13 April 2016

অনার্স শেষ করে বিয়ের স্বপ্ন ছিল সোহাগীর


নিজস্ব প্রতিবেদকঃ তোমাদের পছন্দই আমার পছন্দ। তবে অনার্সটা শেষ করেই আমি বিয়ে করতে চাই। কয়েকদিন আগে বাবার করা প্রশ্নের ‘তার কোনো পছন্দের ছেলে আছে কিনা’ জবাব এভাবেই দিয়েছিলেন সোহাগী জাহান তনু।
শনিবার সোহাগীর মেঝো ভাই আনোয়ার হোসেন রুবেল বিষয়টি জানান। তিনি বলেন, ‘এখন তো এমন হাজারও স্মৃতি আমাদেরকে সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে।’
পরিবারে একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে বাবা, মা, ভাই ও স্বজনরা বাকরুদ্ধ। গ্রামবাসী, সহপাঠী এবং কুমিল্লাবাসী সোহাগীর মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না। এভাবে সংরক্ষিত এলাকায় রাস্তার পাশে হত্যার পর লাশ ফেলে যাওয়া এবং মামলার ৫ দিনেও তদন্ত কার্যক্রমের অগ্রগতি না হওয়ায় ক্ষোভের জন্ম নিচ্ছে। কুমিল্লার সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ প্রশাসনের গাফিলতি ভিন্ন চোখে দেখছেন।
কুমিল্লার শহরের বাসিন্দাদের এখন একটিই দাবি, সোহাগী হত্যা বিচার। কুমিল্লার প্রতিটি মানুষ সোহাগীকে ভালো মেয়ে বলে জানেন।
কুমিল্লা থেকে মুরাদনগর পর্যন্ত এমন একজনকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি, যে সোহাগী সম্পর্কে একটি উল্টো মন্তব্য করেছেন। সবার দাবি, এমন নম্র-ভদ্র ও ভালো মেয়েকে নৃশংসভাবে হত্যার বিচার চাই।
বিগত ৫ দিন ধরে কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড়, ভিক্টোরিয়া কলেজ ক্যাস্পাস এবং ঢাকা-চিটাগাং মহাসড়কে বিচারের দাবিতে সর্বস্তরের মানুষ আন্দোলন করে আসছে।
লেখাপড়া শেষ করে নিজেকে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত করার ইচ্ছা পূরণ না হওয়ায় সোহাগীর মা-বাবা রাতে ঘুমাতে পারছেন না। একমাত্র বোনকে হারিয়ে দুই ভাইও গত ৬ দিন ধরে চোখের পানি ফেলছেন। চোখের পানি শুধু পরিবার নয়, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের সহপাঠী এবং নাট্য গ্রুপের সহকর্মীসহ পুরো জেলার মানুষ নিজের মেয়ে বা বোন হারানোর যন্ত্রনায় ছটফট করছেন।
মামলার ৫ দিন পর শনিবার থেকে তদন্ত কার্যক্রম এগিয়ে চলছে দ্রুতগতিতে। শুক্রবার বিকেলে ও রাতে সোহাগীর বাবা ইয়ার হোসেন, মা আনোয়ারা বেগম, বড় ভাই নাজমুল হোসেন, মেঝো ভাই আনোয়ার হোসেন রুবেল, চাচাত বোন লাইজুল জাহান এবং প্রতিবেশী হুমায়ুন কবির ও আল আমিনকে র‌্যাব-১১ এর একটি দল তদন্তের কথা বলে বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে কুমিল্লা কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। পরবর্তীতে তাদেরকে গ্রামের বাড়িতে না পাঠিয়ে ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের রেস্ট হাউজে পাঠানো হয়।
এ বিষয়ে র‌্যাব-১১ সিপিসি-২ এর কোম্পানি কমান্ডার মেজর মুরশেদ জানিয়েছেন, তদন্তের স্বার্থে পরিবারের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। গ্রামের বাড়িতে না পাঠিয়ে কেনো ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড রেস্ট হাউজে তাদের পাঠানো হলো এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নিরাপত্তার জন্যই এমনটা করা হয়েছে।
মামলার সাক্ষী হিসেবে শনিবার বিকালে সোহাগীর মা, বাবা, দুই ভাই এবং চাচাত বোনকে কুমিল্লা জেলা গোয়েন্দা বিভাগে (ডিবি) কার্যালয়ে ঘটনার বর্ণনা শুনান। এর আগে শুক্রবার গভীর রাতে কুমিল্লা কোতোয়ালী মডেল থানা থেকে ডিবিতে স্থানান্তর হয়।
কার্যালয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রসঙ্গে ডিবির ওসি এ কে এম মনজুর আলম জানিয়েছেন, মামলার বাদীপক্ষ তদন্তের খোঁজ নিতে এখানে আসতেই পারেন। তাছাড়া ঘটনা সর্ম্পকে পরিবারের দেয়া তথ্য আমাদের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যথেষ্ট সর্তকতার সঙ্গে তদন্ত করছি।
শুক্রবার জেলা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কমিটির একটি বিশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, ডিজিএফআই, র‌্যাব, বিজিবি, আনসারসহ অন্যান্য বাহিনীর ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় সোহাগী হত্যা মামলার ঘটনায় সকল বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, কীভাবে সোহাগী হত্যা মামলা পরিচালিত হবে। সে অনুযায়ী রাতেই মামলা ডিবিতে স্থানান্ত করা হয়। রাতেই র‌্যাবের সহায়তায় সোহাগীর পরিবারকে গ্রামের বাড়ি থেকে ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের রেস্ট হাউজে নেয়া হয়।
শনিবার থেকে সোহাগীর পরিবারের কোনো সদস্যের সঙ্গে সাংবাদিকরা কথা বলতে পারছেন না। সকালে সোহাগীর গ্রামের বাড়িতে গিয়ে চাচা আলাল হোসেন এবং প্রতিবেশীদের কথা হলেও সবার মধ্য একটা চাপা আতঙ্ক কাজ করছে। দেড় হাজার বাসিন্দার মুরাদনগর উপজেলার ৭ নম্বর পশ্চিম ভাঙ্গুরা ইউনিয়নের মির্জাপুর গ্রামটি অজপাড়াগাঁ। মির্জাপুরের বাসিন্দারা সোহাগী হত্যার বিচার দাবি ছাড়া আর কোনো দাবি করেনি।
কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড়ে শনিবার বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সোহাগী হত্যার বিচারের দাবিতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল সাধারণ মানুষ। বিচার চেয়ে রাস্তায় নামা প্রতিটি মানুষ সোহাগীকে নিজের মেয়ে বা বোন বলে দাবি জানিয়ে প্রশাসনের কাছে হত্যার রহস্য উদঘাটনে তৎপর হতে বলেছেন।
রোববার ঢাকা থেকে গণজাগরণ মঞ্চ কুমিল্লা অভিমুখে একটি রোড মার্চ করবে। এ নিয়ে স্থানীয় গণজাগরণ মঞ্চের নেতাকর্মীরা গত ৫ দিনের আন্দোলনে আরও গতি পাবেন বলে মনে করা হচ্ছে।
সোহাগী হত্যা ও হত্যার বিচার দাবিতে চলমান আন্দোলনকে ঘিরে কুমিল্লার আইনশৃঙ্খলার যাতে অবনতি না ঘটে সেজন্য জেলা পুলিশ সুপার মো. শাহ আবিদ হোসেন বাড়তি সর্তকতার কথা বলেছেন।
তিনি বলেন, ‘সোহাগী হত্যা মামলাকে সবোর্চ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। ২৪ ঘণ্টা কাজ চলছে, যাতে দ্রত সময়ের মধ্য একটা ভালো ফলাফল কুমিল্লাবাসীকে দিতে পারি।’
গত ২০ মার্চ রাত ১০টার দিকে সোহাগীর বাবা ও ভাই ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের উচ্চ বিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী কালভার্টের পাশের ঝোপে সোহাগীর লাশ দেখতে পান। তাকে উদ্ধার করে সিএমএইচে নিয়ে গেলে সেখাকার কর্তব্যরত চিকিৎসক তার মৃত্যু নিশ্চিত করেন।
পরদিন অজ্ঞাতদের আসামি করে বাবা ইয়ার হোসেন কোতোয়ালী মডেল থানায় একটি মামলা করেন। ওই দিন সন্ধ্যায় সোহাগীর মৃতদেহ গ্রামের বাড়ি মির্জাপুরের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

শেয়ার করুনঃ

Author:

কুমিল্লা অঞ্চলটি একসময় প্রাচীন সমতট অঞ্চলের অধীনে ছিল। পরবর্তীকালে এটি ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে যোগ দেয়। খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে কুমিল্লা জেলা হরিকেল অঞ্চলের রাজাদের অধীনে আসে। অষ্টম শতাব্দীতে লালমাই ময়নামতি দেব বংশ এবং দশম থেকে একাদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চন্দ্র বংশের শাসনাধীনে ছিল। ১৭৬৫ সালে এ অঞ্চলটি ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে আসে। ১৭৯০ সালে জেলাটি ত্রিপুরা জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬০ সালে এর নাম পরিবর্তন করে কুমিল্লা রাখা হয়। ১৯৮৪ সালে কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা পৃথক জেলায় পরিণত হয়।

0 facebook: