28 September 2015

কুমিল্লার মাতৃভান্ডারের আসল রসমালাই চিনে রাখুন !


বিশেষ প্রতিবেদনঃ যুগ যুগ ধরে রসমালাই-এর জন্য বিখ্যাত কুমিল্লা। ঐতিহ্যবাহী এ মিষ্টান্ন এখন নকলের ভিড়ে আসল পাওয়া দায় হয়ে পড়েছে। প্রায় শত বছর পূর্বে ‘মাতৃভাণ্ডার মিষ্টান্ন’ প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু বর্তমানে শহরের আনাচে কানাচে ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে গড়ে উঠেছে অগণিত রসমালাই বিক্রয়কারী দোকান। যাদের প্রত্যেকেরই দাবি তারাই একমাত্র ও আসল মাতৃভাণ্ডার। তবে মূল প্রতিষ্ঠানের দাবি মূল বিক্রয়কেন্দ্র ছাড়া কোথাও তাদের আর কোনো শাখা বা বিক্রয়কেন্দ্র নেই। তাই এসব দোকান থেকে রসমালাই কিনে প্রতারিত হচ্ছেন সাধারণ ক্রেতারা।


রসমালাইয়ের ইতিহাস ঘেঁটে জানা গেছে, উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ঘোষ সম্প্রদায় দুধ জ্বাল দিয়ে তাতে ছোট রসগোল্লা ভিজিয়ে বিক্রি করতো তা ক্রমে রসমালাই নামে পরিচিতি পায়। এরপর থেকেই কুমিল্লার যেকোনো উৎসব বা অনুষ্ঠানে রসমালাই একটি অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে পরিচিতি পায়। কেউ কুমিল্লায় বেড়াতে এলে এই মিষ্টান্নের স্বাদ চেখে দেখতে ভুল করেন না। বাসায় ফেরার সময় প্রিয়জনের জন্যও নিয়ে যান অনেকে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রথমে ‘মাতৃভাণ্ডার’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান এই ঐতিহ্যবাহী রসমালাই বিক্রি করা শুরু করে। এটি মহানগরীর মনোহরপুরে অবস্থিত। ক্ষণী সেন ও মণি সেন নামের দুই ভাই এই মিষ্টান্ন তৈরি ও বিক্রি করতেন। বর্তমানে ১০ জন কারিগর ভোর থেকেই রসমালাই তৈরিতে সহায়তা করতে সেখানে। এছাড়া সেখানে প্রতিদিন প্রায় ৫ মণ রসমালাই তৈরি করা হয় বলে কারিগর সূত্রে জানা গেছে। এছাড়া ‘ভগবতী পেড়া ভাণ্ডার’, ‘শীতল ভাণ্ডার’, ‘পোড়াবাড়ী’ ও ‘জলযোগ’ নামে প্রতিষ্ঠানের তৈরি রসমালাইও প্রসিদ্ধ।


রসমালাইয়ের সুখ্যাতিকে পুঁজি করে অনেক অসাধু ব্যবসায়ী জড়িয়ে পড়েছে নকল রসমালাই উৎপাদন ও বিক্রিতে । মাতৃভাণ্ডার যেখানে ১ মণ দুধ থেকে ১৪/১৫ কেজি রসমালাই তৈরি করে, সেখানে নকল দোকানিরা গরুর দুধের সাথে গুড়া দুধ মিশিয়ে ১ মণ দুধ থেকে উৎপাদন করে প্রায় ৩০ কেজি রসমালাই। এতে করে নষ্ট হয় রসমালাইয়ের স্বাদ ও গুণগত মান ।
স্থানীয় ব্যবসায়ী হরনাথ পোদ্দার জানান, সেনানিবাস থেকে পদুয়ার বাজার পর্যন্ত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে গড়ে উঠেছে অসংখ্য রসমালাই বিক্রয়কারী দোকান। প্রায় সবগুলোতেই বিশাল বিশাল সাইনবোর্ডে লেখা ‘কুমিল্লার মাতৃভাণ্ডারের আদি ও একমাত্র রসমালাই’। আবার অনেকগুলোতে মাতৃভাণ্ডার নামের আগে ‘আদি’, ‘নিউ’, ‘নিপা’, ‘প্রয়োজনীয়’ ইত্যাদি শব্দ জুড়ে দিলেও আকারে এতই ছোট যে এগুলো খুব সহজেই সাধারণ ক্রেতাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। এসব দোকান মালিকদের সবারই দাবি তাদের দোকানে আসল রসমালাই পাওয়া যায়।
স্থানীয় বাসিন্দা লোকমান মিয়ার অভিযোগ, এসব দোকানে খুবই নিম্নমানের রসমালাই বিক্রি করা হয়। এসব দোকানে যে স্থানে কারিগররা রসমালাই তৈরি করে সেখানকার পরিবেশ খুবই নোংরা এবং অস্বাস্থ্যকর। এসব দোকান থেকে রসমালাই কিনে ক্রেতারা সহজেই প্রতারিত হচ্ছেন। এতে করে নষ্ট হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী কুমিল্লার রসমালাইয়ের সুনাম ও গৌরব।
এসব ব্যাপারে মাতৃভাণ্ডারের ব্যবস্থাপক অনুপম দাস পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, “মাতৃভাণ্ডারের কোথাও কোনো শাখা নেই। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী মাতৃভাণ্ডারের নাম ভাঙিয়ে দিব্যি জনসাধারণের সাথে প্রতারণা করে যাচ্ছে। অন্যরা যে প্রক্রিয়ায় রসমালাই তৈরি করে এতে রসমালাইয়ের প্রকৃত স্বাদ ও মান পাওয়া যায় না।”
প্রশাসনকে এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আহ্বান জানান তিনি।


তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড এলাকার রসমালাই বিক্রেতা আনোয়ার হোসেন জানান, যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই এখানে রসমালাই উৎপাদন করা হয়।
‘মাতৃভাণ্ডার’ নামের আগের শব্দটি এত ছোট কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, “মাতৃভাণ্ডার নামটি সবার পরিচিত বলে এর আগের নামটি ছোট করে ‘মাতৃভাণ্ডার’ শব্দটি বড় করে লেখা হয়েছে।”
আনোয়ার হোসেনের মতো অন্যান্য বিক্রেতার দাবি তারা যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করেই রসমালাই প্রস্তুত এবং বিক্রি করছেন। তবে দু’একজন অবশ্য শেষ পর্যন্ত তাদের দোষ স্বীকার করে নিয়েছেন। আবার অনেকে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান।
তবে এসব বিষয়ে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রয়েছেন অধিকাংশ ক্রেতা বা ভোক্তা।
সুমন নামের এক ক্রেতা বলেন, “সব দোকানেই দেখি বিশাল সাইনবোর্ডে ‘মাতৃভাণ্ডার’ নাম লেখা। আমরা সাধারণ মানুষ কী করে বুঝব যে এসব দোকান আসল না নকল।”
এ ব্যাপারে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. মারজান সুলতানা জানান, অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশে তৈরিকৃত এসব রসমালাইয়ে খাদ্যের গুণগত মান ঠিক না থাকায় তা পেটের পীড়া, বদহজমসহ পাকস্থলীর নানা রোগের সৃষ্টি করতে পারে।



শেয়ার করুনঃ

Author:

কুমিল্লা অঞ্চলটি একসময় প্রাচীন সমতট অঞ্চলের অধীনে ছিল। পরবর্তীকালে এটি ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে যোগ দেয়। খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে কুমিল্লা জেলা হরিকেল অঞ্চলের রাজাদের অধীনে আসে। অষ্টম শতাব্দীতে লালমাই ময়নামতি দেব বংশ এবং দশম থেকে একাদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চন্দ্র বংশের শাসনাধীনে ছিল। ১৭৬৫ সালে এ অঞ্চলটি ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে আসে। ১৭৯০ সালে জেলাটি ত্রিপুরা জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬০ সালে এর নাম পরিবর্তন করে কুমিল্লা রাখা হয়। ১৯৮৪ সালে কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা পৃথক জেলায় পরিণত হয়।