কুমিল্লা
সদর, সদর
দক্ষিণ ও বরুড়া উপজেলাজুড়ে লালমাই পাহাড়। এ পাহাড়ে
রয়েছে অপার সমৃদ্ধির হাতছানি। এখানে পতিত
জমিতে চাষ হতে পারে কমলা।
কোথাও
পাহাড়ের মাথাজুড়ে সবুজ, কোথাও ন্যাড়া। এ পাহাড়ের
মাটি লাল বলে এর নাম লালমাই পাহাড়। কুমিল্লা সদর,
সদর
দক্ষিণ ও বরুড়া উপজেলাজুড়ে লালমাই পাহাড়। এ পাহাড়ে
রয়েছে অপার সমৃদ্ধির হাতছানি। এখানে পতিত
জমিতে চাষ হতে পারে কমলা। এখন চাষ
হচ্ছে করলা, সিম,
কচু,
কাঠ
আলুসহ নানা ধরনের সবজি। বিশেষজ্ঞদের মতে, মাটির গঠন
অনুযায়ী প্রাচীন এ জনপদে অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসতে পারে তেল-গ্যাসের মতো খনিজ
সম্পদ। পাহাড়ের কোলঘেঁষে শালবন বৌদ্ধ বিহার। এ
ছাড়া পাহাড়ের এখানে-সেখানে ছড়িয়ে আছে প্রত্নতত্ত্ব ও ঐতিহাসিক স্থাপনা। নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার হলে পুরো লালমাই পাহাড় এলাকা হতে
পারে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় স্থান।
কুমিল্লা
জেলার ইতিহাস' গ্রন্থ থেকে জানা যায়, লালমাই পাহাড়ের বয়স সাড়ে তিন কোটি
বছর। উত্তর দক্ষিণে লম্বায় ময়নামতি পাহাড়সহ (যার অধিকাংশ বিলুপ্ত)
১২ মাইল। প্রস্থে ৩ মাইল। প্রায়
পাহাড়ের উচ্চতা ৫০ ফুট। কয়েকটির
উচ্চতা ১০০ ফুট। সর্বোচ্চ উচ্চতা ১৫০ ফুট। কথিত আছে, রাম-রাবণের যুদ্ধে লক্ষণ মারাত্দক আহত হন। বৈদ্যের
নির্দেশ, বৈশল্যকরণী
পাতার রস ক্ষত স্থানে লাগালে লক্ষণ ভালো হয়ে যাবে। হনুমান
গাছ চিনতে না পেরে হিমালয় পর্বত পুরোটা হাতে করে নিয়ে আসে। চিকিৎসার
পর আবার পর্বতটা যথাস্থানে নিয়ে যেতে রওনা হন। পথে
পর্বতের কিছু অংশ ভেঙে কুমিল্লা সংলগ্ন লমলম সাগরে পড়ে যায়। তা
থেকে আজকের লালমাই পাহাড়। এ ছাড়া
আরেকটি মুখরোচক গল্প হচ্ছে, এক রাজার দুই মেয়ে ছিল। একজন লালমতি
আরেকজন ময়নামতি। তাদের নাম থেকে আজকের লালমাই ও ময়নামতি
পাহাড়।
বন
কর্মকর্তা তোশাররফ হোসেন জানান, লালমাই পাহাড়ের ১৩ হাজার ৭৬০ একরের
মধ্যে বন বিভাগের অধীনে রয়েছে ৪৮৬ দশমিক ২৫ একর ভূমি। যা
কুমিল্লা ময়নামতি বৌদ্ধ বিহার সংশ্লিষ্ট এলাকায় অবস্থিত।
কুমিল্লা
সদর উপজেলার হাতিগাড়া এলাকায় লালমাই পাহাড়। মাথা
উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ছোট-বড় টিলা। তার গা-জুড়ে
নাম না জানা হাজারো গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ, ঝোপঝাড়। পাহাড়ের
ওপর দিয়েই রাস্তা বয়ে গেছে সদর উপজেলার কালিরবাজারের দিকে। হাতিগাড়ার
উঁচু টিলা থেকে বামে যাদের নজর পড়বে, তাদের চোখ আটকে যাবে পাহাড়ের সবুজে। পাহাড়ের গায়ে সবজি চাষের জায়গাটি শিল্পীর তুলিতে আকা
দৃশ্যের সৌন্দর্যকেও হার মানায়। হাতিগাড়া
গ্রামের মবিনুল হক এ রুক্ষ পাহাড়ে সবুজের ঢেউ খেলিয়েছেন। স্থানীয়রা
জানান, মবিনের
দেখাদেখি পাহাড়ে আরও অনেকে সবজি চাষ করে নিজেকে স্বাবলম্বী করেছেন।
কৃষি
সম্প্রসারণ অধিদফতর কুমিল্লার উপপরিচালক আবু রাশেদ জানান, লালমাই
পাহাড়ে কমলা চাষের জন্য আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সবজি
চাষ করে স্বাবলম্বী হতে কৃষককে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা হচ্ছে।
প্রাকৃতিক
সৌন্দর্যের লীলাভূমি লালমাই পাহাড় দিন দিন তার শ্রী হারাচ্ছে। উজাড় হচ্ছে বন, বিলীন হচ্ছে পাহাড়ের অস্তিত্ব। থেমে যাচ্ছে পশুর ডাক, পাখির কলরব। পাহাড়
কাটা চলছে অবিরাম। কখনো প্রকাশ্যে, কখনো চুরি
করে। বাড়ছে আবাসিক এবং বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের প্রতিযোগিতা। জমির দাম কম হওয়ায় হাউজিং কোম্পানির দৃষ্টি এখন লালমাই
পাহাড়ের ওপর। জন্মদিনের কেকের মতো টুকরো টুকরো হয়ে
নিশ্চিহ্ন হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী লালমাই পাহাড়।
স্থানীয়রা
জানান, এখানে
বার্ড, বিজিবির
সেক্টর হেড কোয়ার্টার, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, সেনানিবাস, পলিটেকনিক
ইনস্টিটিউট, ক্যাডেট
কলেজ, টিচার্স
ট্রেনিং কলেজ হওয়ায় এলাকায় মানুষ বাড়ছে।
২০০৬
সালে লালমাই পাহাড়ের সালমানপুরে চালু হয় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। সম্প্রতি একই এলাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সিসিএন পলিটেকনিক
ইনস্টিটিউট। আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অপেক্ষায়
রয়েছে পাহাড়ের নীরবতা ভেঙে নতুন ভবন করার। লালমাই
পাহাড়ে কয়েক শতাধিক বাঙালির সঙ্গে বসবাস করেন ৫ শতাধিক ত্রিপুরা উপজাতি। ত্রিপুরা উপজাতি কল্যাণ সমিতির সেক্রেটারি মনীন্দ্র ত্রিপুরা
জানান, তারা
পাহাড়ের মানুষ, পাহাড় ছাড়া তাদের অস্তিত্বই বিলীন হয়ে যাবে। তিনি আরও জানান, লালমাই পাহাড়ের অধিকাংশের মালিকানা
ব্যক্তিগত। যে যার ইচ্ছে মতো পাহাড় কাটছেন,
ভবন
তুলছেন। এ বেপরোয়া আগ্রাসন বন্ধ করা না হলে
আগামী এক দশকে লালমাই পাহাড়ের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না।