রাজাদের অধীনে আসে। অষ্টম শতাব্দীতে লালমাই ময়নামতি দেব বংশ এবং দশম থেকে একাদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চন্দ্র বংশের শাসনাধীনে ছিল। ১৭৬৫ সালে এ অঞ্চলটি ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে আসে। ১৭৯০ সালে জেলাটি ত্রিপুরা জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬০ সালে এর নাম পরিবর্তন করে কুমিল্লা রাখা হয়। ১৯৮৪ সালে কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা পৃথক জেলায় পরিণত হয়।

0 facebook: