16 March 2017

প্রসঙ্গ কুমিল্লা বিভাগ, সিটি নির্বাচন


আনিস আলমগীরঃ হঠাৎ করে জাতীয় পর্যায়ে আলোচনায় চলে এসেছে কুমিল্লা। প্রথমে কুমিল্লাকে ‘ময়নামতি’ নামে বিভাগ করাকে নিয়ে, দ্বিতীয় বার কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। কুমিল্লা বিভাগের নাম কুমিল্লা থাকবে না শুনে আমার কুমিল্লার বন্ধুদের খুবই ক্ষিপ্ত দেখলাম। পরিচিত একজনও পেলাম না কুমিল্লা না হলেও তারা খুশি। রাজনৈতিক দলের নেতাদেরও দেখলাম ক্ষিপ্ত। মনে হচ্ছিল কুমিল্লা বোধহয় প্রাচীন কোনো নাম। কিন্তু ইতিহাসে দেখলাম মাত্র ১৯৬০ সালে জেলা হিসেবে কুমিল্লার নামকরণ। আইয়ুব খান নামকরণ করেছেন। এর আগে কুমিল্লার নাম ছিল ত্রিপুরা। এরশাদ আমলে কুমিল্লাকে ভেঙে আরো দুটি জেলা করা হয়েছে- চাঁদপুর এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া। সেই বৃহত্তর কুমিল্লা আর বৃহত্তর নোয়াখালীকে নিয়ে সরকার পরিকল্পনা করছে নতুন বিভাগ ময়নামতি করার।
ময়নামতি একটি ঐতিহ্যবাহী নাম। শুনেছি ফরিদপুরকেও বিভাগ করা হবে, নাম হবে মধুমতি। শুনতে ভালোই লাগে। আমার নিজের মতে এই দুই নামকরণ মন্দ না। কিন্তু এটাও তো সত্য এলাকার লোকজন যদি নামকরণে খুশি না হয় প্রশাসনের জোর জবরদস্তি করার কিছু নেই। কুমিল্লাবাসী যদি ময়নামতি বাদ দিয়ে কুমিল্লাতে খুশি থাকে- তাদের থাকতে দেয়া উচিত। রাজনৈতিক নেতারা সব কিছুতে ভিন্ন মত পোষণ করেন, কুমিল্লার নেতারা যেখানে নিজ দলেই কঠিনভাবে বিভক্ত, সেখানে নামকরণের পক্ষে তাদের একজোট হওয়া চোখে পড়ার মতো।
বলছিলাম কুমিল্লার নেতাদের নিজ দলে রেশারেশির কথা। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে নেতাদের রেশারেশি সারা বাংলাদেশ জানে। কুমিল্লার প্রয়াত নেতা কর্নেল আকবর হোসেন ব্যক্তিগত আড্ডায় বলতেন আওয়ামী লীগের আফজাল আর বাহার যতদিন জীবিত আছেন ততদিন আমাকে নির্বাচনে জয়ী হওয়া নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় ভুগতে হবে না। কর্নেল আকবরের জীবনকালে কথাটা কখনও মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়নি। আফজাল খান এবং আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের খারাপ সম্পর্ক সব নির্বাচনে কর্নেল আকবরের বিজয় সুনিশ্চিত করেছে।
এবার আফজাল সাহেব অসুস্থ, কর্নেলও দেহত্যাগ করেছেন, সুতরাং বাহার সাহেব এমপি হয়েছেন। কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন হওয়ার পর প্রথম মেয়র নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন আফজাল খান আর বিএনপির অঘোষিত প্রার্থী ছিলেন মনিরুল হক সাক্কু। সম্পর্কে সাক্কু নাকি কর্নেল আকবরের নিকট আত্মীয়। আফজাল খান লেখাপড়া জানা লোক, অধ্যক্ষ ছিলেন। সাক্কু মেট্রিক পাস। কর্নেল দেহত্যাগ করলে কি হবে বাহার তো রাজনীতিতে আছেন। সুতরাং আফজাল খান হতে পারেননি।
অবশ্য কুমিল্লা শহরের লোক ভোট দানের সময় মুঘল-পাঠান, পণ্ডিত-সুশীল কিছু দেখেন না। একবার আবদুল জলিল নামে একলোক কুমিল্লা পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। লেখাপড়া তেমন কিছু ছিল না। প্রথম জীবনে উনার যে পেশা ছিল শুনলাম তা মুখে আনা যায় না। যেমন করে হোক মধ্যবয়সে টাকা-পয়সার মালিক হয়েছিলেন। তারপর পৌরসভার চেয়ারম্যান।
ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোট সে তরী। আওয়ামী তরীতে এখন কোনো জায়গা নেই। মানুষের ভারে ডুবে যাওয়ার উপক্রম। এই প্রসঙ্গে লাইলী-মজনুর প্রেম কাহিনীর এক ঘটনা মনে পড়ল। শহরের এক যুবক লাইলীর জন্য পাগল হয়ে গেছে। যুবকটা উম্মাদ হয়ে পথে পথে ঘুরে। লায়লী যুবককে চেনে না। কখনো দেখেওনি। লায়লী একদিন শহরের পাগলদের দাওয়াত দিয়ে দুধ খাওয়ানো শুরু করে। প্রত্যেক দিন নির্ধারিত সময়ে পাগলরা লায়লীর বাড়ির আঙ্গীনায় আসে আর লাইলী তাদের দুধ খেতে দেয়। বহুদিন পর লাইলী ঠিক করল তার জন্য পাগল যে যুবক তাকে চিনে নেবে আজ। বুদ্ধি করে লাইলী সেদিন বলল, তোমরা তো এতদিন দুধ খেলে, আজকে দুধ খাওয়ার পর কেউ কি আমাকে ১ পোয়া ‘খুন’ (রক্ত) দেবে? সব পাগল দুধ খেয়ে ধীরে ধীরে চলে গেল শুধু একটা পাগল বসে রইল। লাইলী জিজ্ঞেস করল, সব পাগল চলে গেল তুমি বসে রইলে কেন? তখন পাগল যুবকটি বলল তুমি যে ‘খুন’ চাইলে তা দিতে বসে আছি। লাইলী তখন বুঝেছিল প্রকৃত মজনু কে?
আওয়ামী লীগের নৌকায় মানুষের যে ভিড় লেগেছে সেখানে এখন ‘খুন’ দেয়ার মজনু কতজন আছে কে জানে! অবশ্য লোকে বলছে দুধ খাওয়ার মজনুই নাকি বেশি। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে সে রকমই হয়। খুনের মজনুর চেয়ে দুধের মজনু বেড়ে যায়। অবশ্য চড়াই-উতরাইয়ের মাঝে গড়ে উঠা দল হিসেবে আওয়ামী লীগে ‘খুনের মজনু’ একেবারে কখনো শূন্যের কোঠায় পৌঁছে না। শেখ হাসিনার জনসভা হলে দেখা যায় ২/৩ হাজার বয়স্ক লোক বিভিন্নখানে বসে তার বক্তৃতা শোনার জন্য। তারা সবাই আওয়ামী লীগের পুরনো কর্মী এখন সক্রিয়ভাবে কাজ করেন না। অনেককে জিজ্ঞেস করেছি আওয়ামী লীগের দুর্দিন আসলে কি করবেন, সবাইতো মনে হচ্ছে ‘দুধের মজনু’। তারা অকপটে বলেন, প্রয়োজনে আবার মাঠে নামব। এদের চাওয়া-পাওয়া নেই। প্রায় সবাই তারা বঙ্গবন্ধুর কর্মী, যাকে তারা ডাকেন শেখ সাহেব।
আগামী ৩০ মার্চ কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন। আওয়ামী লীগের প্রার্থী হচ্ছেন আঞ্জুমান সুলতানা (সীমা) আর বিএনপি প্রার্থী হচ্ছেন পুরনো মেয়র মনিরুল হক সাক্কু। মনোনয়নপত্র গ্রহণ যাচাই-বাছাই সবই হয়েছে। ১৫ মার্চ থেকে শুরু হয়েছে আনুষ্ঠানিক প্রচারণা। বিএনপি প্রার্থী সাক্কু গত পাঁচ বছর মেয়র ছিলেন। টাকা-পয়সা হাতানোর অভ্যাস থাকলে তো দুর্নাম কিছু হয়েছে এরই মধ্যে। আর যদি দুর্নাম না থাকে তবে নারায়ণগঞ্জের আইভির মতো নিজেই একটা শক্তি তিনি।
অবশ্য বিএনপি নেতাদের বিশ্বাস করা খুবই কঠিন। বনিকের মতো মায়ের কানের দুল তৈরিতেও হেরফের করার অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে। কেন্দ্রীয় কয়েকজন ‘আবাসিক নেতা’ কমিটি বাণিজ্যে কোটি টাকা রোজগার করেছেন শুনি। দল ক্ষমতায় নেইতো কি হয়েছে- নদীর ঢেউ গুণতে দিলেও তারা পয়সা রোজগার করতে জানেন। সিকি-আদুলি মন্ত্রী ছিলেন এমন কোনো বিএনপি নেতা যদি শুনি ঢাকা শহরে ২৭ লাখ টাকা বাড়ি ভাড়া পান অবাক হই না। দল ক্ষমতায় থাকতে মন্ত্রী হতে পারেননি, যার কাছে তেমন কিছুই নেই বলে লোকে জানে, আমি যদি জানি তার শুধু একটা জাহাজ আছে মূল্য ৪০ কোটি টাকা- এতেও বিস্ময়ের কিছু নেই। যাক, সাক্কু ৫ বছর মেয়র ছিলেন, যদি এমন কোনো কারবার নাও করেন, হাজার সৎ হলেও তাকে প্রতিষ্ঠানিক বিরোধিতা তো কিছু মোকাবিলা করতেই হবে। লোকের যত ক্ষোভ-বিক্ষোভ মেটানোর সময়তো এটাই।
আওয়ামী লীগ প্রার্থী আঞ্জুমান সুলতানা সীমা আফজাল সাহেবের মেয়ে। আগে নাকি প্যানেল মেয়রও ছিলেন। তাই তাকে অনভিজ্ঞ বলা যাচ্ছে না, আবার শিক্ষিতও। আফজাল সাহেব জীবন সায়াহ্নে। তিনি এখন চেষ্টা করতে পারেন নারায়ণগঞ্জের আলী আহাম্মদ চুনকার মতো একটা সুনাম-সুখ্যাতি সম্পন্ন মেয়ে রেখে যেতে। আফজাল সাহেবের উচিত কুমিল্লা শহরের ঘরে ঘরে গিয়ে মেয়ের জন্য ভোট চাওয়া। অতীতে কোনো খারাপ কাজ করলে ক্ষমা প্রার্থনা করা। দলের প্রতিপক্ষকে আপন করে নেয়া। আওয়ামী লীগ বড় সংগঠন, কর্মী বাহিনীও বিরাট, ব্যাপক। তারা যদি ঘরে ঘরে গিয়ে মানুষের কাছে বিনীতভাবে ভোট চায়- মানুষ নিশ্চয়ই বিমুখ করার কথা নয়।
কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলায় গত ৬ মার্চ উপজেলা চেয়ারম্যান পদে যে নির্বাচন হয়েছে তাতে আওয়ামী লীগ প্রার্থী বিজয়ী হয়েছে ৪৬ হাজার ভোট পেয়ে। এ উপজেলাও তো শহরের অংশ। সুতরাং চেষ্টা করলে আওয়ামী লীগের বিজয় তো অসম্ভব নয়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাহেব বলেছেন কুমিল্লার ২৭ ওয়ার্ডে ২৭ জন কেন্দ্রীয় নেতা দায়িত্বে থাকবেন। ১৫ তারিখ থেকে যদি একটি ওয়ার্ডে একজন কেন্দ্রীয় নেতা দায়িত্ব পালন করেন এবং কর্মিবাহিনী নিয়ে ২৮ তারিখ পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন কাজ করে যান, তবে নির্বাচন তো তুচ্ছ কথা- একটি বিপ্লবের জন্যও প্রস্তুতি নেয়া যায়। তবে আমরা দেখেছি গত ৮ বছর আওয়ামী লীগের বহু সাংগঠনিক কর্মসূচি খাতা-কলমে রয়ে গেছে, মাঠে কার্যকর হয়নি। সারা দেশের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা প্রত্যাশা করছেন, এবারের কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে যেন এমন কিছু না হয়। আগামী সাধারণ নির্বাচনের এটা প্রস্তুতি পর্বের প্রথম পরীক্ষা।
প্রস্তুতি পর্বের প্রথম পরীক্ষা বিএনপির জন্যও। বিএনপি দল হিসেবে যতই বর্তমান সময়ে অগোছালো থাক, সমর্থক সংখ্যা তাদের কমেছে বলা যায় না। আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ক্ষমতায়। প্রাতিষ্ঠানিক বিরোধিতার যে হাওয়া তার সুফল কিছুটা যে বিএনপি প্রার্থী পাবেন সন্দেহ নেই, যতই হোক এটি একটি স্থানীয় নির্বাচন।
সর্বশেষ বলব, নতুন ইলেকশন কমিশনের জন্য এটি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কুমিল্লা সিটি নির্বাচনকে যতটা সম্ভব নিরপেক্ষ হিসেবে প্রমাণ করা তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। এই নির্বাচনে যেই জিতুক, রাষ্ট্রক্ষমতার পরিবর্তন আসবে না। সীমা যদি হয় সরকার দলীয়, সাক্কু ভিন দেশের লোক না। তাদেরকে তাদের যোগ্যতায় জিতে আসতে হবে। সে জন্য সরকারেরও উচিত সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনকে পুরোপুরি সহায়তা করা। নারায়ণগঞ্জের মতো কুমিল্লা সিটির জনগণেরও ভোটাধিকার নিশ্চিত করা।

লেখক:
সম্পাদক, দৈনিক মানবকণ্ঠ
anisalamgir@gmail.com

শেয়ার করুনঃ

Author:

কুমিল্লা অঞ্চলটি একসময় প্রাচীন সমতট অঞ্চলের অধীনে ছিল। পরবর্তীকালে এটি ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে যোগ দেয়। খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে কুমিল্লা জেলা হরিকেল অঞ্চলের রাজাদের অধীনে আসে। অষ্টম শতাব্দীতে লালমাই ময়নামতি দেব বংশ এবং দশম থেকে একাদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চন্দ্র বংশের শাসনাধীনে ছিল। ১৭৬৫ সালে এ অঞ্চলটি ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে আসে। ১৭৯০ সালে জেলাটি ত্রিপুরা জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬০ সালে এর নাম পরিবর্তন করে কুমিল্লা রাখা হয়। ১৯৮৪ সালে কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা পৃথক জেলায় পরিণত হয়।

0 facebook: