লিয়াকত হোসেন
প্রাচীন ও
ঐতিহ্যমণ্ডিত জেলা কুমিল্লা। কথিত
আছে, কমলাংকনগর থেকে কুমিল্লার উত্পত্তি। ১৭৮৫ সালে মুদ্রিত ভগবতচন্দ্র বিশারদ রচিত ত্রিপুরা
সংবাদ সংস্কৃত গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে, ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিকে হোসেন
শাহ যখন গৌড়ের অধিপতি ছিলেন সে সময় ‘কোমিল্লা’ নামে পরিচিত হলে পরে জেলাটি ‘কুমিল্লা’ নামে পরিচিতি লাভ করে। কুমিল্লা
জেলাটি ত্রিভুজাকৃতির। এই জেলার
দর্শনীয় স্থান হলো—ময়মনামতি পাহাড়, রূপবান মুড়া, চণ্ডিমুড়া
মন্দির, শালবন বিহার, নজরুলের স্মৃতি বিজড়িত দৌলতপুর, বৌদ্ধ সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ, বাখরাবাদ
গ্যাস উত্পাদন কেন্দ্র, বোটানিক্যাল গার্ডেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাধি, বড় শরীফপুর মসজিদ, পশ্চিম গাঁওয়ে নওয়াব ফয়জুন্নেসার আমলের বিভিন্ন কীর্তি, শচীন দেব
বর্মণের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি, পল্লী উন্নয়ন কীর্তি, ত্রিপুরা মহারাজাদের আমলের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন ভবন ইত্যাদি। মেঘনা, গোমতি, ছোট ফেনী নদী বয়ে গেছে এই কুমিল্লা জেলার
ওপর দিয়ে। এখানে বিশ্ব রোডের দুই পাশে দেখা
মেলে মুক্ত জলাশয় আর রয়েছে কত না বিলাঞ্চল। মাছের চারণ ক্ষেত্রও বলা হয় এখানের মুক্তজলায়গুলোকে। নেই কোনো মাছের অভাব। তাই কয়েকদিন সময় হাতে নিয়ে বের হয়ে পড়ুন
কুমিল্লায়। এই কুমিল্লাতে রয়েছে—হোমনা, মেঘনা, তিতাস, মনোহরগঞ্জ, মুরাদনগর, কুমিল্লা সদর, সদর দক্ষিণ কুমিল্লা, দাউদকান্দি, চান্দিনা, নাঙ্গলকোট, চৌদ্দগ্রাম, লাকসাম, বরুড়া, ব্রাহ্মণপাড়া, বুড়িচং, দেবীদ্বার প্রভৃতি উপজেলা। এর
যেদিকেই যাবেন খুঁজে পাবেন প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য। ইতিহাস ও ঐতিহ্য খুঁজে খুঁজে বার বার মনে
পড়বেই নওয়াব ফয়জুন্নেসার কথাটি-ই। তিনি
ছিলেন নারী জাগরণের অগ্রণী নেত্রী। জন্ম
১৮৩৪ সালে, মৃত্যু তার ১৯০৩ সালে।
কুমিল্লায় এলে যা মনে দাগ কাটবে : কুমিল্লা শহর থেকে ৪ মাইল দূরে লালমাই ময়নামতি পাহাড়। এখানে সারাদিন কাটানোর মতো মনোরম পরিবেশ খুঁজে পাওয়া যাবে। এমন নৈসর্গিক শোভা সহজে কী আর খুঁজে পাওয়া যায়! সবুজে সবুজে আচ্ছন্ন ওখানে গিয়ে দেখবেন প্রকৃতির রূপ, যেদিকে চোখ যাবে সেদিকেই ছুটে যেতে মন চাইবে। ওখানেই দেখবেন একটি প্রাচীন মন্দির। ৯০০ থেকে ১০০০ সালের মধ্যে এটি চন্দ্রবংশীয় বৌদ্ধ রাজাদের শাসনামলে মানিকচন্দ্র নামে এক রাজার আমলে নির্মিত হয়। তার রানীর নাম ছিল ময়নামতি। তার নাম অনুসারে পরে পাহাড়ের নাম হয় ‘ময়নামতি’। কুমিল্লার সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে যেন কাজী নজরুল ইসলামের বহু স্মৃতি। কুমিল্লা শহরে ছিল প্রমীলার বাড়ি এবং সেখানেই প্রমীলার সঙ্গে নজরুলের প্রেম বিয়েসহ নানা ঘটনা ঘটেছে। ধর্মসাগর দীঘি কুমিল্লার অন্যতম আকর্ষণ। রাজা ধর্মমানিক্যের নামেই এ দীঘির নামকরণ করা হয় ধর্মসাগর দীঘি। স্বচ্ছ চকচকে পরিষ্কার পানি, এ বিশাল দীঘির চারপাশ পাকা। দীঘির ছোট ছোট ঢেউয়ের ওপর এখানে সূর্যের আলো নেচে বেড়ায়। দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন ছোট ছোট প্রদীপ আলো জ্বালিয়ে ভাসছে। পাশেই উদ্যান ও পার্ক—এখানে রয়েছে ইট সিমেন্ট দিয়ে তৈরি বিশ্রামগার। দর্শনার্থীদের ঘিরে এখানে গড়ে উঠেছে নানারকম খাবার ও খেলনার দোকানপাট। ধর্মসাগর দীঘির পানিতে ভেসে বেড়ানোর জন্য নৌকাও রয়েছে।
ঝিলমিল ঝিলমিল ঝিলের পানিতে ঢেউ খেলিয়া যায়... বহুবার গিয়েছি কুমিল্লাতে। গাঁও-গেরাম দেখব বলে এক সকালে ঢাকার রূপনগর আবাসিক এলাকা থেকে সিএনজিতে উঠলাম, কমলাপুর বিআরটিসি বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে পৌঁছলাম ৪০ মিনিট পর। ওখানে গিয়ে শুনি এসি বাসটি নষ্ট হয়ে গেছে, নরমাল বাসে যেতে হবে। সফরসঙ্গী সিলেটের সাকিব চৌধুরী। ১৬০ টাকা করে মোট ৩২০ টাকা দিয়ে টিকিট নিয়ে বাস বসলাম। বাস ছাড়ার নির্ধারিত সময় ছিল সকাল ৭টা। তবে ২০ মিনিট পর ৭টা ২০ মিনিটে বাস ছাড়ল। কাঁচপুর ব্রিজ পেরিয়ে বাস দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলল। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় বাস ঢুকল দশটা দশ মিনিটে। এরপর শুরু হলো যানজট। কুমিল্লার শাসনগাছা বাসস্ট্যান্ডে যখন এলাম তখন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি এগারোটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। বাস থেকে নেমে রিকশা ধরে চললাম রেসকোর্স এলাকার পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশনের কার্যালয়ের দিকে। প্রকল্প পরিচালক সগির ভাই আগেই জানিয়েছিলেন, সেজন্য ওখানে গিয়ে কোনো অসুবিধা হয়নি। পাঁচতলা বিল্ডিংয়ের দোতলায় এশিয়া ব্যাংক, এরই উপরে ফার্নিচারের শোরুম-চারতলা নিয়ে পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশনের কার্যালয় ও পশ্চিম পাশে গেস্ট রুম। মিনিট পনেরো সময় বিশ্রাম-এরপর মোটসাইকেলযোগে বেরিয়ে পড়লাম। রেসকোর্স ছাড়িয়ে ডায়না হোটেল পেছনে রেখে মোটরসাইকেল এগিয়ে চলছে বিশ্বরোডের দিকে। কুমিল্লা—ত্রিপুরার রাজাদের গড়া কয়েকটি পুরনো ভবন চোখে পড়ল। কিংবদন্তির কণ্ঠশিল্পী শচীন দেব বর্মণ যে বাড়িতে থেকে গেছেন সেটিও একনজর চোখে পড়ল। যাওয়ার পথে একটু ঘুরিয়ে ভিক্টোরিয়া কলেজের পুরনো ভবনও দেখালেন মোটরসাইকেল চালক কর্মকর্তা। ধর্মসাগর, জেলা স্কুল ছাড়িয়ে এক সময় বিশ্বরোড হয়ে নিয়ে চললেন দক্ষিণ সদর কুমিল্লা উপজেলাতে। যেদিকে তাকাই চোখে পড়ে মুক্তজলাশয়। কর্মকর্তা জানালেন, এখানে রয়েছে অনেক রকমের মাছ। বিপুল পরিমাণ মাছের উত্পাদন হওয়ায় কুমিল্লায় আজ মাছের ছড়াছড়ি। যার ডোবা আছে, পুকুর কিংবা দীঘি রয়েছে তিনিও করছেন মাছ চাষ। কুমিল্লার ডায়না রেস্টুরেন্টে গেলে দেখবেন হরেকরকমের রান্না করা মাছ। পড়ন্ত বিকালে এলাম গোমতি নদীর তীরে-দেখি বাঁধ। এই বাঁধ দিয়েই দু’কূলের বাসিন্দাদের বন্যা থেকে রক্ষা করা হয়েছে। এক কর্মকর্তা বললেন, এখানে যে বাড়িতেই যাবেন দেখবেন ঘরে ঘরে পালন করা হচ্ছে গাভী, সবারই আছে সবজি বাগান। কেউবা সেলাই মেশিন দিয়ে সালোয়ার-কামিজ তৈরি করে বাড়তি অর্থও উপার্জন করছেন। নকশী কাঁথাও তৈরি করছেন এদের কেউ কেউ। গোটা কুমিল্লায় ছড়িয়ে পড়েছে স্বনির্ভর হওয়ার প্রতিযোগিতা। নকশী কাঁথা তৈরি ও সেলাইয়ের কাজ দেখে অভিভূত হতেই হলো। এবার এগিয়ে চললাম, গোমতির তীরে। এক মাঝি নৌকো ঘাটে রেখে নদীর কূলে বসে গান ধরল—‘ঝিলমিল ঝিলমিল ঝিলের জলে ঢেউ খেলিয়া যায়রে...’
গানটা শেষ হতেই এক বৃদ্ধ এসে বললেন, শুনলেন তো গান—এ গানতো শচীন দেব বর্মণ গেয়েছিলেন বহু বহু বছর আগে। তিনি তো ছিলেন ত্রিপুরারই কুমার দেব বর্মণ বাহাদুরের ছেলে। এই শচীন দেব বর্মণ ভারত বিভক্তির বহু আগেই উপমহাদেশের সঙ্গীত জগতে গায়ক ও সুরের সৃষ্টিকর্তা হিসেবে প্রচুর খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। জানেন, কুমিল্লাতে রয়েছে শচীন দেব বর্মণের একটি বাড়ি, সেটি সংরক্ষণ করা গেলে সর্ব বাংলার ইতিহাস, সংস্কৃতি, শিল্প ও সঙ্গীতপ্রিয় বাঙালিদের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকত...।
পরদিন সকালে চললাম চান্দিনা হয়ে দাউদকান্দির দিকে। সঙ্গে সাকিব চৌধুরী। এক নজর চান্দিনা উপজেলা দেখে বাস ধরে ১ ঘণ্টা পর এলাম দাউদকান্দিতে। কাছে যেতেই গোমতি নদী—এরই পশ্চিমে মেঘনা নদী। এক বাড়িতে ঢুকে দেখি নকশী কাঁথা তৈরি করছে তিন রমণী। দাউদকান্দির তুজারভাঙ্গা পূর্ব এলাকার মহিলা সমিতির সভানেত্রী শানু আক্তার শানু জানালেন, ঐ যে নকশী কাঁথাটা তৈরি হচ্ছে ওটি অর্ডারি মাল-পার্টি আগেই ৫ হাজার টাকা দিয়ে গেছে। ওখান থেকে হেঁটে আমি ও সাকিব এলাম গোমতি নদী তীরে। বসে বসে দেখছি গোমতির অপরূপ রূপ। এঁকে বেঁকে চলে যাওয়া নদীর রূপ দেখে সাকিব ‘চলুন, এই নদী হয়ে বহু দূরে চলুন...।’ হঠাত্ কানে ভেসে এলো—“ওরে সুজন নাইয়্যা কোন বা কন্যার দেশে যাওরে চান্দের ডিঙ্গি বাইয়্যা/ লক্ষ তারার নয়ন কোলে কার চাহনির মানিক জ্বলে আবছা মেঘের পত্রখানি কে দিলো পাঠাইয়্যা ... চোখের জলে তোমার নামটি লিখিলাম গায়...’ গানের এ কথাগুলো। এক মাঝি এই গানটি গাইতে গাইতে নদীর কূলে নাও ভিড়ালেন।
গোমতি নদীর তীরে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাটিয়ে বাস ধরে এবার চললাম কুমিল্লা শহরের দিকে। রাত ৯টা বেজে গেছে, সেই ক্ষণে এসে পৌঁছলাম বাসস্ট্যান্ডে। যানজটের কারণেই সময়টা সেদিন বেশি লেগে গেল। ডায়না হোটেলে গিয়েই খেতে হবে, কেননা ওখানেই মেলে নানা রকমের মাছ, মাংস, গরু, খাসি, মুরগি সবকিছুই রয়েছে।
পরদিন সন্ধ্যায় হেঁটে একাই এলাম কালী মন্দিরে। ওখানেই পরিচয় হলো সতেরো বছর বয়সী এক ছেলের সঙ্গে। নামটি কী? একটু হেসে-‘কৃষ্ণ’। তুমি কী কর? বলল, মন্দিরে মন্দিরে গান করে যা পাই তা দিয়েই সংসার চলে। সংসারে রয়েছে বাবা-মা।
বাবা বহুদিন হয় প্যারালাইসড হয়ে পড়ে আছেন বিছানাতে। ওকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা শচীন দেব বর্মণের সেই বাড়িটিতে তুমি কী কখনও গিয়েছ? হাসল কৃষ্ণ। তা যাবেন নাকি! একদা বাবার মুখে শুনতাম, শচীন কত্তার সেই বিখ্যাত গান ‘বাংলাদেশের ঢোল’। আহা অমন গান কী আর হবে!! রিকশায় উঠে কৃষ্ণ আর আমি চললাম শচীন দেব বর্মণের বাড়িটি দেখতে। বাড়িটি দেখিয়ে কৃষ্ণ—এই বাড়ি নিয়ে বাবার মুখে কী শুনিছি জানেন ...! অনেকটা বিস্মিত হয়ে-‘তা আবার কী!’ কৃষ্ণ বলল, গভীর রাতে ওই বাড়িতে কে যেন গুণ গুণ করে গায়—‘তুমি হইও ফুলরে বন্ধু আমি হবো হাওয়া দেশ বিদেশে ফিরব আমি হইয়া আতেলারে...’। কণ্ঠ যেন অবিকল শচীন দেব বর্মণের মতোই। রাত এখন ৯টা বেজে গেছে। বললাম, কৃষ্ণ চলো ফিরে চলো। —কেন ভিতরে যাবেন না! বললাম, দিনের বেলা যে কোনো একদিন না হয় আসব। এবার রিকশা ধরে চললাম পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশনের অফিসের দিকে। শীত শীত লাগছে। কার্তিক মাস হয়তো তাই। কৃষ্ণ—‘যাবেন নাকি গোমতির তীরে?’ ওখানে এখন পানিতে চাঁদের আলোর প্রতিচ্ছবি দেখা মেলে। কখনোবা মনে হবে, চাঁদ যেন ভাসছে নদীর বুকেই। এদিকে মোবাইলটা ভেজে উঠতেই দেখি সাকিব চৌধুরী ফোন দিয়েছে। কৃষ্ণ আমাকে নামিয়ে দিয়ে—‘আবার কুমিল্লায় আসবেন কিন্তু। আপনাকে যে খু-উ-ব ভালো লেগেছে...। সাকিব চৌধুরীর সঙ্গে ফিরলাম গেস্ট রুমে।
কুমিল্লায় যেভাবে যাবেন : সড়ক পথে ঢাকা থেকে কুমিল্লাতে যেতে সময় লাগে (যানজট না থাকলে) দেড় থেকে দু’ঘণ্টা। কমলাপুর বিআরটিসি বাস ডিপো থেকে এসি/নন এসি বাস ছাড়ে ৩০ মিনিট পর পর। এসি বাসে ভাড়া ১৮০ টাকা; নন এসিতে ১৬০ টাকা। সায়েদাবাদ থেকে ছাড়ে—তিশা, এশিয়া পরিবহন। ভাড়া ২০০ থেকে ২২০ টাকা। ট্রেনেও কুমিল্লা যাওয়া যায় তবে সময় লাগে ৫ ঘণ্টা।
যেখানে থাকবেন : কুমিল্লায় রয়েছে হোটেলের ছড়াছড়ি। যেমন-হোটেল নূরজাহান, শিবলি হোটেল, হোটেল প্যালেস, আমানিয়া রেস্ট হাউজ, হোটেল ড্রিমল্যান্ড, হোটেল নিদ্রাবাগ, হোটেল সোনালী, হোটেল মিডটাউন, হোটেল ময়নামতি, কানন লেক রিসোর্ট, হোটেল বিলাস, হোটেল সাগরিকা, হোটেল পিপাসা, হোটেল গোমতি, আজমির হোটেল, হোটেল তাজ, উজালা হোটেল, মেলোডি হোটেল, হোটেল রাজমনি, রেড রুফ হোটেল প্রভৃতি।
ভ্রমণ খরচ : ৩ থেকে ৪ দিন সময় হাতে নিয়ে কুমিল্লায় বেড়াতে গেলে সবচেয়ে ভালো হয়। এ ভ্রমণে ৩ হাজার টাকা করে নিয়ে গেলে চলবে। বিস্তারিত তথ্য জানতে চাইলে লেখকে -০১৭১৫২৩১৬৭৫ নম্বরে ফোন করা যেতে পারে। হেমন্ত-শীত আর বসন্তকালে কুমিল্লায় গিয়ে পাবেন প্রচুর আনন্দ।
কুমিল্লায় এলে যা মনে দাগ কাটবে : কুমিল্লা শহর থেকে ৪ মাইল দূরে লালমাই ময়নামতি পাহাড়। এখানে সারাদিন কাটানোর মতো মনোরম পরিবেশ খুঁজে পাওয়া যাবে। এমন নৈসর্গিক শোভা সহজে কী আর খুঁজে পাওয়া যায়! সবুজে সবুজে আচ্ছন্ন ওখানে গিয়ে দেখবেন প্রকৃতির রূপ, যেদিকে চোখ যাবে সেদিকেই ছুটে যেতে মন চাইবে। ওখানেই দেখবেন একটি প্রাচীন মন্দির। ৯০০ থেকে ১০০০ সালের মধ্যে এটি চন্দ্রবংশীয় বৌদ্ধ রাজাদের শাসনামলে মানিকচন্দ্র নামে এক রাজার আমলে নির্মিত হয়। তার রানীর নাম ছিল ময়নামতি। তার নাম অনুসারে পরে পাহাড়ের নাম হয় ‘ময়নামতি’। কুমিল্লার সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে যেন কাজী নজরুল ইসলামের বহু স্মৃতি। কুমিল্লা শহরে ছিল প্রমীলার বাড়ি এবং সেখানেই প্রমীলার সঙ্গে নজরুলের প্রেম বিয়েসহ নানা ঘটনা ঘটেছে। ধর্মসাগর দীঘি কুমিল্লার অন্যতম আকর্ষণ। রাজা ধর্মমানিক্যের নামেই এ দীঘির নামকরণ করা হয় ধর্মসাগর দীঘি। স্বচ্ছ চকচকে পরিষ্কার পানি, এ বিশাল দীঘির চারপাশ পাকা। দীঘির ছোট ছোট ঢেউয়ের ওপর এখানে সূর্যের আলো নেচে বেড়ায়। দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন ছোট ছোট প্রদীপ আলো জ্বালিয়ে ভাসছে। পাশেই উদ্যান ও পার্ক—এখানে রয়েছে ইট সিমেন্ট দিয়ে তৈরি বিশ্রামগার। দর্শনার্থীদের ঘিরে এখানে গড়ে উঠেছে নানারকম খাবার ও খেলনার দোকানপাট। ধর্মসাগর দীঘির পানিতে ভেসে বেড়ানোর জন্য নৌকাও রয়েছে।
ঝিলমিল ঝিলমিল ঝিলের পানিতে ঢেউ খেলিয়া যায়... বহুবার গিয়েছি কুমিল্লাতে। গাঁও-গেরাম দেখব বলে এক সকালে ঢাকার রূপনগর আবাসিক এলাকা থেকে সিএনজিতে উঠলাম, কমলাপুর বিআরটিসি বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে পৌঁছলাম ৪০ মিনিট পর। ওখানে গিয়ে শুনি এসি বাসটি নষ্ট হয়ে গেছে, নরমাল বাসে যেতে হবে। সফরসঙ্গী সিলেটের সাকিব চৌধুরী। ১৬০ টাকা করে মোট ৩২০ টাকা দিয়ে টিকিট নিয়ে বাস বসলাম। বাস ছাড়ার নির্ধারিত সময় ছিল সকাল ৭টা। তবে ২০ মিনিট পর ৭টা ২০ মিনিটে বাস ছাড়ল। কাঁচপুর ব্রিজ পেরিয়ে বাস দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলল। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় বাস ঢুকল দশটা দশ মিনিটে। এরপর শুরু হলো যানজট। কুমিল্লার শাসনগাছা বাসস্ট্যান্ডে যখন এলাম তখন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি এগারোটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। বাস থেকে নেমে রিকশা ধরে চললাম রেসকোর্স এলাকার পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশনের কার্যালয়ের দিকে। প্রকল্প পরিচালক সগির ভাই আগেই জানিয়েছিলেন, সেজন্য ওখানে গিয়ে কোনো অসুবিধা হয়নি। পাঁচতলা বিল্ডিংয়ের দোতলায় এশিয়া ব্যাংক, এরই উপরে ফার্নিচারের শোরুম-চারতলা নিয়ে পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশনের কার্যালয় ও পশ্চিম পাশে গেস্ট রুম। মিনিট পনেরো সময় বিশ্রাম-এরপর মোটসাইকেলযোগে বেরিয়ে পড়লাম। রেসকোর্স ছাড়িয়ে ডায়না হোটেল পেছনে রেখে মোটরসাইকেল এগিয়ে চলছে বিশ্বরোডের দিকে। কুমিল্লা—ত্রিপুরার রাজাদের গড়া কয়েকটি পুরনো ভবন চোখে পড়ল। কিংবদন্তির কণ্ঠশিল্পী শচীন দেব বর্মণ যে বাড়িতে থেকে গেছেন সেটিও একনজর চোখে পড়ল। যাওয়ার পথে একটু ঘুরিয়ে ভিক্টোরিয়া কলেজের পুরনো ভবনও দেখালেন মোটরসাইকেল চালক কর্মকর্তা। ধর্মসাগর, জেলা স্কুল ছাড়িয়ে এক সময় বিশ্বরোড হয়ে নিয়ে চললেন দক্ষিণ সদর কুমিল্লা উপজেলাতে। যেদিকে তাকাই চোখে পড়ে মুক্তজলাশয়। কর্মকর্তা জানালেন, এখানে রয়েছে অনেক রকমের মাছ। বিপুল পরিমাণ মাছের উত্পাদন হওয়ায় কুমিল্লায় আজ মাছের ছড়াছড়ি। যার ডোবা আছে, পুকুর কিংবা দীঘি রয়েছে তিনিও করছেন মাছ চাষ। কুমিল্লার ডায়না রেস্টুরেন্টে গেলে দেখবেন হরেকরকমের রান্না করা মাছ। পড়ন্ত বিকালে এলাম গোমতি নদীর তীরে-দেখি বাঁধ। এই বাঁধ দিয়েই দু’কূলের বাসিন্দাদের বন্যা থেকে রক্ষা করা হয়েছে। এক কর্মকর্তা বললেন, এখানে যে বাড়িতেই যাবেন দেখবেন ঘরে ঘরে পালন করা হচ্ছে গাভী, সবারই আছে সবজি বাগান। কেউবা সেলাই মেশিন দিয়ে সালোয়ার-কামিজ তৈরি করে বাড়তি অর্থও উপার্জন করছেন। নকশী কাঁথাও তৈরি করছেন এদের কেউ কেউ। গোটা কুমিল্লায় ছড়িয়ে পড়েছে স্বনির্ভর হওয়ার প্রতিযোগিতা। নকশী কাঁথা তৈরি ও সেলাইয়ের কাজ দেখে অভিভূত হতেই হলো। এবার এগিয়ে চললাম, গোমতির তীরে। এক মাঝি নৌকো ঘাটে রেখে নদীর কূলে বসে গান ধরল—‘ঝিলমিল ঝিলমিল ঝিলের জলে ঢেউ খেলিয়া যায়রে...’
গানটা শেষ হতেই এক বৃদ্ধ এসে বললেন, শুনলেন তো গান—এ গানতো শচীন দেব বর্মণ গেয়েছিলেন বহু বহু বছর আগে। তিনি তো ছিলেন ত্রিপুরারই কুমার দেব বর্মণ বাহাদুরের ছেলে। এই শচীন দেব বর্মণ ভারত বিভক্তির বহু আগেই উপমহাদেশের সঙ্গীত জগতে গায়ক ও সুরের সৃষ্টিকর্তা হিসেবে প্রচুর খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। জানেন, কুমিল্লাতে রয়েছে শচীন দেব বর্মণের একটি বাড়ি, সেটি সংরক্ষণ করা গেলে সর্ব বাংলার ইতিহাস, সংস্কৃতি, শিল্প ও সঙ্গীতপ্রিয় বাঙালিদের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকত...।
পরদিন সকালে চললাম চান্দিনা হয়ে দাউদকান্দির দিকে। সঙ্গে সাকিব চৌধুরী। এক নজর চান্দিনা উপজেলা দেখে বাস ধরে ১ ঘণ্টা পর এলাম দাউদকান্দিতে। কাছে যেতেই গোমতি নদী—এরই পশ্চিমে মেঘনা নদী। এক বাড়িতে ঢুকে দেখি নকশী কাঁথা তৈরি করছে তিন রমণী। দাউদকান্দির তুজারভাঙ্গা পূর্ব এলাকার মহিলা সমিতির সভানেত্রী শানু আক্তার শানু জানালেন, ঐ যে নকশী কাঁথাটা তৈরি হচ্ছে ওটি অর্ডারি মাল-পার্টি আগেই ৫ হাজার টাকা দিয়ে গেছে। ওখান থেকে হেঁটে আমি ও সাকিব এলাম গোমতি নদী তীরে। বসে বসে দেখছি গোমতির অপরূপ রূপ। এঁকে বেঁকে চলে যাওয়া নদীর রূপ দেখে সাকিব ‘চলুন, এই নদী হয়ে বহু দূরে চলুন...।’ হঠাত্ কানে ভেসে এলো—“ওরে সুজন নাইয়্যা কোন বা কন্যার দেশে যাওরে চান্দের ডিঙ্গি বাইয়্যা/ লক্ষ তারার নয়ন কোলে কার চাহনির মানিক জ্বলে আবছা মেঘের পত্রখানি কে দিলো পাঠাইয়্যা ... চোখের জলে তোমার নামটি লিখিলাম গায়...’ গানের এ কথাগুলো। এক মাঝি এই গানটি গাইতে গাইতে নদীর কূলে নাও ভিড়ালেন।
গোমতি নদীর তীরে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাটিয়ে বাস ধরে এবার চললাম কুমিল্লা শহরের দিকে। রাত ৯টা বেজে গেছে, সেই ক্ষণে এসে পৌঁছলাম বাসস্ট্যান্ডে। যানজটের কারণেই সময়টা সেদিন বেশি লেগে গেল। ডায়না হোটেলে গিয়েই খেতে হবে, কেননা ওখানেই মেলে নানা রকমের মাছ, মাংস, গরু, খাসি, মুরগি সবকিছুই রয়েছে।
পরদিন সন্ধ্যায় হেঁটে একাই এলাম কালী মন্দিরে। ওখানেই পরিচয় হলো সতেরো বছর বয়সী এক ছেলের সঙ্গে। নামটি কী? একটু হেসে-‘কৃষ্ণ’। তুমি কী কর? বলল, মন্দিরে মন্দিরে গান করে যা পাই তা দিয়েই সংসার চলে। সংসারে রয়েছে বাবা-মা।
বাবা বহুদিন হয় প্যারালাইসড হয়ে পড়ে আছেন বিছানাতে। ওকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা শচীন দেব বর্মণের সেই বাড়িটিতে তুমি কী কখনও গিয়েছ? হাসল কৃষ্ণ। তা যাবেন নাকি! একদা বাবার মুখে শুনতাম, শচীন কত্তার সেই বিখ্যাত গান ‘বাংলাদেশের ঢোল’। আহা অমন গান কী আর হবে!! রিকশায় উঠে কৃষ্ণ আর আমি চললাম শচীন দেব বর্মণের বাড়িটি দেখতে। বাড়িটি দেখিয়ে কৃষ্ণ—এই বাড়ি নিয়ে বাবার মুখে কী শুনিছি জানেন ...! অনেকটা বিস্মিত হয়ে-‘তা আবার কী!’ কৃষ্ণ বলল, গভীর রাতে ওই বাড়িতে কে যেন গুণ গুণ করে গায়—‘তুমি হইও ফুলরে বন্ধু আমি হবো হাওয়া দেশ বিদেশে ফিরব আমি হইয়া আতেলারে...’। কণ্ঠ যেন অবিকল শচীন দেব বর্মণের মতোই। রাত এখন ৯টা বেজে গেছে। বললাম, কৃষ্ণ চলো ফিরে চলো। —কেন ভিতরে যাবেন না! বললাম, দিনের বেলা যে কোনো একদিন না হয় আসব। এবার রিকশা ধরে চললাম পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশনের অফিসের দিকে। শীত শীত লাগছে। কার্তিক মাস হয়তো তাই। কৃষ্ণ—‘যাবেন নাকি গোমতির তীরে?’ ওখানে এখন পানিতে চাঁদের আলোর প্রতিচ্ছবি দেখা মেলে। কখনোবা মনে হবে, চাঁদ যেন ভাসছে নদীর বুকেই। এদিকে মোবাইলটা ভেজে উঠতেই দেখি সাকিব চৌধুরী ফোন দিয়েছে। কৃষ্ণ আমাকে নামিয়ে দিয়ে—‘আবার কুমিল্লায় আসবেন কিন্তু। আপনাকে যে খু-উ-ব ভালো লেগেছে...। সাকিব চৌধুরীর সঙ্গে ফিরলাম গেস্ট রুমে।
কুমিল্লায় যেভাবে যাবেন : সড়ক পথে ঢাকা থেকে কুমিল্লাতে যেতে সময় লাগে (যানজট না থাকলে) দেড় থেকে দু’ঘণ্টা। কমলাপুর বিআরটিসি বাস ডিপো থেকে এসি/নন এসি বাস ছাড়ে ৩০ মিনিট পর পর। এসি বাসে ভাড়া ১৮০ টাকা; নন এসিতে ১৬০ টাকা। সায়েদাবাদ থেকে ছাড়ে—তিশা, এশিয়া পরিবহন। ভাড়া ২০০ থেকে ২২০ টাকা। ট্রেনেও কুমিল্লা যাওয়া যায় তবে সময় লাগে ৫ ঘণ্টা।
যেখানে থাকবেন : কুমিল্লায় রয়েছে হোটেলের ছড়াছড়ি। যেমন-হোটেল নূরজাহান, শিবলি হোটেল, হোটেল প্যালেস, আমানিয়া রেস্ট হাউজ, হোটেল ড্রিমল্যান্ড, হোটেল নিদ্রাবাগ, হোটেল সোনালী, হোটেল মিডটাউন, হোটেল ময়নামতি, কানন লেক রিসোর্ট, হোটেল বিলাস, হোটেল সাগরিকা, হোটেল পিপাসা, হোটেল গোমতি, আজমির হোটেল, হোটেল তাজ, উজালা হোটেল, মেলোডি হোটেল, হোটেল রাজমনি, রেড রুফ হোটেল প্রভৃতি।
ভ্রমণ খরচ : ৩ থেকে ৪ দিন সময় হাতে নিয়ে কুমিল্লায় বেড়াতে গেলে সবচেয়ে ভালো হয়। এ ভ্রমণে ৩ হাজার টাকা করে নিয়ে গেলে চলবে। বিস্তারিত তথ্য জানতে চাইলে লেখকে -০১৭১৫২৩১৬৭৫ নম্বরে ফোন করা যেতে পারে। হেমন্ত-শীত আর বসন্তকালে কুমিল্লায় গিয়ে পাবেন প্রচুর আনন্দ।