29 May 2015

এখনো উপেক্ষিত মুরাদনগর উপজেলার শ্রীকাইল গ্যাসক্ষেত্র

এখনো উপেক্ষিত মুরাদনগর উপজেলার শ্রীকাইল গ্যাসক্ষেত্র


কার স্বার্থে বাদ পড়ল শ্রীকাইল। কি কারণ, আর কে এর উদ্যোক্তা। কোন সদুত্তোর মিলছে না। অথচ এখন সবচেয়ে জরুরি শ্রীকাইলে কূপ খনন করা। খোঁজ নিতে গিয়ে পাওয়া যায় ভয়াবহ চিত্র। একই স্তর থেকে গ্যাস উত্তোলন করছে সিঙ্গাপুর ভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানি ক্রিস এনার্জি। 

দূরত্ব ৭ কিলোমিটারের মতো। অবস্থা এমন, যে আগে তুলবে সে বেশি গ্যাস পাবে। তাই ২০০৭ সাল থেকেই এ বিষয়ে সোচ্চার রয়েছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তারা শ্রীকাইল থেকে দ্রুত গ্যাস উত্তোলনের দাবি জানিয়ে আসছেন। সমালোচকদের দৃষ্টি ফেরাতে ২০১৩ সালে শ্রীকাইল-৪ কূপ খনন করার ঘোষণা দেয় পেট্রোবাংলা। কিন্তু তা আর আলোর মুখ দেখেনি।

উল্টো রাশিয়ান প্রতিষ্ঠান গাজপ্রম শ্রীকাইল-৪ সহ রশিদপুর-৯, ১০, ১২ ও বাখরাবাদ-১০ খননের প্রস্তাব দিলে তা নাকচ করে দেয়া হয়। অন্যগুলো দেয়া হলেও শুধু শ্রীকাইলকে তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়।

অন্য ৪টি কূপ খনন করে নেয়ার জন্য আলোচনা চলছে বলে জানিয়েছে জ্বালানি বিভাগের উপ-সচিব জনেন্দ্র নাথ সরকার। তবে শ্রীকাইল কেন বাদ দেয়া হচ্ছে সে বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হয়নি হিন্দু সম্প্রদায়ের ওই কর্মকর্তা।

শ্রীকাইল প্রশ্নে খোদ প্রধানমন্ত্রীকে ভূল বোঝানো হচ্ছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

জ্বালানি বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) নাজিম উদ্দিন বলেন, এ বিষয়ে পেট্রোবাংলা ভালো বলতে পারবে। কারণ তারা প্রধান কাজটি করে।

একই স্তর থেকে ক্রিস এনার্জি গ্যাস উত্তোলন করছে। বিলম্ব করলে বাংলাদেশের লোকসান বাড়বে। তারপরও কেন শ্রীকাইলকে তালিকা থেকে বাদ দেয়া হচ্ছে এ বিষয়ে পেট্রোবাংলাকে জিজ্ঞেস করার পরামর্শ দেন অতিরিক্ত সচিব।

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন এন্ড প্রোডাকশন কোম্পানি (বাপেক্স) সূত্র জানিয়েছে, জেলার মুরাদনগর উপজেলার বাঙ্গুরা ও শ্রীকাইল গ্যাসক্ষেত্র দুটির দূরত্ব মাত্র ৭ কিলোমিটার। গ্যাসক্ষেত্রটি মাটির ৩২ শ’ মিটার নিচে অভিন্ন ভূকাঠামোতে প্রায় ১৪০ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত।

বাঙ্গুরা অংশ থেকে আইরিশ কোম্পানি টাল্লো ও কানাডীয় কোম্পানি নাইকো যৌথভাবে ২০০৬ সাল থেকে ৪টি কূপের মাধ্যমে প্রতিদিন গড়ে ১৪০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন অব্যহত রেখেছে। পরে গ্যাস ফিল্ডটি ক্রিস এনার্জির কাছে বিক্রি করে দেয় টাল্লো।

অন্যদিকে শ্রীকাইলে দেশীয় কোম্পানি বাপেক্স ২০১১ সালে একটি এবং ২০১৩ সালে আরেকটি কূপ খনন করে। এ দুটি কূপ থেকে দৈনিক ৪১-৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। অন্যদিকে সিঙ্গাপুরভিত্তিক কোম্পানি ক্রিস এনার্জির প্রায় তিনগুণ (১২০ মিলিয়ন ঘনফুট) গ্যাস উত্তোলন করছে। পাশাপাশি ক্রিস উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য আরো দুটি কূপ খননের পরিকল্পনা নিয়েছে। রাশিয়ান প্রতিষ্ঠান গাজপ্রমের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে।

এই অবস্থায় গ্যাসের উৎপাদন যখন বাড়ানো প্রয়োজন তেমন একটি সময়ে শ্রীকাইলে গ্যাজপ্রমের কূপ খনন প্রস্তাব আলোচনার টেবিল থেকেই বাদ দেয়া হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। যাদের প্রভাবে এবারও শ্রীকাইলে নতুন কূপ খনন প্রস্তাব বাদ পড়তে যাচ্ছে। খোদ পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান এ বিষয়ে আগ্রহী নয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

পেট্রোবাংলা ও জ্বালানি বিভাগ ক্রিস এনার্জির কাছ থেকে গ্যাস কিনতেই বেশি আগ্রহী। বাপেক্সের একজন সাবেক এমডি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, ক্রিস এনার্জির কাছ থেকে প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাস কেনা হচ্ছে প্রায় ৩ ডলার মূল্য দিয়ে। মাসে যার পরিমাণ দাঁড়ায় ৬০ হাজার মিলিয়ন ডলার।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বদরুল ইমাম এক অনুষ্ঠানে বলেন, শ্রীকাইল ও বাঙ্গুরা ক্ষেত্র দুটি একই ভূ-কাঠামোয় হওয়ায় যারা বেশি কূপ খনন করবে তারাই বেশি গ্যাস তুলে নেবে। তাই শ্রীকাইলে যত বেশি সম্ভব (ম্যাক্সিমাম) কূপ খনন করে গ্যাস তোলা দরকার।

অন্যদিকে বি-বাড়িয়ার সালদা গ্যাসক্ষেত্রটির ভূকাঠামো সালদা নদীর তলদেশ দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অভিন্ন অবস্থায় বিস্তৃত। নদীর ওপারে ভারত অন্তত ১২টি কূপ খনন করে গ্যাস তুললেও নদীর এপারে বাংলাদেশ কূপ করেছে মাত্র দুটি। সালদা গ্যাসক্ষেত্রটিও বাপেক্স পরিচালিত। সেখানে কম কূপ খনন করায় এবং নতুন কূপ খননে দেরি হওয়ায় লোকসান হচ্ছে বলে মনে করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। 

বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, বিষয়টি ভেবে দেখা হবে। শ্রীকাইল থেকে যাতে দ্রুত গ্যাস উত্তোলন করা যায় সে জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

24 May 2015

বিদ্রোহী কবির পদধুলিতে ধন্য কুমিল্লা

বিদ্রোহী কবির পদধুলিতে ধন্য কুমিল্লা


অত্যাচারিত, নিপীড়িত মানুষের কাছে বিদ্রোহের জীবনে আশার বাণী নিয়ে এসেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। নজরুলের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনটা বিচিত্র ও বর্ণিল। জীবনের নানাবিধ ব্যতিক্রমী ঘটনা প্রবাহের সাথে তার জন্মের ঘটনাটিও যেন একই সূত্রে গ্রথিত। প্রথমবারের মতো কুমিল্লায় জাতীয় পর্যায়ে কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকী উদযাপন হয়েছিল ১৯৯২ সালে। 

নজরুল কুমিল্লার, কুমিল্লা নজরুলের-এ চেতনা ও বিশ্বাসের জায়গাটি দীর্ঘ ২২ বছর পর আবারো আলোকিত হয়ে উঠছে কুমিল্লায়। 

আগামী ২৫ মে ২০১৪ সালে বর্ণাঢ্য আয়োজনের মাধ্যমে জাতীয় ভাবে নজরুলের জন্মজয়ন্তী পালনে প্রাণ ফিরে পাচ্ছে।  কুমিল্লায় ৫২ বছর আগ থেকে শুরু করে পর্যায়ক্রমে ধরে রাখা নজরুল স্মৃতিফলকগুলো জাতীয় পর্যায়ে অনুষ্ঠিতব্য কবির জন্মজয়ন্তী ঘিরে ব্যাপক নান্দনিকতা নিয়ে ফিরে আসছে। 

১৮৯৯ সালের ২৫ মে বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে কাজী ফকির আহমেদ এর সংসারে জাহেদা খাতুনের পর পর কয়েকটি সন্তান মারা যাবার পর ঐ দিন জন্ম হওয়ার সন্তানটি জন্মের চিৎকার করে উঠলো বেঁচে থাকার জন্য এবং বেঁচে গেলো। এ যেন বেঁচে থাকার বিদ্রোহ এবং এরূপ ব্যতিক্রমের মধ্যে দিয়েই একটি জীবনের সূচনা হলো বলা যেতে পারে। 

কাজী নজরুল ইসলাম যে ব্যতিক্রম ছিল বাল্যকাল হতে। ৮ বছর বয়সে পিতৃ বিয়োগের পর জীবনে কঠোর রূপটা প্রত্যক্ষ করেছেন। মাত্র ১০/১১ বছরে কিশোর কিভাবে লেটো দলের হয়ে গান লিখে এবং সে গান সুর করলেনে এবং তালিম দিলেন লেটো দলের গায়কদের। ঐ বয়সে ব্যাপারটা নিশ্চিয়ই অকল্পনীয়। নজরুল যখন পড়ালেখা করতেন অর্থাভাবে পাঠ্য বই কেনা সম্ভব হয়নি। তাই ক্লাশে প্রায় সময়ই নজরুল পড়া দিতে পারতেন না। কিন্তু পরীক্ষার আগে সহপাঠীদের থেকে দুই দিনের জন্য বই ধার নিয়ে সারা রাত পড়ে পড়ে পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করতেন। অষ্টম শ্রেণী থেকে নবম শ্রেণীতে উঠার সময় নজরুর র্ফাসীতে সর্বোচ্চ ৯৮ নম্বর পেয়েছে। যেখানে ক্লাসের বেশীর ভাগ ছাত্রই এ বিষয়ে ফেল করেছিলেন। স্কুল কর্তৃপক্ষ অন্য ছাত্র ৫ নাম্বর গ্রেস দেয়। নজরুল ও ৫ নাম্বর গ্রেস দাবী করে বসে। এ নিয়ে প্রধান শিক্ষক ও ফার্সী শিক্ষক অনেক বুঝানোর পর নজরুল অনমনীয়। ধারণা করা যয় এ কারণেই নজরুল স্কুল ছেড়ে দিয়েছিল।

জানা যায়, দৌলতপুর কবি নজরুলের ২ মাস ১১ দিন অবস্থানকালে ১৬০টি গান ও ১২০টি কবিতা রচনা করে গেছেন। বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য কবিতাগুলোর মধ্যে ‘বেদনা অভিমান’ ‘অ-বেলা’ অনাদৃত বিধুরা পথিক প্রিয়া, বিদায় বেলা, পাঁপড়ি খোলা, হারমানা হার ইত্যাদি কবিতায় নজরুল নারগিসের মিলন ও বিচ্চেদ বেদনার চিত্র ফুটে উঠেছে। মুরাদনগরে ঐতিহাসিক খান বাড়িরও সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ১৯৯২সালে কুমিল্লায় জাতীয় ভাবে কবির ৩ দিনব্যাপী জন্মবার্ষিকী পালন করা হলেও এরপর আর এভাবে পালিত হয়নি। কবি নজরুলের রাজনীতি, গ্রেফতার, প্রেম, বিয়ে, ব্যক্তিজীবন, সঙ্গীত ও সাহিত্যের বর্ণিল অধ্যায়ের কুমিল্লায় ৫২ বছর আগ থেকে শুরু করে পর্যায়ক্রমে ধরে রাখা নজরুল স্মৃতিফলকগুলো জাতীয় পর্যায়ে অনুষ্ঠিতব্য কবির জন্মজয়ন্তী ঘিরে ব্যাপক নান্দনিকতা নিয়ে ফিরে আসছে। আর এ নান্দনিকতা সারা বছর ধরে টিকে থাকবে এমন প্রত্যাশা এখানকার নজরুলপ্রেমীদের। স্মতিফলকগুলো নতুন আঙ্গিনে সাজানো হচ্ছে। যেন নতুন প্রাণের ছোঁয় মেতে উঠছে কুমিল্লা।  

নজরুলের দৌলতপুর আগমনঃ
আফগানিস্তানের বংশোদ্ভূত খাঁ পরিবারে ১৮৮৯ সালে ২৫ মে জন্মগ্রহণ করে দৌলতপুর গ্রামে এক সময়কার বহুল আলোচিত চির কুমার আলী আকবর খাঁ। আলতাফ আলী খাঁ, ওয়াযেশ আলী খাঁ, নেজাবত আলী খাঁর ছোট ভাই ছিলেন তিনি। অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও আলী খাঁ চেষ্টা, শ্রম ও মেধা দিয়ে দারিদ্র্যকে জয় করে বিএ পাশ করেন। প্রথম জীবনে চাঁদা সাহেবের গৃহ শিক্ষক এবং পরে সৈনিকের চাকরিতে যোগ দেন। এক পর্যায়ে যোগ্যতা বলে তিনি ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হন। একজন সফল নাট্যকার হিসেবেও তার সুনাম সুখ্যাতি রয়েছে। জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি কুমিল্লা রূপসা হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব থাকাকালে পুস্তক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হন। কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠে। নজরুল তখন ব্যাটালিয়ন কোয়ার্টার মাস্টার আর আলী আকবর খান তখন ক্যাপ্টেন। নজরুলের কবিতা, গান, নাটক, আবৃত্তি ও বক্তৃতায় আলী আকবর খান মুগ্ধ হয়ে তাকে চোখে চোখে রাখতেন। ১৯২১ সালের ৬ই এপ্রিল নজরুল কলকাতা থেকে দৌলতপুর গ্রামের আসেন দৌলতপুরের আলী আকবর খাঁর আমন্ত্রণে। দৌলতপুর আগমনই নজরুলের জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। নজরুল দৌলতপুর অবস্থানকালে আতিথেয়তা গ্রহণ করেছিলেন আলী আকবর খানের বাড়ীতে। কবির দৌলতপুর অবস্থানকালেই বিদ্রোহী নজরুলের মাঝে আবির্ভূত হয় প্রেমিক নজরুলের। খাঁ বাড়ির উত্তর পার্শ্বের বাড়িটি ছিল মুন্সী বাড়ি। ওই বাড়িতে আলী আকবর খানের বোনকে বিয়ে দিয়েছিলেন। ওই বোনের মেয়ে রূপসী সুন্দরী সৈয়দা খাতুন ছবি ওরফে নারগিস (নারগিস নামটি কবির কাল্পনিক মানস কন্যার নাম) বেশির ভাগ সময়ই থাকতেন মামা আলী আকবর খানের বাড়িতে। সেই সুবাদেই নজরুলের সঙ্গে নারগিসের সখ্য গড়ে ওঠে। নারগিস নজরুলের অমর প্রেমের তীর্থভুমি দৌলতপুর খাঁ বাড়ির প্রবেশ মুখে বর্তমান দ্বিতল ভবন আলী আকবরের মেমোরিয়াল ট্রাস্ট এর স্থানেই ছিল নজরুলের থাকার ঘরটি।

কুমিল্লায় নজরুলের পদধুলিঃ
কাজী নজরুল ইসলামের জীবনের বড় একটা অধ্যায় এই কুমিল্লাতে কেটে গেছে। ১৯২১ সালে কবি নব পরিচিত পুস্তুক ব্যবসায়ী আলী আকবর খানের সাথে কুমিল্লায় আসেন। এখানে তার প্রেম, মাতৃস্নেহ, মানুষের সাথে ভালবাসার বন্ধন, জনপ্রিয় ব্যক্তি, দুই দুটো বিবাহের ঘটনা, তার গ্রেফতার হওয়া সভা সমিতিতে যোগদান, অভিমান, দুঃখ, ক্ষোভ আনন্দ উল্লাস, উজ্জীবন, সবকিছু ঘটেছিল। ১৯২১ সালের এপ্রিল মাসে আলী আকবর খানের সাথে এসে উঠেন কান্দিরপাড় (ফরিদা বিদ্যায়তন বিপরীত দিকে) আলী আকবর খানের বন্ধু বীরেন সেনের বাড়ীতে। কবি গান, কবিতা আবৃত্তি করে মাতিয়ে রাখতেন বাড়িটি কে। বীরনের মা বিরজা সুন্দরী দেবীকে তখন থেকেই নজরুল ‘মা’ বলে ডাকতেন। দৌলতপুর যাওয়ার আগে এখানে তিনি ৩/৪ দিন অবস্থান করেন। দৌলতপুর কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর থানার একটি গ্রাম। দৌলতপুর নজরুল আগমন সমস্যাকে আলী আকবর খান পূর্বেই খবর দিয়ে রেখেছিলেন বলে বাড়ীতে নজরুলের সম্মানে তোরণ নির্মাণ করা হয়েছিল। দৌলতপুর গ্রামে অবস্থানকালীণ আলী আকবর খানের বোনের মেয়ে সৈয়দা খাতুনের সাথে কবির দেওয়া নেওয়া হয়। নজরুল তার নাম দিলেন নার্গিস আমার খানম। নার্গিসের সাথে বিবাহের রাত্রিতে কবি কুমিল্লা চলে আসেন। চলে আসার কারণটি এখনও সবার কাছে রহস্যময় রয়েছে। কট্টর মুসলমান ও গোড়া হিন্দুদের কেউ কেউ নিন্দা করতেও ছাড়েনি কবির হিন্দুর বাড়ীতে অবস্থান ও প্রমীলা সম্মানকে নিয়ে। তারপরও এখানে সভা সমিতিতে যোগ দিয়েছেন টাউন হলে, ঈশ্বর পাঠশালায় গান করেছেন, বাশী বাজিয়েছেন, কবিতা লিখেছেন আবৃত্তি করেছেন, আড্ডা দিয়েছেন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপিত হয় কংগ্রেস নেতা আশরাফ উদ্দিন চৌধুরী বসন্ত মজুমদার, হেমপ্রভা মজুমদার, সাথেও প্রখ্যাত সাহিত্যিক মোতেহার হোসেন চৌধুরী, সংস্কৃতি সেবা জানে আলম চৌধুরী, অনুশীলন দলের নেতা অতীন্দ্র মোহন রায়, দুই বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ত্রিপুরা মহারাজার পুত্র শচীনদেব বর্মন, সুর সাধক ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু সাথে। কুমিল্লা নগরীর বিভিন্ন বাসায় গানের জলসায় যোগ দিয়েছেন। কবি কুমিল্লায় কান্দিরপাড় ইন্দ্র কুমার সেনের খাতস্পুত্রী আশালতা সেন গুপ্তা দুলী বা দোলনের প্রেমে পড়েন। কবি এর নাম দেন প্রমীলা। কুমিল্লাতে গান কবিতা লেখেছেন কিছু গান কবিতা গোমতী নদীর কথা উল্লেখ রয়েছে। বিদ্রোহী যৌবনের দিনগুলোতে প্রমীলা তার শক্তি ও প্রেরণার উৎস হয়েছে।

নজরুলের প্রতিষ্ঠান, স্মৃতি ও বর্তমান অবস্থাঃ
কবিতীর্থ দৌলতপুর গ্রামটি আজ এক ঐতিহাসিক দায়িত্বের বোঝা বহন করছে। মুরাদনগর দীঘির পাড়, ধনপতিখোলা, দৌলতপুর, আর্চি ও গোমতী নদীর তরিসহ বহু জায়গায় কবি নজরুলের স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। নজরুল স্মৃতি সংরক্ষণ ও নজরুল চর্চার জন্য এ পর্যন্ত কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে নজরুল নিকেতনের অফিস কাম পাঠাগার স্থাপন, স্থানীয় সহযোগিতায় নজরুল-নারগিস শিল্পকলা একাডেমী প্রতিষ্ঠা, নারগিস-নজরুল বিদ্যা নিকেতন প্রতিষ্ঠা, দৌলতপুরে স্থায়ী উম্মোক্ত মঞ্চ নির্মাণ, নজরুল-নারগিস গবেষনা কেন্দ্র স্থাপন, কোম্পানীগঞ্জ ও দৌলতপুরে তোরণ নির্মাণ নজরুল স্মৃতি বিজড়িত আমগাছ ও কামরাঙ্গা গাছের গোড়ায় বেষ্টনী নির্মাণ, খাঁ বাড়ির পুকুর ও ঘাট বাঁধানো, খাঁ বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা পাকাকরণ, নজরুল নারগিসের স্মৃতিবাহী খাট সংরক্ষণ, সরকারী উদ্যোগে প্রতি বছর ৩ দিনের অনুষ্ঠান উদযাপন। ২০০৪ সালে মুন্সী বাড়ীতে নজরুল নারগিস বিদ্যা নিকেতন প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৯৯ সালের ৬ এপ্রিল সাবেক সংসদ সদস্য দিলারা হারুন ১টি গাছতলায় এবং নজরুল নারগিসের সেই ঐতিহাসিক বাসর ঘরের সামনে স্মৃতিফলক উম্মোচন করলেও দেড়শত বছর পুরাতন বাসর ঘরটি ১৯৬২ সাল পর্যন্ত ৮ চালা ছিল। পরে চৌচালা করলেও ভিটি এবং আয়তনের কোন পরিবর্তন হয়নি। ঘরটির দরজা জানালা ভগ্নাবস্থায় আলী আকবর খাঁর বংশধররা ব্যবহার করছেন। ওই বাসর ঘরেই রয়েছে শতবর্ষের পুরাতন নজরুল-নারগিস মধু বাসর পালঙ্ক এবং নারগিসের ব্যবহারের কাঠের সিন্ধুক। খাঁ বাড়ির পূর্ব পার্শ্বে রয়েছে পুকুর, ওই পুকুরের দক্ষিণ পার্শ্বে রয়েছে শান বাঁধানো ঘাট এবং ঘাটের পাশে একটি আম গাছটি মরে যায়। এ আমতলায় বসেই কবি কবিতা-গান রচনা করতেন। গভীর রাত পর্যন্ত গান গাইতেন, বাঁশি বাজাতেন, ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের গান শোনাতেন। ওই গাছের নিজে বসেই কবি ‘পাপড়ি খোলা’ কবিতাটি রচনা করেছিলেন। বৃটিশ আমলে ১৯২৭ সালে নির্মিত আলী আকবর খাঁ মেমোরিয়াল দ্বিতল ভবন (যে ভবনটিকে জাদুঘর তৈরির প্রস্তাব ছিল) এখন যেন ধ্বংসের প্রহর গুনছে। চিরকুমার আলী আকবর খাঁর ভাইদের উত্তরসুরিরা আজ জমিজমা বন্টন এবং মেমোরিয়াল ভবনটিও দখল সংক্রান্ত বিষয়ে বিরোধের কারণে মামলা মোকদ্দমায় জড়িয়ে সবাই এখন সর্বস্বান্ত। ১৮৯৫ সালের ২৪শে মে সাবেক জেলা প্রশাসক সৈয়দ আমিনুর রহমান নজরুল নিকেতনের পাঠাগার মিলণায়তন, পিকনিক কর্ণার ও অতিথি ভবন এর সমন্বিত প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। খাঁ বাড়ির পার্শ্বে গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব রাজনৈতিক প্রভাবে আর তা এখনও আলোর মুখ দেখতে পায়নি। বৃষ্টির কারণে মুক্তমঞ্চে কোন সভা সমাবেশ করা যায় নি। মিলণায়তনে নামমাত্র পাঠাগারটি ভাল কোন ভবনে নির্মাণ হয়নি। নিজস্ব সাউন্ড সিস্টেমস, আসবাবপত্র, ৪টি ফ্যান নেই, নেই কোন ভাল বই পুস্তক, জানার আকাঙ্খায় ওই পাঠাগারে যাওয়া বৃথা মাত্র। নজরুল সঙ্গীত নিকেতনটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি ভবন ব্যবহার করা হচ্ছে মাত্র। তাতে আধুনিক কোন বাধ্য যন্ত্রের সংস্পর্শ নেই। নজরুল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার দাবির বাস্তব রূপ নিয়েছে জুনিয়র হাই স্কুলে, তাছাড়া এ মুহুর্তে সেটি সবচেয়ে বেশি জরুরী বলে স্থানীয়রা দাবি করছেন। তাহল নজরুল-নারগিস গবেষণা কেন্দ্র গবেষক কবি বুলবুল ইসলামের মৃত্যুর পর মুখ থুবড়ে পড়েছে। তাছাড়া স্থানীয়রা আরও দাবি করছেন নজরুলের নামে প্রতিষ্ঠিত দৌলতপুরের সমস্ত প্রতিষ্ঠানের নারগিসের নাম যুক্ত করে নজরুল নারগিস রাখা।  কবির প্রতি পরম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় এসব প্রতিষ্ঠান নজরুলের চেতনাকে মনেপ্রাণে লালন করে আলো ছড়াচ্ছে। তারমধ্যে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে কবি কাজী নজরুল ইসলাম হল। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ডিগ্রী শাখায় ১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কবি নজরুল ছাত্রাবাস। কুমিল্লা শহরের নানুয়ার দীঘির দক্ষিণ পাড়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে নজরুল মেমোরিয়াল একাডেমি নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কুমিল্লায় কবির অন্যতম সহচর নজরুল গবেষক সুলতান মাহমুদ মজুমদারের ভাতিজা অধ্যাপক হাসান ইমাম মজুমদার ফটিক ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠা করেন এ প্রতিষ্ঠানটি।  কবির অন্যতম একটি কাব্য গ্রন্থের নামে শহরের ঐতিহাসিক ধর্মসাগরের উত্তর পাড়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে গুল বাগিচা প্রাথমিক বিদ্যালয়। কুমিল্লা হাউজিং এষ্টেটে গড়ে তোলা হয়েছে নজরুলের নামে একটি সঙ্গীত বিদ্যালয়। কুমিল্লার বিবির বাজারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জাতীয় কবি নজরুল শিশু নিকেতন নামের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
এছাড়া কাব্যচর্চাসহ কুমিল্লার কান্দিরপাড় প্রমীলা দেবীর বাড়ি, ধর্ম সাগরের পশ্চিম পাড়ে কবিতা ও গানের আসর, ঝাউতলায় ও রাজপথে গ্রেফতার, বসন্তস্মৃতি পাঠাগার, নানুয়ার দিঘীর পাড়, দারোগাবাড়ি, ইউসুফ স্কুল রোড, মহেশাঙ্গন, কুমিল্লা ধীরেন্দ্র মিলণায়তন মাঠ, শীচন বর্মনের বাড়ি, নবাববাড়ি, ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাড়ি, নজরুল এভিনিউ, কান্দিরপাড়, ঝাউতলা ও রানীর দিঘির পাড়সহ কুমিল্লা মহানগরীর বিভিন্ন স্থানে ছিল কবি নজরুলের পদচারনা। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে নজরুলের স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলো পর্যায়ক্রমে বেদখল হয়ে যাচ্ছিল। কুমিল্লার প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড় থেকে ধর্মপুর ন্যাপ্রোচ রেলস্টেশন সড়কটির নামকরণ করা হয় নজরুল এভিনিউ। কবি নজরুলকে কেন্দ্র করে কুমিল্লায় সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ১৯৪৫ সালের মাঝামাঝিতেই শুরু হয়। দেশ বিভাগের পর কুমিল্লায় ব্যাপকভাবে শুরু হয় নজরুল চর্চা। এর আগে ১৯২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে কুমিল্লা ঈশ্বর পাঠশালায় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা আবৃত্তি ও নজরুল সঙ্গীত পরিবেশন করা হয়। ১৯৬২ সালে কান্দিরপাড় থেকে ফরিদা বিদ্যায়তন পর্যন্ত সড়কটির নামকরণ করা হয় নজরুল এভিনিউ। ১৯৭০ সালে কুমিল্লায় সাহিত্য চর্চার মানসে গঠিত হয় নজরুল ললিতকলা পরিষদ। যা পরবর্তীতে নজরুল পরিষদ নামে রূপান্তরিত হয়। ১৯৭২ সালে নজরুল স্মৃতি পরিষদ গঠিত হয়। ১৯৮৩ সালে কুমিল্লার তৎকালিন জেলা প্রশাসক সৈয়দ আমিনুর রহমানের উদ্যোগে কুমিল্লা শহরের যেসব স্থানে নজরুল বিচরণ ও অবস্থান করেছিলেন সেসব স্থানে টিনের স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৯২ সালে জেলা প্রশাসক হেদায়েতুল ইসলাম চৌধুরী কবি নজরুলের অবস্থান ও ঘটে যাওয়া ঘটনার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়ে স্থায়ীভাবে পাকা স্মৃতিফলক স্থাপন করেন।  ১৯৯২ সালে কুমিল্লা শিল্পকলা একাডেমীর সামনে শিল্পী উত্তম গুহের তৈরী চেতনায় নজরুল শীর্ষক একটি স্মৃতি সৌধ নির্মিত হয়। সবশেষ ২০১৩ সালে ২০এপ্রিল কুমিল্লার ঐতিহাসিক ধর্মসাগরের উত্তরপাড়ে আর পার্কের দক্ষিণাংশে নজরুল ইন্সটিটিউট,কুমিল্লা কেন্দ্রের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নজরুল ইন্সটিটিউট মানেই নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র। ত্রিশাল ও দরিরামপুরের পর কুমিল্লায় এটি তৃতীয় নজরুল স্মৃতিকেন্দ্র। নজরুল ইন্সটিটিউট কুমিল্লা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় নজরুল গবেষণায় নজরুল অনুরাগীদের ব্যাপক ভূমিকা রাখার পথ তৈরি হয়েছে। এসব স্মৃতিফলকের মধ্যে নজরুল এভিনিউ সড়কে পশ্চিমদিকে প্রবেশ মুখের উত্তর পাশে বসন্ত মজুমদারের বাড়ির সামনের স্মৃতিফলক, নজরুল এভিনিউয়ের ফরিদা বিদ্যায়তনের সামনে ও কবির শ্বশুরবাড়ি অর্থাৎ ইন্দ্রকুমার সেনের বাড়ির সামনের স্মৃতিফলকটি ঘিরে রয়েছে এখানে কবির অবস্থানের বর্ণনা। ঝাউতলায় উকিল যোগেন্দ্র চন্দ্রের বাড়ির সামনের ফলক, দারোগাবাড়ি মাজার সংলগ্ন যে বাড়িতে কবি গানের আসরে বসতেন সেখানে বাড়ির বারন্দার ভেতরের দেয়ালে স্থাপিত ফলক, মুরাদপুর মৌলভীপাড়ার জানে আলম চৌধুরীর বাড়িতে (অধ্যাপক আমীর আলী চৌধুরীর বাসভবনের দেয়ালে) স্থাপিত ফলক এবং দক্ষিনচর্থায় শচীনদেব বর্মনের বাড়ির দেয়ালে নজরুলের স্মৃতিফল রয়েছে। এছাড়াও ভিক্টোরিয়া কলেজের সামনে রাণীর দিঘীর দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে বসে কবি ‘মাধবী লতা দোলেসহ বেশ কয়েকটি গান লিখেছেন। দিঘীর ওই কোনেও রয়েছে নজরুল স্মৃতিফলক। 

ধর্মপ্রেমি, বিলাসিতা ও ব্যবসায়িক নজরুলঃ
নজরুলের সমগ্র কোরআন শরীফ ছিল তার কন্ঠস্ত এ কারণে সেনা ব্যারাকে তাকে হাফেজ বলা হত। কবি নিত্য দিনের অভ্যাস ছিল টয়লেটে বসে খবরের কাগজ পড়া। কবির যখন ক’বছর অর্থাগম ভালোছিল তখন তিনি মাহিনী তেল কিংবা ল্যাভেন্ডাস পিয়াসা গ্লিসারিন সাবান, ফলহ্যান্স টুথপেষ্ট, হেজলিন ব্লো, কিংবা টিন ক্রী, কিউটি কিউরা বড়ি পাউডার, ক্যালফোর্নিয়া পপি কিংবা জবা কুসুম তেল, পন্ডস ফেস পাউডার, ইভনিং ইন প্যারিস সেন্ট শোবার সময় মুখ মারকুলাইড ওয়াস ব্যবহার করতেন। তার ব্যবহার সব জিনিস ছিল অত্যন্ত দামী ও ঐ সময়ের শ্রেষ্ঠ দ্রব্য সামগ্রী। কবির আর্থিক অবস্থায় ১৯৩১ সালে ৬ সিলিন্ডার বিশিষ্ট আমেরিকান ক্রাইসলার গাড়ী ক্রয় করেন। কবির বিচিত্র ধরনের বহু কর্মকান্ড হয়েছে। নজরুল এক বিরাট ভলান্টিয়ার বাহিনী গড়ে তোলেন। তিনি ছিলেন সেই বাহিনীর প্রধান। সম্মেলনের আগে তিনি ফিল্ড মার্শালের পোশাক পরে ভলান্টিয়ার বাহিনী পরিচালনা করেন। কবির কৃষ্ণনগর অবস্থানকালে বন্ধ রাজনীতিবিদ হেমন্ত সরকারের সহযোগিতায় একটি নৈশ্য শ্রমজীবি বিদ্যালয় স্থাপন করেন এবং পরিচালনা করেন। কবি নজরুল ব্যবসা ও করেছেন। তিনি দোকান দিয়েছিলেন কলিকাতার বিবেকান্দ রোডে। ১৯৩৪ সালে এ দোকান দেন, দোকানটি ছিল গ্রামো ফোন রেকর্ডের দোকান নাম ছিল ‘‘কলগীতি’’। সাপ্তাহিক চায়া পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন ও দিয়েছিলেন। তবে দোকানটি বেশী দিন চলেনি দিনের পর দিন বাকীতে রেকর্ড দিয়ে ব্যবসা লাটে উঠলো অবশেষে। কোন মুসলমানের পায়ের দুলো নেবে কোন ব্রাহ্মণ? এ কথা ভাবা যায় না ব্রাহ্মণদের মাঝ থেকে এমন ঘটনা ঘটবে কোন সম্ভবনা নেই। নজরুল ছোট বেলায়তার পায়ের ধুলো নিয়েছে শ্রীরাম পুর কলেজের অনেক ব্রাহ্মণ ছাত্র। কবিকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ভরেই প্রণাম করেছে তারা। এ ঘটনার পর কবি নিজকে ব্যাখ্যা করেন ‘‘কবিদের কোন জাত নেই’’ কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন তার প্রিয় কবি। রবীন্দ্রনাথ সাম্যকে বাজে কথা তিনি সহ্য করতেন না। ঐ সময়ে একজন মন্তব্য করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ উচু মানের লেখক নন বড় লোকের ছেলে বলে টাকার জোড়ে নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন। এই কথা শুনে নজরুল এতই যে ত্র“দ্ধ হন মাথায় এত জোড়ে আঘাত করেন যে একবার রক্তারক্তি হয়ে যায়। বিষয়টি মামলা পর্যন্ত গড়ায়। তবে আদালতে উঠার আগে শেষ পর্যন্ত অবশ্যতা নিষ্পত্তি হয়ে যায়। কবির একটা ব্যতিক্রম দিক ছিল আড্ডা মারতে পটু। আড্ডা আসরে বসলে ঘড়ির দিকে দেখতেন না। খাওয়া দাওয়া কাজ কর্ম সব বুলে যেতেন। নজরুল সাহিত্যের কোন শাখায় বিচরণ বাদ রাখেননি। তিনি সাংবাদিককতায় করেছেন। সম্পাদক ছিলেন দৈনিক নবযুগ, অর্ধসাপ্তাহিক ধুমকেতু এবং সাপ্তাহিক নাঙ্গল পত্রিকায়।

তিনি সাংবাদিকতায় ঝড়তুলেন তার লেখার মাধ্যমে। যার কারণে তার ধুমকেতু বাজেয়াপ্ত হয়। কবি তার সন্তানদের নাম রাখার ব্যাপারে ছিল ব্যতিক্রমী। তিনি তার প্রথম সন্তানের নাম রাখেন কাজী কৃষ্ণ মোহাম্মদ (শৈশব মৃত) দ্বিতীয় সন্তানের নাম রাখেন অরিন্দম খালেদ (বাল্য মৃত) তারপর কাজী সব্যসাচী কাজী অনিরুদ্ধ। মুসলমান রীতি অনুযায়ী ছেলে সন্তানদের তিনি খৎনা করাননি। কবি নজরুল অসুস্থ হওয়ার আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারমেডিয়েট পরীক্ষার বাংলা বিষয়ে পরীক নিযুক্ত হয়েছিলেন এবং পরীক্ষক থাকাকালীণ অসুস্তার কিছু কিছু সূচনা হয়। এখানেও একটা বিষয় ব্যতিক্রম যে ব্যক্তি প্রবেশিকাই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হননি তিনি এন্টারমেডিয়েট পরীক্ষার পরীক্ষক নিযুক্ত হয়েছেন। 

নিঃসন্দেহে এও একটা বিরাট ব্যতিক্রম ব্যাপার। সারাজীবন নজরুল ও তার পরিবার হয় অন্যের আশ্রিত না হয়ে ভাড়া বাসায় কাটিয়েছেন। এটা নজরুল জীবনে আরেক ব্যতিক্রম। জন্ম মৃত্যু প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয় এসে যায় কুব সহজেই। কবির জন্ম এক দেশে অথচ তার কবর হয়েছে আরেক দেশে। তিনি বলেছিলেন মসজিদেই পাশে আমার কবর দিও ভাই ঠিক সেভাবেই যেন তাকে কবর দেওয়া হয়েছে। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়। অনুরূপ ভাবে কবি পত্মী প্রমীলা নজরুল কে নিয়েও বলা যায়। তার জন্ম একদেশে কিন্তু মৃত্যু ও সমাহিত হয়েছে অন্যদেশে তিনি সারা জীবন হিন্দু ধর্ম বজায় রাখলেও তার ইচ্ছাতেই তাকে কবর দেওয়া হয় চুরুলিয়ায়। এভাবে শায়িত হন দুই বাংলার দুই দেশে। এ যেন দুই বাংলার সেতুবন্ধন।