24 May 2014

পঁচিশে মে ঘুরে আসুন নজরুলের শহর কুমিল্লায়


পঁচিশে মেজাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিননজরুলপ্রেমীরা তো বটেই, আপনিও ঘুরে আসতে পারেন নজরুলের শহর কুমিল্লায়!

নাহ, আপনি ভুল দেখেননি... আসলেই কুমিল্লা নজরুলের শহর!

জাতীয় কবির এতো স্মৃতি যে বাংলাদেশের আর কোনো শহরেই নেই, তাছাড়া- দ্রোহ আর প্রেমের কবি নজরুলের উত্থানও তো সেখানেই

অবাক হওয়ার মতো হলেও সত্যিসাধারণ নজরুল কুমিল্লায় এসেই হয়ে ওঠেন অসাধারণ প্রেমে-বিরহে, সংগ্রাম আর গ্রেফতারে হয়ে ওঠেন বিদ্রোহের প্রতীক

তাঁর স্মরণে কুমিল্লার ধর্মসাগর পাড়ে গড়ে তোলা হয়েছে নজরুল ইনস্টিটিউট

গতবছরের এপ্রিলে চালু হওয়া এ ইনস্টিটিউট জানায়, কবি 'বিদ্রোহের দায়ে' প্রথমবার গ্রেফতার হন কুমিল্লার ঝাউতলা এলাকা থেকেআর সেখান থেকেই বিদ্রোহের কবি নজরুল তাঁর লেখনীতে যোগ করেন নতুন মাত্রা

যেখান থেকে পুলিশ তাকে আটক করেছিল, কুমিল্লার জেলা প্রশাসন সেখানে একটি ফলক লাগিয়েছেনআর, তাতে উল্লেখ আছে, এই রাস্তার পাশেই বসে থাকা অবস্থায় কবিকে প্রথমবারের মতো গ্রেফতার করা হয়েছিল

মজার বিষয় হলো- কুমিল্লায় অবস্থান করে লেখা আনন্দময়ীর আগমনকবিতার জন্যই কবিকে গ্রেফতার করা হয়তারিখটা মনে রাখতে পারেন১৯২১ সালের ২১ নভেম্বর

অবশ্য, শহরের বিশিষ্টজনদের তাড়ায় দিনকয়েক পরই ছাড়া পেলেন নজরুল

কিন্তু, তার পরদিন থেকেই নজরুলের নেতৃত্বে মিছিল বের হয় কুমিল্লার রাস্তায়, কণ্ঠে গান ভিক্ষা দাওগো পুরবাসী

ফলাফল, শহরের রাজগঞ্জ এলাকা থেকে কতোয়ালি থানা পুলিশ আবার তাকে গ্রেফতার করে!

নজরুলের জীবনে দুজন নারীর উপস্থিতি খুব গাঢ়ভাবে খুঁজে পাওয়া যায়নার্গিস আর প্রমীলানজরুলের হৃদয়ের দুই সারথীএকজন চাঁদ তো অন্যজন নীল সরোবর

নজরুল ইনস্টিটিউটে রক্ষিত ইতিহাস থেকে জানা যায়, আলী আকবর খান কবিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন তার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগরের দৌলতপুরকুমিল্লা শহর ছিল তাদের বিরতি কেন্দ্রসেই প্রথম নজরুলের কুমিল্লা যাওয়াকিন্তু পরবর্তীকালে ঘটনাপ্রবাহে তাঁর জীবনের মুখ্য আয়োজনে জড়িয়ে পড়ে কুমিল্লা শহর

কাজী নজরুল ইসলাম কুমিল্লায় এসেছিলেন ৫ বারসবমিলিয়ে তিনি কুমিল্লায় থেকেছেন ১১ মাস

১৯২১ সালের এপ্রিল মাসে প্রথম কুমিল্লায় আসেনসে যাত্রায় দৌলতপুর অবস্থান করেন তিন মাসদ্বিতীয়বার ১৯২১ সালের নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর, তৃতীয়বার ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে জুন, চতুর্থবার ১৯২২ সালের অক্টোবর থেকে ২৩ নভেম্বর এবং পঞ্চমবার ১৯২৩ সালের ডিসেম্বর থেকে চলে যাওয়ার তারিখ অজ্ঞাত

কুমিল্লায় এসে প্রতিবারই তিনি কান্দিরপাড়ে বন্ধু ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে উঠতেনবর্তমান ফরিদা বিদ্যায়তনের উল্টোদিকে মানে গোমতী হাসপাতালের ঠিক পেছনের বাড়িটাতে থাকতেন তিনি

প্রথমবার দৌলতপুর থেকে ফেরার পর অসুস্থ কবিকে সেবাযত্নের মাধ্যমে কাছে পায় আশালতা সেনগুপ্তা ওরফে দুলি কুমিল্লার মেয়ে দুলির রুপে-গুণে মুগ্ধ কবি তার নাম দেন প্রমীলাপরে ১৯২২ সালে তাদের প্রেম পূর্ণতা লাভ করে১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল নজরুলের সঙ্গে প্রমীলার বিয়ে হয়আজীবন একসঙ্গেই ছিলেন দুজন

কুমিল্লা টাউন হল ময়দানেও অনেক সমাবেশ, অনেক জনসভায় অংশ নিয়েছেন কবিমরহুম জননেতা আশরাফ উদ্দিন চৌধুরীর অনুরোধে কবি এখানে এক জনসভায় গেয়েছিলেন মরণ-বরণগানটি ১৯২২ সালের মার্চ মাসে কবির নেতৃত্বে টাউন হলের সামনে থেকেই মিছিল বের হয় গান্ধীকে গ্রেফতারের প্রতিবাদেসে মিছিলে কবি গেয়েছিলেন আজি রক্ত নিশি ভোরে, একি এ শুনি ওরে...গানটি

শহরের প্রাণকেন্দ্র কান্দিরপাড়েই এ টাউন হলগেলে, দেখতে ভুলবেন না যেন

এছাড়াও, শহরের বজ্রপুরে অবস্থিত বহু পুরনো ইউসুফ স্কুল, যার কাছেই ছিল অবিনাশ ময়রার দোকানএই দোকানের পাউরুটি ও রসগোল্লা ছিল কবির প্রিয়

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের পুরনো ভবনের সামনে বিখ্যাত রানীর দিঘি, এই দিঘির পশ্চিম-দক্ষিণ কোণে নজরুল আড্ডা জমাতেন ছাত্রদের নিয়েকুমিল্লায় থাকাকালে নজরুল প্রায় প্রতিদিন এখানে বসে কলেজপড়ুয়া তরুণদের নিয়ে গানের আসর বসাতেন মাধবী লতা দোলে...সহ আরও কয়েকটি গান এখানেই রচনা করেন কবি

শহরের মহেশাঙ্গনস্থানটি, বর্তমান কুমিল্লা টাওয়ারের উল্টোদিকেনজরুল স্মৃতিবাহীতখন স্বদেশী আন্দোলনের যুগপ্রতিদিন সভা-সমাবেশ লেগেই থাকত মহেশাঙ্গনেএখানে অনেক সমাবেশে ভক্তদের অনুরোধে গানে অংশ নিতেন বিদ্রোহী কবিআলো জ্বালা আলো জ্বালাগানটির সৃষ্টি এখানেই

মুরাদপুর চৌমুহনীর কাছেই ইতিহাসখ্যাত জানুমিয়ার বাড়িজানে আলম চৌধুরী ছিলেন নজরুলের সুহৃদএই বাড়িতে রক্ষিত ছিল নজরুলের ব্যবহৃত তবলাএই বাড়িটি একতলা ছিল, এখন দ্বিতলএই বাড়ির ফলকে লেখা আছে— ‘এই মুরাদপুর মৌলভী বাড়ির জানে আলম চৌধুরী (জানু মিয়া) ছিলেন একনিষ্ঠ সঙ্গীত সাধকউপমহাদেশের অনেক প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পীরা এই বৈঠকখানায় গানের আসর জমিয়েছেনতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু, শচীন দেব বর্মণ ও কাজী নজরুল ইসলাম

কুমিল্লায় নজরুলের এসব স্মৃতি ধরে রাখার প্রথম উদ্যোগ নেন মরহুম এম এ কুদ্দুসকুমিল্লায় নজরুলগ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ‘এতো যার দান, কুমিল্লা কি করেছে সেই কবি নজরুলের জন্য? করার মধ্যে কি কবির একার সম্মান? না, কুমিল্লারও তাতে গৌরব! কুমিল্লার কৃতিত্ব

হয়তো এই বেদনা ও ক্ষোভের তাড়না থেকেই তিনি ১৯৬২ সালে জেলা প্রশাসনকে কান্দিরপাড়-রাণীরবাজার রাস্তাকে নজরুল এভিনিউনামকরণের প্রস্তাব দেন

যদিও কুমিল্লায় নজরুল চর্চার সূত্রপাত নজরুলের সময় থেকেই, কিন্তু এর প্রাতিষ্ঠানিক যাত্রা শুরু ১৯৪৭ এর পর থেকেসে সময় প্রতিষ্ঠিত হয় নজরুল পাঠাগার, যা পরিচর্যার অভাবে পরে অবশ্য বিলুপ্ত হয়ে গেছে

১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় নজরুল পরিষদনজরুল পরিষদ নিজস্ব ভবন পায় ১৯৭২ সালে

নজরুলকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানের মাঝে ১৯৬৯ সালে কুমিল্লার পিপুলিয়ায় প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় নজরুল একাডেমি হাই স্কুল১৯৭৩ সালে স্থাপন করা হয় গুলবাগিচা প্রাথমিক বিদ্যালয়আশির দশকে ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ডিগ্রি শাখার ছাত্রাবাসের নামকরণ হয় নজরুলের নামেনব্বইয়ের দশকে লায়ন্স ক্লাব প্রতিষ্ঠা করে নজরুল কিন্ডার গার্টেন ও নজরুল থিয়েটার

এছাড়াও, কবির স্মৃতিবিজড়িত প্রিয়বন্ধু সুলতান মাহমুদ মজুমদারের বাসায় অধ্যাপক হাসান ইমাম ফটিক প্রতিষ্ঠা করেন নজরুল মেমোরিয়াল একাডেমি

সর্বশেষ, গতবছর এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করে এলেন চাকচিক্যখচিত নজরুল ইনস্টিটিউট

সময় নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন জাতীয় কবির পায়ের ছাপপড়া সবকটি তীর্থই



শেয়ার করুনঃ

Author:

কুমিল্লা অঞ্চলটি একসময় প্রাচীন সমতট অঞ্চলের অধীনে ছিল। পরবর্তীকালে এটি ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে যোগ দেয়। খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে কুমিল্লা জেলা হরিকেল অঞ্চলের রাজাদের অধীনে আসে। অষ্টম শতাব্দীতে লালমাই ময়নামতি দেব বংশ এবং দশম থেকে একাদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চন্দ্র বংশের শাসনাধীনে ছিল। ১৭৬৫ সালে এ অঞ্চলটি ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে আসে। ১৭৯০ সালে জেলাটি ত্রিপুরা জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬০ সালে এর নাম পরিবর্তন করে কুমিল্লা রাখা হয়। ১৯৮৪ সালে কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা পৃথক জেলায় পরিণত হয়।