বাংলাদেশের প্রাচীন জনপদ কুমিল্লা। বিভিন্ন ইতিহাস, ঐতিহ্য ধারণ করে আপন মহিমায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ জনপদে পরিণত হয়েছে। বৌদ্ধ বিহার, প্রাচীন নিদর্শনাবলী, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধ সমাধি, মুক্তিযুদ্ধ এবং রবীন্দ্র-নজরুলের পদচারণা এ জেলাকে করেছে অনন্য। জেলার নামকরণের সঠিক ইতিহাস পাওয়া যায় না। অনেকের ধারণা কমলাংক নগর থেকে কুমিল্লা নামের উৎপত্তি।১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরা রাজ্যের বিরুদ্ধে শমসের গাজীর নেতৃত্বে কৃষক বিদ্রোহ কুমিল্লার একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় কুমিল্লা শহরের একজন মুসলমান গুলিবিদ্ধ হওয়ায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা দেখা দেয়। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে প্রিন্স অভ ওয়েলসের ভারত সফরের প্রতিবাদে ২১ নভেম্বর সারাদেশে হরতাল পালনের প্রস'তিকালে কাজী নজরুল ইসলাম জাগরণী গান রচনা করেন এবং হারমোনিয়াম কাঁধে কুমিল্লা শহরের রাস্তায় রাস্তায় গান গেয়ে শহরবাসীকে উদ্বুদ্ধ করেন। ‘ভিক্ষা দাও! ভিক্ষা দাও! ফিরে চাও ওগো পুরবাসী।’ উল্লেখ্য কাজী নজরুল ইসলাম কুমিল্লায় দুটি বিয়ে করেন। একটি মুরাদনগর উপজেলার দৌলতপুরে অন্যটি কুমিল্লা শহরে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও দু’বার কুমিল্লায় আসেন। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে চৌদ্দগ্রাম থানার মাহিনী গ্রামের চার হাজার কৃষক খাজনা প্রদান বন্ধ করার আন্দোলন শুরু করলে ব্রিটিশ গোরখা সৈন্যরা রাতে গ্রাম ঘেরাও করে গুলি চালায়। এতে চারজন শহীদ হন। মেঘনা, গোমতী, ডাকাতিয়া কুমিল্লার প্রধান নদী। দাউদকান্দি মেঘনা-গোমতী সেতুর পাড়ে পাথর খোদাই লেখা-
‘কুমিল্লার শ্যামল মায়ায় মেঘনা উদাস
কণ্ঠে তার মনিহার গোমতী, তিতাস।’
বস্ত্র শিল্পের জন্য বিখ্যাত এ জেলা। অষ্টম শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে জেলার দক্ষিণে চরপাতা নামক স্থানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একটি বৃহৎ কাপড়ের কারখানা ছিল। ময়নামতির কাপড় তখনকার বাংলার বিভিন্ন জেলায় চালান দেয়া হতো। জেলায় রয়েছে হালিমা টেক্সটাইল মিলস্ (বর্তমানে বন্ধ আছে), লোহা ও ইস্পাত দ্রব্য তৈরির কারখানা, মোহাজের কো-অপারেটিভ কারখানা, রাধারাণী ম্যানুফ্যাকচারিং ওয়ার্কস, কাইয়ুম স্টিল মিল, ঔষধ শিল্প, কুমিল্লা আয়ুর্বেদীয় ঔষধালয় ইত্যাদি। খাদ্দের ও রসমালাই এর সুনাম দেশ জোড়া। বিজয়পুরের মৃৎশিল্প জেলার গর্ব। শীতল পাটি, হুক্কা, মাদুর এবং বাঁশ ও বেতের বিবিধ উপকরণের জন্যও সুখ্যাতি রয়েছে। জেলায় বাখরাবাদ গ্যাস ফিল্ড রয়েছে।
জেলা শহরের উপকণ্ঠে কোট বাড়িতে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, সরকারি ল্যাবরেটরি হাইস্কুল, পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট, ভোকেশনাল ট্রেনিং ইন্সটিটিউট, টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার, ক্যাডেট কলেজ, সেনানিবাস, ময়নামতি জাদুঘর, বিডিআির ক্যাম্প ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন কমনওয়েলথ যুদ্ধ সমাধি, স্মৃতি সৌধ, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ স্মৃতি স্তম্ভ, লাকসাম স্মৃতি স্তম্ভ, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্মৃতি সৌধ, হাড়াতলী স্মৃতি স্তম্ভ। জেলার লাকসাম, কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট, বেলতলী, হোমনা, রসুলপুরে বধ্যভূমি এবং বেতিয়ারা মুদাস্সরগঞ্জ, নগরীপাড়া, কৃষ্ণপুর, ধনঞ্জয়, দিলাবাদ ও লাকসাম বিড়ি ফ্যাক্টরী এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন।
সাহিত্যিক, সমাজ সেবক ও শিক্ষানুরাগী নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরাণী, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহাস্থবির শীলভদ্র, সঙ্গীত শিল্পী শচীন কুমার দেব বর্মন, ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা মেজর এম.এ. গণি জেলার কৃতি সন্তান। ময়নামতিতে রয়েছে উপ-মহাদেশের প্রখ্যাত প্রত্ন সম্পদ। শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমে লালমাই ময়নামতি পাহাড় অবস্থিত। এটি প্রাচীন বৌদ্ধ সভ্যতার উজ্জ্বল স্বাক্ষর বহন করছে। এখানে রয়েছে শালবন বিহার, কুটিলা মুড়া, রূপবান মুড়া, চারন্দ মুড়া, ইটাখোলা মুড়া, সতের রত্ন মুড়া, রাণীর বাংলার পাহাড়, আনন্দ রাজার প্রাসাদ, ভোজ রাজার প্রাসাদ, চন্ডীমুড়া ইত্যাদি। বিহারের বিভিন্ন তৈজসপত্র, বহু মূর্তি ময়নামতি জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে শাহসুজা মসজিদ, শশীদল পাঁচ পীরের মাজার (১৮১৫), খাইষশালা জামে মসজিদ (১৭১৯), সপ্তরত্ন মন্দির, বরুড়ার লালমাই পাহাড়ের চূড়ায় চন্ডী মাতার মন্দির, চান্দলা শিব মন্দির, হরি মঙ্গল মঠ (১৮২২), রাম নগর যুগলমঠ, হারিয়াভাঙ্গা দূর্গ ও ধর্ম সাগর।
0 facebook: