প্রাচীনকালের
কথা বাদ দিয়ে যে শহরটি বৃটিশ-ভারতে ছিল সুপরিকল্পিত নগর এবং ব্যাঙ্ক, ট্যাঙ্ক আর
স্বদেশী যুগের 'অনুশীলন'পন্থীদের জন্য খ্যাতির শীর্ষে সেই শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির
বিদ্যাপীঠ 'ত্রিপুরা'
জেলা
আজকের কুমিল্লা নিজেই তার গৌরবোজ্জ্বল অতীতকে ভুলে গেছে চরমভাবে! সুস্থ কোনো
মানুষের পক্ষে যা মেনে নেয়া হবে উন্মাদ হওয়ার শামিল। একজন
সামান্য লেখক হিসেবে এই শহরের দু-একটি সাংস্কৃতিক প্রসঙ্গ এখানে উপস্থাপন করব
তাতেই বর্তমান প্রজন্ম জানতে পারবে কী ছিল কুমিল্লা, কোথায় এসে
দাঁড়িয়েছে সে আর কোন্ দিকে যাবে?
[১]
বাংলা সাহিত্যের আধুনিক কবিতার যুগে সেই ৩০-৪০ এর দশকে যে ক'জন তরুণ
তুর্কী কবির আবির্ভাব ঘটেছিল তাঁরা ছিলেন: জীবনানন্দ দাশ, কাজী নজরুল
ইসলাম, বুদ্ধদেব
বসু, অমিয়
চক্রবর্তী, সুধীন্দ্রনাথ
দত্ত, বিষ্ণু
দে, প্রেমেন্দ্র
মিত্র, অচিন্ত্যকুমার
সেনগুপ্ত, অজিত
দত্ত, সঞ্জয়
ভট্টাচার্য, সমর
সেন, সুভাষ
মুখোপাধ্যায় উল্লেখযোগ্য প্রধান। তাঁদের মধ্যে
দুজন ছিলেন তৎকালীন ত্রিপুরা জেলার অধিবাসী জন্মসূত্রে। এক
বছরের হেরফেরে অগ্রজ বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪ এবং অনুজ সঞ্জয় ভট্টাচার্য
(১৯০৯-১৯৬৯)। কিন্তু তাঁরা ছিলেন সমসাময়িক কবি ও
সাহিত্যিক। তবে তাঁদের মধ্যে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব ছিল
কিনা জানি না লেখালেখি নিয়ে যৎসামান্য ভুল বোঝাবুঝি, মনোমালিন্য
ছিল। বুদ্ধদেব ছেলেবেলা কাটিয়েছিলেন নোয়াখালিতে আর সঞ্জয় কুমিল্লা
শহরে। বুদ্ধদেব ১৩ বছরের সময় ঢাকায় গিয়ে ঢাকা কলেজের ছাত্র হন এবং
পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ.ডিগ্রি নিয়ে কলকাতা চলে যান চিরতরে। সঞ্জয় ভট্টাচার্য কুমিল্লাতেই পড়ালেখা করেছেন, স্কুল জীবন
বিখ্যাত ঈশ্বর পাঠশালা এবং ভিক্টোরিয়া কলেজে বি.এ.পর্যন্ত। তারপর
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ.নিয়েছিলেন। তিনিও পরে
কলকাতাবাসী হন।
যেহেতু
কবি-সাহিত্যিক বলতেই আড্ডাপ্রেমী তাই তাঁরাও ব্যতিক্রম ছিলেন না। 'কল্লোল' কাগজ আধুনিক বাংলা সাহিত্য-সাময়িকীগুলোর আদিমাতা বলা যায়। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন গোকুলচন্দ্র নাগ এবং চট্টগ্রামের
দীনেশরঞ্জন দাশ। অবশ্য সাহিত্যপত্র হিসেবে প্রমথ চৌধুরী
সম্পাদিত 'সবুজপত্র'
(১৯১৪)
এবং শ্রমিক স্বরাজ দলের সাহিত্যপত্র হিসেবে 'লাঙ্গল' (১৯২০)
আধুনিকতার যুগল আদিপুরুষ। কিন্তু বাহু
ছড়ানো 'কল্লোল'
মাতৃস্নেহের
অপার ভূমিকা গ্রহণ করেছিল যখন ১৯২৩ সালে প্রকাশ শুরু হয়। তার
পর আরও কিছু কাগজ বেরিয়েছিল যেমন কালি ও কলম, শনিবারের চিঠি, প্রগতি,
স্বদেশ,
উত্তরা,
পূর্ব্বাশা,
পরিচয়,
কবিতা,
চতুরঙ্গ,
কৃত্তিবাস
উল্লেখযোগ্য। মাসিক এই কাগজগুলো দীর্ঘায়ু লাভ না
করলেও ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল, খ্যাতি অর্জন করেছিল কিন্তু 'কল্লোল' ছিল খ্যাতির
শীর্ষে।
এই
সময়কার সকল কবি, সাহিত্যিক ও লেখকের প্রথম লীলাক্ষেত্র ছিল এই কাগজটি, লিখেছেন 'কালের পুতুলে'
কবি
বুদ্ধদেব বসু। একে ঘিরে তুমুল আড্ডা হত সেখানে যাঁদের
নাম কবি উল্লেখ করেছেন তাঁরা হলেন: নজরুল ইসলাম, প্রেমেন্দ্র (মিত্র), শৈলজানন্দ
(মুখোপাধ্যায়), অচিন্ত্যকুমার, প্রবোধকুমার (সান্যাল), হেমেন্দ্রকুমার
(রায়), মণীন্দ্রলাল
(রায়), মণীশ
ঘটক (যুবনাশ্ব), পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়, ধূর্জটিপ্রসাদ (মুখোপাধ্যায়), কালিদাস নাগ,
নলিনী
সরকার (গায়ক), জসীম উদ্দিন, হেমচন্দ্র বাগচী, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ
চট্টোপাধ্যায়, ভূপতি চৌধুরী, সরোজকুমার রায় চৌধুরী, শিবরাম
চক্রবর্তী, অজিত
দত্ত, বিষ্ণু
দে ও আরো অনেকে। এই আরো অনেকের অদৃশ্য তালিকায় কবি ও
সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্যের নাম ছিল কিনা জানি না। কবি
থেকে দুজনেই পরে সম্পাদক হয়েছিলেন যথাক্রমে 'প্রগতি' ও 'পূর্ব্বাশা'
কাগজের। বুদ্ধদেব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবনে কবিবন্ধু অজিত
দত্তকে নিয়ে প্রকাশ করেন সাহিত্য কাগজ 'প্রগতি' (১৯২৭-২৯)। পরে ১৯৩৫ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশ করেছিলেন আলোড়নতোলা বিখ্যাত
কবিতাপত্র 'কবিতা'
যা
তাঁকে সম্পাদক হিসেবে অসামান্য সম্মান এনে দিয়েছিল। তাঁর
বাসভবনকেই কাব্যসরস্বতীর মন্দির করে ফেলেছিলেন! অধ্যাপনা ও গবেষণার কারণে তিনি
দেশ-বিদেশে প্রচুর খ্যাতির অধিকারী হন। বলা যায় একজন
সফল এবং কালজয়ী কবি ও সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু।
অন্যদিকে
সঞ্জয় ভট্টাচার্য বুদ্ধদেব বসুর মতো অত জনপ্রিয়তা বা খ্যাতি পাননি দুই বাংলাতেই। তবে কবির চেয়ে তিনি সাহিত্যিক ও সম্পাদক হিসেবে তাঁর সময়কার
অন্যতম শীর্ষপুরুষ ছিলেন। ছেলেবেলা
থেকেই তাঁর সাহিত্যচর্চার শুরু। বুদ্ধদেব
বসুর পর তিনি সাহিত্য সাময়িকী 'পূর্ব্বাশা' প্রকাশ
করেছিলেন কড়িৎকর্মা সাহিত্যকর্মী সত্যপ্রসন্ন দত্তকে সহসম্পাদক করে বৃটিশ-ভারতের
রাজধানী কলকাতা থেকে বহুদূরে অবস্থিত মফস্বল শহর কুমিল্লায়। নাটক,
মঞ্চপাগল
একদল তরুণ অভিনয় কর্মকান্ডে হঠাৎ করেই হতাশ হয়ে তৎকালে শহরের ভাঙা চায়ের দোকান 'লক্ষ্ণী
কেবিন' যার
মালিক ছিলেন দীনেশ ও গনেশ দুভাই সেখানে আড্ডা দিতে গিয়ে এই কাগজটির জন্মদানের কথা
চিন্তা করেন। তাঁদের মধ্যে সঞ্জয় ভট্টাচার্যের বড়দা
প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ও গীতিকার অজয় ভট্টাচার্যও উপস্থিত ছিলেন। তাঁর
লিখিত অনেক গানে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ত্রিপুরা রাজবংশের রাজপুত্র ভারতখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ
শচীনদেব বর্মণ (১৯০৬-৭৫) সুর করেছেন। সেদিনের
আড্ডায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর কাগজের প্রধান সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের আদেশ
বড়দাই সঞ্জয়কে দেন। যথাসময়ে শহরের জগৎসুহৃদ প্রেস থেকে 'পূর্ব্বাশা'
প্রবসিত
হয়ে বেরিয়ে এসে ত্রিপুরাবাসীকে অভিভূত করে! এই প্রেসের মালিক ছিলেন 'যুগান্তর'
দলের
দুর্ধর্ষ বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তের বড়ভাই। তাঁদের পিতা
দ্বিজদাস দত্ত ছিলেন বৈদিক সাহিত্যে সুপন্ডিত, ব্রাহ্মসমাজের সভ্য এবং বিলেত
থেকে আধুনিক কৃষিবিদ্যা অর্জনকারী প্রথম ভারতীয়। স্বাভাবিক
কারণেই পূর্ব্বাশাকে তাঁরা স্বাগত জানিয়ে ছিলেন। এর
প্রথম প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন কল্লোল সম্পাদক দীনেশরঞ্জন দাশ। বলা
বাহুল্য, অতি
অল্প সময়ের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে কাগজটি দুই বাংলায়। নিঃসন্দেহে
তৎকালীন সময়ের জন্য এটা ছিল একটি দুঃসাহসিক উদ্যোগ। ওই
সময়কার মূলধারার প্রভাবশালী গুটিকয় কাগজের মধ্যে পূর্ব্বাশা অন্যতম প্রধান। স্বয়ং রাশভারি কবি বুদ্ধদেব বসু একে 'স্কুল'
বলে
আখ্যায়িত করেছেন। একদা চূড়ান্ত খ্যাত মননশীল কাগজ 'জিজ্ঞাসা'
সম্পাদক
স্বনামধন্য লেখক ও গবেষক শিবনারায়ণ রায় পূর্ব্বাশায় লিখেছেন এবং একে বলেছেন তখনকার
একমাত্র উচ্চমানের কাগজ। অবশ্যই এর
জন্য সম্পাদকের আগ্রহ, পরিশ্রম ও বুদ্ধিমত্তাকে স্বীকার করতেই হয়। বহু লেখক, সাহিত্যিক ও কবির লেখা তাতে প্রকাশিত হয়েছে। স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও লিখেছেন। পরবর্তী সময়ে এটি জনপ্রিয় সাপ্তাহিক চলচ্চিত্র ম্যাগাজিনের রূপ
নিয়েছিল। তিন পর্যায়ে কাগজটি প্রকাশিত হয়েছিল
যথাক্রমে ১৯৩২-৩৯, ১৯৪৩-৪৭ ও ৯৬৪-৬৯ সালে। প্রথম এক বছর
কুমিল্লাতেই কাগজটি প্রকাশিত হয়েছে। সাহিত্য কাগজ
হলেও এর বহুমুখী দিকও ছিল। যেমন
অর্থনীতি, রাজনীতি,
ইতিহাস,
ধর্ম,
বিজ্ঞান
এবং শিল্পকলা। সম্পাদকীয় নীতিতে অনেকটা বিদ্রোহী সুর
ছিল বলেও প্রবীণদের কাছে জানা যায়। সম্পাদক
সঞ্জয় ভট্টাচার্যের নিজেরও অনেক লেখা তাতে প্রকাশিত হয়েছে। কবি
হিসেবে তাঁর রচিত কবিতা কবিগুরুর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সম হয়েছিল। গদসাহিত্যে তিনি পাশ্চাত্য কলাকৌশলও প্রয়োগের চেষ্টা করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাগুলোর মধ্যে, কাব্যগ্রন্থ:
সাগর, পৃথিবী,
সঙ্কলিতা,
প্রাচীন
প্রাচী, যৌবনোত্তর,
অপ্রেম
ও প্রেম, পদাবলী,
মহাকাব্য,
উত্তর
পঞ্চাশ প্রভৃতি। উপন্যাস লিখেছেন কমপক্ষে তিরিশটি,
উল্লেখযোগ্য
হল: মরামাটি, বৃত্ত,
দিনান্ত,
রাত্রি,
কল্লোল,
সৃষ্টি,
স্মৃতি,
মৌচাক,
মুখোশ,
প্রবেশ-প্রস্থান
প্রভৃতি। মরামাটি ও সৃষ্টি দুটি বিখ্যাত উপন্যাস। 'তিনজন আধুনিক কবি' তাঁর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ
সমালোচনাগ্রন্থ।
সঞ্জয়
ভট্টাচার্য শুধু কবি বা লেখকই ছিলেন না, একজন প্রতিভাধর সমালোচক, ইতিহাসবিদ ও
ছান্দসিকও ছিলেন। পূর্ব্বাশাকে কেন্দ্র গ্রাম, কৃষি উন্নয়নেও
পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। পূর্ব্বাশা
কাগজ ছাড়াও এই প্রকল্পে সঞ্জয় ভট্টাচার্যের দল প্রচুর আর্থিক সহযোগিতা লাভ
করেছিলেন সেই সময়কার অগ্রণী পুরুষ কুমিল্লার অর্থশালী উকিল এবং ব্যাঙ্কার
নরেশচন্দ্র দত্ত যিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কুমিল্লা ব্যাঙ্কিং কর্পোরেশন লিঃ নামে
একটি ব্যাঙ্ক। এটাই কি পূর্ববাংলা বা দুই বাংলা অঞ্চলে
প্রথম ব্যাঙ্ক? এই শহরের আরেকজন কৃতী ও ধনাঢ্য ব্যক্তি ইন্দুভূষণ দত্তও
সাহায্য করেছিলেন। চট্টগ্রাম থেকে আগত কুমিল্লার
প্রভাবশালী চিকিৎসক ও শিক্ষাবিদ ক্যাপ্টেন নরেন দত্ত যিনি শ্রীকাইল কলেজের
প্রতিষ্ঠাতা এবং কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান 'বেঙ্গল
ইউমিনিটি'র
বিজ্ঞাপন দিয়ে পূর্ব্বাশাকে সহযোগিতা করতে এগিয়ে এসেছিলেন। পরবর্তীকালে
তিনি কলকাতায় ভারতী প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিশিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পূর্ব্বাশাকে সাহায্য-সহযোগিতা দিয়েছিলেন উদারভাবে। ভারতী প্রেসে আপন খেয়ালে পূর্ব্বাশা মুদ্রিত হত। জন্মলগ্ন থেকেই আর্থিকভাবে দুর্বল মাসিক পূর্ব্বাশা একসময়
অর্থাভাবে অনিয়মিত হয়ে গেলে কখনো মাসে কখনো দুমাসে কখনো আরও বিলম্বে প্রকাশিত হত
সেজন্য নরেন দত্ত ঠাট্টা করে একে না মাসিক না বার্ষিক যখন ইচ্ছে বের হয় তাই এটা 'ইচ্ছায়িক'
বলে
আখ্যায়িত করেছিলেন। উল্লেখ্য যে, কুমিল্লার
প্রখ্যাত আইনজ্ঞ, রাজনীতিবিদ এবং মন্ত্রী কামিনীকুমার দত্ত তাঁরই অগ্রজ।
বিত্তবানদের
আর্থিক আশীর্বাদে ধন্য সেই সঞ্জয় ভট্টাচার্য ইংরেজিতেও বহু লেখা লিখেছেন। ছাত্র জীবন থেকেই ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী, জীবনে কোনো
পরীক্ষাতেই দ্বিতীয় হননি। মনে হয়
অতিপ্রতিভাবানদের ক্ষেত্রে অনেক সময় যা ঘটে থাকে তাঁরও মানসিক বৈকল্য ছিল। আত্মহত্যাপ্রবণ ছিলেন প্রচন্ড--আর এই প্রবণতাটা ছিল
বংশানুক্রমিক।
একই
শহরে জন্ম ও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এঁরা দুই দিকপাল নিঃসন্দেহে,
যদিওবা
বুদ্ধদেব বসুর মতো খ্যাতি সঞ্জয় ভট্টাচার্য অর্জন করতে পারেননি কিন্তু তাঁর অবদান
কোনোভাবেই ক্ষুদ্রমাপের নয়, বরং অসামান্য। এহেন দুজন
অগ্রসর ও আধুনিক ব্যক্তির জন্মশতবর্ষ চলে গেল মাত্র বছর তিন-দুই আগে। কবি বুদ্ধদেব বসুর জন্মশতবর্ষ পালিত হয়েছে দেশে-বিদেশে,
স্মারক
ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়েছে, অল্পবিস্তর লেখালেখিও হয়েছে কিন্তু ২০০৯ সালে তাঁরই সমসাময়িক
সাহিত্যযোদ্ধা সঞ্জয় ভট্টাচার্যের জন্মশতবর্ষটি নিঃশব্দে অতিক্রান্ত হয়ে গেল। আশ্চর্য যে এই দুজনের আপন জন্মশহরই তাদেরকে বিস্মৃত হয়ে গেছে
একেবারেই! মজার ব্যাপার হচ্ছে প্রচলিত কুমিল্লার ইতিহাসে সঞ্জয় ভট্টাচার্যের নামটি
যেমন নেই পূর্ব্বাশার কথাও নেই! এত রঙিন ঝলোমলো পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে এই
শহরে যা দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যায় সেগুলোর কোনোটাতেই কেউ তাঁর প্রসঙ্গে লিখেছেন এমনটি
চোখে পড়েছে বলে স্মরণ করতে পারছি না। এবার তাঁর
স্মৃতি বিজড়িত অমূল্য একটি সাংস্কৃতিক সম্পদ শহরের বাদুরতলাস্থ শতবর্ষপ্রাচীন 'সিংহ প্রেস'
ভবনটিও
ভেঙ্গে পরিষ্কার করে দেওয়া হবে বলে গুঞ্জন উঠেছে। এই
দুঃসংবাদে এতই বিচলিত হলাম যে, ভাষায় প্রকাশ করার মতো মানসিক শক্তি
খুঁজে পেলাম না! কী বলব? কে শুনবে? বাঙালি যে এখন 'দোকানদার আর ফ্ল্যাটবাড়ির জাতি'তে পরিণত
হয়েছে! রাজনীতিক, মহাজন আর ডেভেলপার সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যই আজকের বাঙালি জাতির
সংস্কৃতি--উভয় বঙ্গে একই দশা। রবীন্দ্র-নজরুল-জীবনানন্দ-সঞ্জয়-সুকান্ত
দিয়ে কী হবে? পুরনোকে
পরিষ্কার করে দিয়ে নতুন নতুন আকাশচুম্বী অট্টালিকা হচ্ছে তারও কি বিসদৃশ চেহারা!
চারপাশের গিঞ্জিপাড়া আর নোংরা আবর্জনার স্তুপের মধ্যে এক একটি পদ্মফুল! এরকম লক্ষণ
বুদবুদ অর্থনীতির--এই প্রবণতাকে উন্নয়ন বা উন্নতি বলা যায় না। কেননা
উন্নয়ন সেটাকেই বলে, যখন সমানভাবে ধনতান্ত্রিক ও মানসিক প্রবৃদ্ধি ঘটে অর্থাৎ
সুশিক্ষা, সৌন্দর্যবোধ
ও রুচিশীলতার বিকাশ ঘটে! কী মনে হচ্ছে আজকের বাংলাদেশকে দেখে সচেতন ব্যক্তিমাত্রই
কেবল বলতে পারবেন। নগরায়নের নামে হারিয়ে যাচ্ছে সর্বত্র কত
না গুরুত্বপূর্ণ নয়নাভিরাম প্রাচীন-পুরনো পথ-ঘাট-সেতু, সৌধ, ভবন, মন্দির,
সমাধি,
পুকুর,
বাগানবাড়ি!
হায় কী এক আগ্রাসী রাক্ষুসে বাতাস এলো আর তাতে উড়ে যাচ্ছে অবলীলায় আমাদের গৌরবময়,
অর্থনৈতিকভাবে
সম্ভাবনাময় ইতিহাস, সংস্কৃতি আর শাশ্বত মূল্যবোধ তুলোট কাগজের মতো! কোথায় কবে কখন
এই অবক্ষয়ের অপ্রতিরোধ্য গতি গিয়ে থামবে আমরা জানি না! এর মধ্যে আরও কত সিংহপ্রেস,
আরও কত
থিওসোফিক্যাল সোসাইটি, রাণীর কুটির, বীরচন্দ্র নগর মিলনায়তন, কুমিল্লা
ক্লাব, দারোগা
বাড়ি, জগন্নাথ
বাড়ি, কালীবাড়ি,
মহেশাঙ্গন,
ঈশ্বর
পাঠশালা বিদ্যালয়, হোচ্ছামিয়া স্কুল, লালমাই পাহাড়, ময়নামতি
ধ্বংস হয়ে যাবে আমাদের চোখের সামনে আমরা কিছুই করতে পারব না। কেননা
এই আত্মক্ষয়ী প্রবঞ্চনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে রক্তপায়ী সর্বনাশা রাজনীতি! সময়টা এখন
ভদ্র মানুষ ও সংস্কৃতির জন্য আদৌ নিরাপদ নয়।
[২]
উল্লেখিত 'সিংহপ্রেস'
সেই
১৮৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। একে ঘিরে
আজকে কৈশোরের অনেক স্মৃতিই মনে পড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এই
তো সেদিনের কথা, ১৯৭৬-৮৪ সাল। হাত দিয়ে যেন
ছোঁয়া যাবে এত কাছের স্মৃতি। দেখেছি,
জেনেছি
শহরের সাহিত্যাঙ্গনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে ছিল সিংহপ্রেস প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই। এই প্রেসের দীর্ঘ ইতিহাস তাই বলে। শহরের
আরেক মহামূল্যবান সাংস্কৃতিক সম্পদ রামমালা গ্রন্থাগার ও মহেশাঙ্গন ট্রাস্টের
কর্মকর্তা, স্বনামখ্যাত
ঈশ্বরপাঠশালা বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক পন্ডিত ইন্দ্রকুমার সিংহ একবার আমার
সম্পাদিত মানচিত্র কাগজে সেই ইতিহাস লিখেছিলেন। শতবর্ষপ্রাচীন
এই প্রেসের কর্ণধার ছিলেন একদা ঐশ্বর্যশালী জমিদার বংশ সিংহবাড়ির অম্লান সিংহ। এই শহরের একদা তুখোড় সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব মন্টু সিংহের বড়দা। অম্লান সিংহের ছেলে মুকুট সিংহ তথা সকল সংস্কৃতিকর্মীর প্রিয় 'পিকুদা'
ছিলেন
এই প্রেসের সর্বশেষ ম্যানেজার। আর সার্বিক
তত্ত্বাবধানে ছিলেন খিটখিটে মেজাজের বেঁটেখাটো ভানুদা। কত
কাজ যে ছিল এই প্রেসে! শহরে ক'টা প্রেসইবা ছিল তখন! সারাবছরই স্কুলের প্রশ্নপত্র, ব্যবসা
প্রতিষ্ঠানের দাপ্তরিক দলিলপত্র ছাপা হত। তার মধ্যে
সাহিত্য সম্পর্কিত কাজ যেমন প্রচারপত্র, সংকলন, বই, পোস্টার
টুকিটাকি কতকি! পিকুদা হাসিমুখে যত্নসহকারে করে দিতেন। বারংবার
প্রুফ দেখতে গেলে মাঝেমধ্যে ভানুদা বিরক্ত হতেন কারণ অন্য কাজের ব্যাঘাত ঘটত। পিকুদার কাকাতো ভাই দোলন ছিল আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু তাই আমাকে
অন্যচোখে দেখতেন প্রেসের সবাই।
শিশু-কিশোর
সংগঠন 'চাঁদের
হাটে'র
কর্মী থাকাকালীন দুটি ছড়া ও কবিতা সংকলন আমি সম্পাদনা করেছিলাম ছাপা হয়েছিল সিংহ
প্রেসে। পিকুদা পয়সাকড়ির ব্যাপারে কখনোই চাপ
দিতেন না। সংস্কৃতিসেবী পরিবারের মানুষ বলে তিনি
ভালো করেই জানতেন কাজ করে দিলেও পয়সা আসবে আরও পরে, চাঁদা তুলে
মুদ্রণ মূল্য পরিশোধ করাটাই নিয়ম। অনেক সময়
পুরোটা পরিশোধও করা যায়নি। তাতে করে
সিংহপ্রেসের ব্যবসা বন্ধ হয়ে পড়েনি। বন্ধ হয়ে
গেছে পরে আধুনিক অফসেট প্রিন্টিং মেশিন একটার পর একটা আমদানি হওয়ার কারণে। হস্ত-চালিত প্রেস মেশিন আর ক'দিন চলে! পিকুদাও পরে ঢাকায় গিয়ে
ইংরেজি দৈনিক ইনডিপেন্ডেন্ট পত্রিকার সাংবাদিক হয়েছিলেন।
একদা
এই প্রেস থেকে বিখ্যাত 'ত্রিপুরা হিতৈষী' নামক পত্রিকা, সঞ্জয়
ভট্টাচার্যের 'পূর্ব্বাশা' কাগজ বার কয়েক ছাপা হওয়া ছাড়াও অনেক
মূল্যবান গ্রন্থাদি মুদ্রিত হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। নব্বই
দশকে এসে ক্রমশ পড়ে যেতে থাকে সিংহ প্রেস। দ্বিতল এই
প্রেসের নিচতলায় জনৈক ব্যক্তি ভাড়া নেন কয়েকটি কক্ষ। মালিক
অম্লান সিংহ একসময় বিক্রি করে দেন প্রেসটি স্থানীয় এক ব্যক্তির কাছে। এখন দখলত্ব নিয়ে চলছে মামলা প্রাক্তন ভাড়াটে ও নতুন মালিকের
বংশধরদের মধ্যে। মামলায় যে জিতবে সে ভেঙ্গে ফেলে হয়ত
বহুতলবিশিষ্ট শপিংমল জাতীয় কিছু করবে। গত কয়েক বছরে
প্রেসের কোনো চিহ্ন আর কোথাও নেই। নামটি
পর্যন্ত মুছে ফেলা হয়েছে। এই ভবনের
পেছনে গড়ে উঠেছে মুদ্রণ ও কাগজ বিক্রির ব্যবসাকেন্দ্র। দু-একটি
স্থানীয় পত্রিকার অফিস। সেদিন যখন ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম সন্ধের
আধো-আলো অন্ধকারে মনে হচ্ছিল নোনাধরা ঝুরঝুরে দেয়াল থেকে কেউ ফিসফিসিয়ে বলছে: কী
দ্যাখছ? আমার
গুঁড়িয়ে পড়ার দৃশ্য? আমাকে মনে রেখো, ইতিহাস লিখে রেখো। কিন্তু
ইতিহাস লেখার চেয়েও বড় দায়িত্ব যে এ রকম সাংস্কৃতিক সম্পদগুলো রক্ষা করার। এগুলোকে সংস্কারের মধ্য দিয়েই নতুন ধ্যানধারণাজাত প্রযুক্তির
সাহায্যে বহুতল ভবন তৈরি করা আজ আর কঠিন কিছুই নয়। সভ্য
দেশে তাই তো করা হচ্ছে: সাংস্কৃতিক সম্পদগুলোকে আকর্ষণীয় লাভবান পর্যটন শিল্পের
উপাদানে রূপান্তরিত করছে। সযত্ন
সংস্কারের মধ্য দিয়ে জাদুঘর করা হচ্ছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য।
বাঙালির
সে ইচ্ছে ও রুচি কোনোটাই নেই। ধ্বংস করাই
যেন বাঙালির নেশাতাড়িত এক খেলা! তাই সরকারি প্রতিষ্ঠান যেখানে সঞ্জয় ভট্টাচার্যসহ
আরও বিখ্যাত মানুষ যাঁরা একদিন শিক্ষা গ্রহণ করেছেন সেই শতবর্ষপ্রাচীন ভিক্টোরিয়া
সরকারি কলেজের (আমিও যার ছাত্র) এখন কী হতশ্রী চেহারা হয়েছে না দেখলে বিশ্বাস হত
না! ভবন, জানালা,
দরজা
সব ভেঙ্গে গুঁড়ো গুঁড়ো ঝরে পড়ছে। অথচ
ভিক্টোরিয়া যুগীয় আদলের এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেমন অদ্বিতীয় স্থাপত্য নিদর্শন তেমনি
এই শহরের একটি গৌরবও বটে! কিন্তু এসব বোঝার মানুষ আর নেই বলেই খুব সহজে বিস্মৃত আজ
কুমিল্লার এই দুই কৃতীসন্তানসহ আরও বহুজন। এই
বিস্মৃতিময় সাংস্কৃতিক দারিদ্র নিয়ে কোন্ দিকে অগ্রসর হচ্ছে একদা শিক্ষা ও
সংস্কৃতির 'পথিকৃৎ
কুমিল্লা' কে
বলে দেবে?