12 September 2013

কুমিল্লার ময়নামতি শালবন বিহারে একদিন


আলমগীর রানাঃ ঈদের দিন এদিক ওদিক ঘুরে সন্ধ্যায় শৈবাল দা’র বাসায় বেড়াতে যাওয়া। সেখানেই সিদ্ধান্ত নিলাম, আগামীকাল সকালে কুমিল্লা যাচ্ছি। যেই কথা সেই কাজ। এই যাত্রার প্রধান উদ্দেশ্য সিএফসি’র সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত সাজ্জাদ হোসেন উপল এর গ্রামের বাড়িতে গিয়ে কবর যেয়ারত। পরদিন সকাল বেলা ট্রেনযোগে শৈবাল চৌধূরী, তাঁর ছেলে জয়, প্রবাল চৌধুরী এবং আমি। আমরা প্রথমে গেলাম লাকসাম উত্তরদা এলাকার বন্ধুবর মোহাম্মদ কামালের বাড়িতে। যথারীতি গোসল পর্ব, খাওয়া, হালকা বিশ্রাম। বিকেলে প্রকৃতি দর্শনে বের হয়ে সন্ধ্যা-রাত পর্যন্ত আশে-পাশের এলাকা ঘুরে ফিরে দেখলাম। জোসনারাতে ছাদের ওপর আড্ডা, খাওয়া, নিশিযাপন। পরদিন সকালে রওয়ানা হলাম কুমিল্লার রসুলপুরের বন্ধু আহমেদ রাসেল এর বাড়ীতে। পৌছে বিশ্রাম, আড্ডা, প্রকৃতি দর্শন। জুমার নামায শেষে খাওয়া পর্ব সেরে দুপুর গড়াতেই বেরিয়ে পড়লাম। ঐতিহাসিক কুমিল্লার ময়নামতি পাহাড় শালবন বিহার দর্শনে।
শালবন বিহারের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে জানতে পারলাম এর ইতিহাস। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশের বিভক্তির পর সাবেক পাকিস্তান সরকারের প্রত্নতত্ত্ব ও জাদুঘর বিভাগ গোটা এলাকায় ব্যাপক অনুসন্ধান পরিচালনা করে। এরপর ময়নামতি-লালমাই প্রত্নস্থলে ৫০টির অধিক সাংস্কৃতিক ঢিবি চিহ্নিত হয় এবং তিনটি ঢিবিতে খনন পরিচালিত হয়। অতঃপর আশির দশকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর ও জাহাঙ্গীর বিশ্ববিদ্যালয় পৃথক পৃথকভাবে আরও এক দফা প্রাগৈতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান পরিচালনা করে। এ পর্যন্ত লালমাই- ময়নামতি এলাকায় যেসব নিদর্শন আবিষ্কার হয়েছে সেগুলো হচ্ছে- শালবন বিহার, কুটিলা মুডা, চাপত্র মুডা, আনন্দ মুডা, রূপবান মুডা, ইটাখোলা মুডা, ভূজ বিহার, কৌটবাড়ী মুডা, হাতিগাড়া মুডা, উজিরপুর মুডা, চন্ডি মুডা, বালাগাজী মুডা ও ময়নামতি মুডা ইত্যাদি। তন্মধ্যে শালবন বিহার অন্যতম।
বুদ্ধদেব বংশীয় রাজাদের শাসনামলে সপ্তম থেকে অস্টম শতাব্দীতে শালবন বিহার স্থাপিত হয়। খনন কার্যের ফলে চতুষ্কোণ এই বিরাট বৌদ্ধ বিহারটি আবিস্কৃত হয়েছে। বিহারের প্রতিটি পার্শ্বের দৈর্ঘ্য ৫৫০ ফুট এবং এতে ভিক্ষুদের বাস উপযোগী ১১৫ টি কক্ষ রয়েছে। এই কক্ষগুলো ছিল ছাত্রাবাস। বিহারের প্রবেশপথ মাত্র ৩টি। প্রবেশ পথের সিঁড়ি অতিক্রম করলেই উত্তর-দক্ষিণে লম্বা (৩৩ গুন ২৩ ফুট) হলঘর বা দরবার ঘর। হলঘর থেকে একটু এগুলে আরও একটি হলঘর হয়ে কয়েকধাপ সিঁড়ি পার হলে কেন্দ্রীয় মন্দিরে যাওয়ার পথ। বিহারের মাঝামাঝি এই মন্দির ক্রুশ আকৃতির। প্রতি বাহুর দৈর্ঘ্য ১৭০ ফুট। বিভিন্ন সময় খননকালে অনেক পুরাবস্তু যেমন- ভূমি নকশা, ধাতুলিপি ফলক, প্রাচীন স্বর্ণ, রৌপ্য, মিশ্র ধাতুর মুদ্রা, পোড়ামাটির ফলক, ব্রোঞ্জের, মূর্তি, পাথরের মূর্তি, শিবলিঙ্গ, ব্যবহৃত মাটির হাঁড়ি-পাতিল, জীবজন্তুর মূর্তি, ব্যবহৃত অলঙ্কারের অংশ, হস্তলিপির পান্ডুলিপি ইত্যাদি উদ্ধার সম্ভব হয়েছে। এগুলো শালবন বিহার সংলগ্ন জাদুঘরে (ময়নামতি জাদুঘর) রাখা হয়েছে।
শনিবার ব্যতীত যেকোনো দিন নির্ধারিত ফি দিয়ে শালবন বিহার ও ময়নামতি জাদুঘর পরিদর্শন করা যায়। আমরা গিয়েছিলাম ২০১১ সালের ২ সেপ্টেম্বর শুক্রবার। শত শত পর্যটকে ঠাসা ছিলো সেদিন। শালবন বিহারের পাশেই রয়েছে পল্লী উন্নয়ন একাডেমী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং বন বিভাগের প্রাকৃতিক শালবন। শালবনের পাশেই রয়েছে টিপরা (ত্রিপুরা) পল্লী। এটিও পর্যটকদের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ।
সন্ধ্যায় শালবন এর স্থায়ী মেলায় কেনাকাটা আর হালকা স্ন্যাকস্‌ খেয়ে কুমিল্লা বিশ্বরোড উঠে রাসেল চলে গেল বাড়ীতে। অনেক পিড়াপিড়ি সত্ত্বেও শৈবাল দা, প্রবাল ও জয় চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে আর আমি বাধ্য হয়ে ছোটবোনকে নাঁইউর নিতে বাগদাদ এক্সপ্রেসে চেপে রিনার শ্বশুড়বাড়ি চাঁদপুরে (বিসিক-বাবুরহাট) রওনা দিলাম।

শেয়ার করুনঃ

Author:

কুমিল্লা অঞ্চলটি একসময় প্রাচীন সমতট অঞ্চলের অধীনে ছিল। পরবর্তীকালে এটি ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে যোগ দেয়। খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে কুমিল্লা জেলা হরিকেল অঞ্চলের রাজাদের অধীনে আসে। অষ্টম শতাব্দীতে লালমাই ময়নামতি দেব বংশ এবং দশম থেকে একাদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চন্দ্র বংশের শাসনাধীনে ছিল। ১৭৬৫ সালে এ অঞ্চলটি ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে আসে। ১৭৯০ সালে জেলাটি ত্রিপুরা জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬০ সালে এর নাম পরিবর্তন করে কুমিল্লা রাখা হয়। ১৯৮৪ সালে কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা পৃথক জেলায় পরিণত হয়।

0 facebook: