23 February 2016

কুমিল্লার ভাষা সৈনিক আবদুল জলিল



বিশেষ প্রতিবেদনঃ ভাষা সৈনিক  মোঃ আবদুল জলিল ভূইয়া এখন শুধুই স্মৃতি। বেঁচে নেই তিনি, কিন্তু আছেন আমাদের হৃদয়ের কেনভাসে। জীবদ্দশায় কতটুকু মূল্যায়ন পেয়েছেন তিনি, এটাই প্রশ্ন। মৃতুর পর তার স্মৃতি ধরে রাখার ব্যবস্থাও নেয়া হয়নি। অদূর ভবিষ্যতে তার স্মৃতি চিহ্ন ধরে রাখার ব্যবস্থা না নিলে হয়তো নতুন প্রজন্ম জানতেও পারবে না কুমিল্লা’র চান্দিনায়ও একজন ভাষা সৈনিক ছিলেন।

ভাষা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী ওই বিপ্লবীর নামে একটি সড়ক নামকরণের দাবি চান্দিনা’র সচেতন ও সুশীল সমাজের। কিন্তু কে নেবে সে ব্যবস্থা। এরই মধ্যে তার মৃত্যুর ছয় বছরেরও বেশি সময় পাড় হয়ে গেছে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে ভাবছেনা কেউ। এবিষয়ে প্রশাসন, রাজনীতিক বা সুশীল সমাজ নেতৃবন্দ কেউ কোন পদক্ষেপ নেন নি।

ভাষা সৈনিক আবদুল জলিল স্মৃতি সংসদ নামে একটি সংগঠন রয়েছে। মেনে নিতে কষ্ট হলেও বাস্তবতা হচ্ছে, ওই স্মৃতি সংসদের পক্ষ থেকে শহীদ মিনারে পুষ্প স্তবক অর্পণ করেই তাদের দায়িত্ব শেষ। মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে কোন সভা, সমাবেশও করেনি তারা।

চান্দিনা উপজেলার হারং গ্রামের সম্ভ্রান্ত ভূঁইয়া পরিবারে ১৯২৯ সালের ৯ জানুয়ারী তিনি জন্মগ্রহণ করেন। আবদুল জলিল ভূঁইয়া ছিলেন একাধারে একজন ভাষা সৈনিকই, মুক্তিযোদ্ধা সংগঠক, শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিক। ভাষা সৈনিক আবদুল জলিল বরকামতা হাইস্কুল (বর্তমানে চান্দিনা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়) থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে পড়া অবস্থায়ই ১৯৪৮ সালে তিনি ভাষা আন্দোরনের কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেন।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তার অসামান্য অবদান ছিল। ১৯৫৮ সালে তিনি সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে যোগদান করলে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। এরপরই ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন শুরু হয়।  তিনি এ আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত হন। ১৯৬৫ সালে তিনি চান্দিনা থেকে গ্রেফতার হন। এরপর তিনি ৬ দফা আন্দোলনে অংশ নেন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য। তিনি একযোগে ঢাকা ও চান্দিনায় আন্দোলন গড়ে তুলেন। তৎকালীন সরকার তাকে ৯টি মামলার আসামী করেন। ১৯৭০ সালের সংসদ নির্বাচনে তিনি চান্দিনা ও দেবিদ্বার আসন থেকে প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচন করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি বেসরকারি শিক্ষকদের নিয়ে নতুন একটি আন্দোলন গড়ার কাজ শুরু করেন।

১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুটিং কমিটির একজন। এসময় পাক বাহিনী তার বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে মানুষের অন্ন জোগাড়ে তার প্রচেষ্টা ছিল অনন্য। এরপর ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা ট্র্যাজেডির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। এ জন্য তার বিরুদ্ধে মামলা হয় এবং গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়।

১৯৫৪ সালে চান্দিনার মাধাইয়া বাজার ছাদিম উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬১ সালের ২ এপ্রিল থেকে ঢাকা সিদ্ধেশ্বরী উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৯৯২ সালে তিনি অবসর নেন। ১৯৭৩ সালে তিনি বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

আন্দোলন সংগ্রামের এই সময়ে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত ভ্রমণ করেন। তার আন্দোলন সংগ্রামের স্বীকৃতি স্বরূপ সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ২০০০ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারী যে কয়েকজন ভাষা সৈনিককে সংবার্ধনা দিয়েছেন তার মধ্যে তিনিও ছিলেন। এছাড়া ২০০৭ সালের মার্চ মাসে চান্দিনা মহিলা ডিগ্রি কলেজে সর্বস্ত্ররের জনগণ তাকে গণসংবর্ধনা দেন। জীবদ্দশায় ভাষা সৈনিক আবদুল জলিল কুমিল্লা জেলা প্রশাসক, চান্দিনা উপজেলা প্রশাসন, সাপ্তাহিক বরুড়া কন্ঠ গুণিজন সংবর্ধনা পান।

২০০৮ সালের ২৩ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার  সকাল ৮:৪৫ মিনিটে ঢাকার মেডি এইড হাসপাতালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন তিনি (ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন)। ঢাকার বায়তুল মোকারমে তার প্রথম জানাজা, দুপুর ২টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে দ্বিতীয় জানাজা এবং বিকাল ৫টায় চান্দিনার হারং সিনিয়র মাদ্রাসা মাঠে শেষ জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে তার পারিবারিক কবরস্থানে স্ত্রী হাসনাহেনা বেগমের সমাধির পাশে তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর। ব্যক্তিগত জীবনে আবদুল জলিল ভূঁইয়া নিঃসন্তান ছিলেন।

জাতীয় স্বার্থে মরহুম ভাষা সৈনিক মোঃ আবদুল জলিল ভূইয়া’র স্মৃতি ধরে রাখার ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। 
ভাষার জন্য সংগ্রাম করে বেঁচেছিলেন আবদুল জলিল ভূইয়া। ২৩ অক্টোবর তার মৃত্যুবার্ষিকী। নিরবে-নিভৃতে চলে যায়। কেউ খবর রাখেনা।হয়তো মনেও নেই। সংগ্রামী জীবন ছিল যার প্রেরণায় তাকে স্মরণ রাখার অনুপ্রেরণা নেই প্রশাসন বা স্থানীয়দের। ২০০৮ সালে তিনি মৃত্যু বরণ করেন।

মাত্র ৮ বছরে সকলেই ভুলে গেছে তাঁকে, তার কর্ম ও স্মৃতিকে।

শেয়ার করুনঃ

Author:

কুমিল্লা অঞ্চলটি একসময় প্রাচীন সমতট অঞ্চলের অধীনে ছিল। পরবর্তীকালে এটি ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে যোগ দেয়। খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে কুমিল্লা জেলা হরিকেল অঞ্চলের রাজাদের অধীনে আসে। অষ্টম শতাব্দীতে লালমাই ময়নামতি দেব বংশ এবং দশম থেকে একাদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চন্দ্র বংশের শাসনাধীনে ছিল। ১৭৬৫ সালে এ অঞ্চলটি ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে আসে। ১৭৯০ সালে জেলাটি ত্রিপুরা জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬০ সালে এর নাম পরিবর্তন করে কুমিল্লা রাখা হয়। ১৯৮৪ সালে কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা পৃথক জেলায় পরিণত হয়।

0 facebook: