07 April 2014

আমার একটা নদী ছিল


আমার শৈশব-কৈশোর কেটেছে গ্রামে। আমাদের বাড়ির
পাশে একটা নদী আছে। গোমতি নদী। বছরে একবার
সে নদী আমাদের কৈশোর মনে আনন্দের উপলক্ষ হত! পানির
অভাবে সারা বছর নদীটি রুগ্ন থাকলেও বর্ষার শুরুতেই
ইণ্ডিয়ার পাহাড়ী জলের ছোয়ায় ফুলে-ফেপে পরিপূর্ণ যৌবন
লাভ করত সেটি। নদীতে জলের ঢল নামলেই গোমতি নদীর
আশে-পাশের জনগনের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা শুরু
হয়ে যেত। খানিকটা আনন্দ। খানিকটা ভয়!
চারদিকে একটা উৎসব-উৎসব আমেজ। সবাই দল বেধে নদীর
পানি দেখতে যাওয়া। হাত দিয়ে পানি স্পর্শ করা। নদীর
বাঁধে কাঠি পুতে পানি কতটুকু বেড়েছে তা মেপে দেখা!
তখন প্রায় সবাই মুখে এক ধরনের গাম্ভীর্য মেখে নদীর বাঁধের
উপর হেটে বেড়ায়। এক জন আরেক জনের কাছে জিজ্ঞাস
করে "পানি কতখানি বাড়ল।"
অন্যজনও মুখে আনন্দ চেপে গম্ভির কন্ঠে জবাব দেয়
"একদিনে পাঁচ আঙুল।"
" ওহ! মনে হয় এবার ভাঙা পড়বই।"
"হ।"
এভাবেই কাজ-কর্ম ফেলে অনেক মানুষ সারাদিন নদীর পাড়ে-
পাড়ে ঘুরে বেড়ায়। নদীর ঘোলা জলের দিকে ঘন্টার পর
ঘন্টা গভীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে। জলের প্রতি মানুষের
এই আকর্ষন চিরন্তন! আশ্চর্য হলেও সত্য সেই জলের
আকর্ষনেই অনেকে মনে-মনে কামনা করে বন্যা হোক।
লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়ুক!
কেউ-কেউ কামনা করে কখন নদীর পানি শুকিয়ে চর জাগবে।
সেই চরে ফসল ফলাবে!
কখনো কখনো নদীর বাঁধ ভাঙতো। পানি চলে যেত
লোকালয়ে। আমাদের বাড়ি নদীর আধা কিলোমিটারের মধ্যে।
নদীর বাঁধ ভাঙলে আমাদের ঘরেও পানি উঠে যেত। আমাদের
আনন্দ দেখে কে। নদীর পানি আমাদের ঘরে! তারচেয়ে বড় কথা,
সে পানিতে স্রোতও আছে! মাছও লাফা-লাফি করে! ছোটদের
জন্যতো এটা বিরাট আনন্দময় ঘটনা। বড়দের জন্য
সেটা আনন্দময় কিনা জানিনা। (যখন বড় হয়েছি তখন আর
নদীর বাঁধ ভাঙেনা। বর্ষায়ও নদীতে পানি থাকেনা। বাঁধ
ভাঙবে কেমন করে! )
আমার ধারনা বন্যার পানি ছোটদের পাশা-পাশি বড়দের মনেও
আনন্দ নিয়ে আসে। কারন, আমি দেখেছি বন্যার
পানি লোকালয়ে চলে আসলে বড়রাও ছুটা-ছুটি শুরু করে দেয়।
কলা-গাছ কেটে ভেলা বানায়। জাল নিয়ে মাছ ধরতে যায়।
চিৎকার চেচামেচি। হৈ-চৈ হুল্লোর। সব কিছুতেই কেমন
একটা উৎসব-উৎসব ভাব। কোন বিরক্তি নেই! ছোটদেরও
তখন বেশী বকা-বকি করেনা। নরম
স্বরে বুঝিয়ে বলে পানি না কমা পর্যন্ত খাটের উপর
বসে থাকতে। আমরা খাটের উপর উঠে বসে থাকতাম।
অথবা যাদের বাড়ি অপেক্ষাকৃত উচু, তাদের বাড়ি চলে যেতাম।
পানি না কমা পর্যন্ত সেখানেই থাকতাম।
কিন্তু, আমাদের আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হতনা। পানি বড়জোর
দুইদিন থাকত। ভাটির টানে সব পানি দুইদিনের ভিতর
শুকিয়ে যেত।
দু-দিনের মধ্যে পানি চলে গেলেও সে তাঁর চিহ্ন রেখে যেত।
ভাঙা রাস্তা-ঘাট। পলি পড়ে থক-থকে উঠান। জলে টই-টুম্বর
পুকুর। যেন এক ধ্বংসস্তুপ।
তারপর শুরু হত চির-পরিচিত নোংরা রাজনীতি। ওমোক
নেতা, তমোক নেতা এলাকার ক্ষতিগ্রস্থদের দেখতে আসেন
দুঃখ মোচন করার অঙ্গীকার নিয়ে। প্রতিজ্ঞা করে যায়,
যাদের ঘর পড়ে গেছে তাদের ঘর তুলে দেওয়া হবে। যাদের ফসল
নষ্ট হয়েছে তাদেরকে বিনামূল্যে চাল দেওয়া হবে।
পানি শুকায়। নেতাদের দেখা আর পাওয়া যায়না।
নেতাদের দেখা পাওয়া না গেলেও কৃষকরা কিন্তু হতাস হয়না।
তাঁরা আবার বীজ বুনে। পরের বছর জমিতে নদীর পলি পড়ার
কারণে চমৎকার ফসল হয়। প্রায় দ্বিগুন, তিনগুন। কৃষকের
মুখেও হাসি ফুটে।

শেয়ার করুনঃ

Author:

কুমিল্লা অঞ্চলটি একসময় প্রাচীন সমতট অঞ্চলের অধীনে ছিল। পরবর্তীকালে এটি ত্রিপুরা রাজ্যের সাথে যোগ দেয়। খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে কুমিল্লা জেলা হরিকেল অঞ্চলের রাজাদের অধীনে আসে। অষ্টম শতাব্দীতে লালমাই ময়নামতি দেব বংশ এবং দশম থেকে একাদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চন্দ্র বংশের শাসনাধীনে ছিল। ১৭৬৫ সালে এ অঞ্চলটি ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে আসে। ১৭৯০ সালে জেলাটি ত্রিপুরা জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬০ সালে এর নাম পরিবর্তন করে কুমিল্লা রাখা হয়। ১৯৮৪ সালে কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা পৃথক জেলায় পরিণত হয়।

0 facebook: